বরগুনা সদরের পাথরঘাটা ইউনিয়নের পাখি বেগম ফিরে গেলেন ২০০৭ সালের সিডরের দিনে। এত বড় বন্যা হবে তিনি বুঝতে পারেননি। টেলিভিশনে খবর দেখে পাখি বেগমের ভাই চট্টগ্রাম থেকে বোনকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু স্বামী শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস করেননি সেদিন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার কথা বললে চৌকিতে শুয়ে থাকা স্বামী গালাগালও করেন। তবে একসময় পানির তোড়ে পাখি বেগম ছোট মেয়ের হাত ধরে সাঁতরে বের হন। স্বামী ও অন্য ছেলেমেয়েরাও বের হতে পেরেছিলেন। তবে পানির তোড়ে ঘর, ১৪টি ছাগল, পুকুরের মাছ—সবই ভেসে যায়।
পাখি বেগম শুধু অচেনা ভিটেতে ফিরে আসেন, তবে দমে যাননি। স্থানীয় এক সংগঠনের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর সেলাই মেশিন পান। বাজার থেকে টুকরা কাপড় কিনে শুরু করেন ব্যবসা। পাথরঘাটার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের এই নারীর অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হলেও তিনি তাঁর বড় মেয়েকে ডিগ্রি পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন। আরেক মেয়ে স্নাতক পড়ছেন। ছেলেকে পড়িয়েছেন এসএসসি পর্যন্ত। শুধু তা-ই নয়, পাখি বেগম বর্তমানে সুন্দরবন নারী দলের সভাপতি। তিনি গ্রামের নারীদের নিয়ে উঠান বৈঠক করে দুর্যোগ মোকাবিলার কথা বলেন।
এ ধরনের প্রশিক্ষণে আসলেই কোনো লাভ হয় কি না জানতে চাইলে পাখি বেগম দৃঢ়ভাবেই বললেন, ২০০৭ সালের পর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে ও পরে তিনি যে বিষয়গুলো শিখেছেন, তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। অন্য ব্যক্তিরাও এখন অনেক সচেতন। আর পাখি বেগমের ভাষায় বড় পরিবর্তন হচ্ছে, ‘স্বামীও এখন আমার কথা শোনে। আগে বাড়ির বাইরে যাইতে পারতাম না, আর এখন ঢাকা পর্যন্ত আসতে পারছি।’
গতকাল সোমবার রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত ‘মিজারিং রেসিলিয়েন্স: উইমেনস পারসপেক্টিভ’ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কথা হয় পাখি বেগমের সঙ্গে। এই সভায় শুধু পাখি বেগম নন, পাথরঘাটার পদ্মা নদী নারী দলের সভাপতি শাহিদা, ফরিদপুরের নর্থ চ্যানেল চরের দক্ষ ধাই হিসেবে কাজ করা সূর্য বেগম, ফরিদপুরেরই রাশেদা বেগম, পটুয়াখালীর কলাপাড়া থেকে আসা লাইলী বেগমসহ কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা হয়। অ্যাকশনএইডের সহায়তায় স্থানীয় বিভিন্ন এনজিওর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে তাঁরা এখন জানেন, কীভাবে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। এই নারীরাই অ্যাকশনএইড পরিচালিত ‘উইমেন রেসিলিয়েন্স ইনডেক্স: কমিউনিটি সিচুয়েশন’ বিষয়ক পরিচালিত নতুন জরিপেও অংশ নেন।
গতকাল এই জরিপের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। জরিপ অনুযায়ী, নারীদের যাতায়াতসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে দুর্যোগ মোকাবিলায় নারীরা পুরুষের তুলনায় ২৪ শতাংশ কম সক্ষমতাসম্পন্ন। অর্থনৈতিক, সামাজিক, অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক সূচকে নারীর স্কোর ৪০ আর পুরুষের স্কোর ৫৫।
সভার বক্তাদের মতে, দুর্যোগের সময় নারীরা নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে তা আরও কার্যকর ভূমিকা রাখবে। অ্যাকশনএইড এর আগে ‘সাউথ এশিয়ান উইমেনস রেসিলিয়েন্স ইনডেক্স’ শীর্ষক আরেকটি জরিপ চালায়, সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার (আফগানিস্তান ছাড়া) দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ষষ্ঠ। দক্ষিণ এশিয়ায় পরিচালিত জরিপকে সামনে রেখেই বাংলাদেশে পটুয়াখালী, বরগুনা ও ফরিদপুর জেলার চারটি ইউনিয়নে বর্তমান জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এতে অংশ নেন ২৬১ জন, যাঁদের মধ্যে ১৩২ জন ছিলেন নারী। ৩৬টি প্রশ্নের ভিত্তিতে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এতে উঠে এসেছে, ৫৩ শতাংশ নারী দুর্যোগের সংকেত পাওয়ার পরও আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেন না।
গতকাল সভায় জাতিসংঘের নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন সালমা খান বলেন, নির্যাতনের শিকার নারীকে তথ্য দেওয়া হলেও তাঁরা আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়াসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবেন কি না, তা-ও একটি বড় প্রশ্ন।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের দেশীয় পরিচালক ফারাহ্ কবির বলেন, দুর্যোগের সময় নারীর চিন্তা থাকে পরিবার ও সন্তানকে নিয়ে। নিজের জন্য আলাদা করে চিন্তা করার অবকাশ নেই। তবে নারীর এ অবস্থান স্বীকৃতি পায়নি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ, ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের পরিচালক সলিমুল হক, অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশনের জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাশ্বতী বিপ্লব আলোচনায় অংশ নেন।
দুর্যোগ মোকাবিলায় নারীরা পিছিয়ে
Facebook Comments