বর্তমান সময়কার দম্পতির মাঝে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ থাকা খুব স্বাভাবিক। কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট – শুনতে খুব ভারিক্কি মনে হলেও, শেষ পর্যন্ত এর প্রয়োগ দেখা যায় একদম চাল চুলো, গম আলু তে। টিভির রিমোট কাড়ার মত ছোট বিষয় থেকে শুরু করে জীবনের প্রতি দর্শন – যে কোন কিছুই কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের আওতায় পড়তে পারে।
কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট কী? এটা কি কেবলই ভিন্নমত? না! বরং ভিন্নমতের/ভিন্ন পছন্দের দু’জন আলাপ আলোচনা করে অন্যের যুক্তিটাকে মেনে নিয়ে পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই যখন জানায়, এই অভ্যাসটা/দর্শনটা/প্রিয় বস্তুটা আমি ছাড়তে পারব না – তখন তাকে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট এর আওতায় ফেলা যায়।
কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট হতে পারে খুব ছোট কোন বিষয় নিয়ে। হয়ত পার্সোনাল স্পেসের মাত্রাটা ভিন্ন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে খুঁতখুঁতেপনা একজনের বেশি। আবার হতে পারে অনেক বড় – হয়তবা জীবনের সার্থকতার মাত্রাটাই। আপনার ইচ্ছে করে আয়েশ করে জীবন কাটাতে। আপনার জীবনসঙ্গীর ভীষণ ইচ্ছে পুরো বাংলাদেশটা পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখার।
মনে হচ্ছে এমন আর কী? থাকলোই নাহয় ভিন্নতা, অসুবিধা কী? অসুবিধা আছে। প্রতিদিনের কাজে বারবার করে খটিমটি বাঁধবে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে। আপনার জীবনসঙ্গী হয়ত যেভাবে ভুল সংশোধন করে সেটা আপনার পছন্দ না। শোধরাতে চাইবেন, দেখবেন তার ভেতরে গেড়ে আছে এই বোধ – ভুল শোধরাতে হলে শক্ত না হয়ে উপায় নেই। এর ফলাফল পড়বে সন্তানদের বড় করায়।
আপনার জীবনসঙ্গী বন্ধুদের জন্য খরচের ব্যাপারে বেশ উদারহস্ত। আর আপনি মনে করেন জীবনের জন্য এত খরচের প্রয়োজনটা কী? বিলাসিতা আপনার চক্ষুশূল। কী হবে? প্রতিবার এ ধরণের আয়োজনে আপনি গোমড়া হয়ে থাকবেন।
আরো উদাহরণ দিতে হবে? ঠিক আছে। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কথাই বলি। দু’জনেই ধার্মিক। একজন উদারমনা ধার্মিক, একজন কট্টর ধার্মিক। একজন দান সদকা ও সামান্য আয়ে সাধারণ জীবনযাপনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে আগ্রহী, অন্যজন জ্ঞানচর্চা, জীবিকায় উন্নতির শিখরে চড়ে মুসলিমদের এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী। ভাবছেন সমস্যাটা কী? ধরুন একটা ভালো চাকরির সুযোগ আছে, কিন্তু এতে করে পরিবারে সময় দেয়া কমে যাবে অনেকটাই। দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে একজন উৎসাহ দেবেন, অপরজন আপত্তি জানাবেন।
এই বিষয়গুলোকে মতদ্বৈততা না বলে ইন্টারেস্টে কনফ্লিক্ট বলছি কেন? কারণ মতের এই ভিন্নতা তৈরি হয়েছে জীবনদর্শনের ভিন্নতা থেকে। আপনি মত বদলাতে পারবেন, জীবনদর্শন বদলাতে পারবেন না। ফলস্বরূপ আপনার উৎসাহে আপনার সঙ্গী সাময়িকভাবে কাজটাতে সম্মতি দিলেও আপনি যে পর্যায়ের আন্তরিকতা আশা করছেন, সেটা পাবেন না কখনোই।
তো কী করা যায়? আপনাদের প্রায়ই ঘুরেফিরে যে জিনিসগুলো নিয়ে খিটিমিটি লাগে, বোঝার চেষ্টা করুন সেটা চিন্তাধারা/জীবনাদর্শের ভিন্নতা থেকে হচ্ছে কি না। যদি তা হয়, তবে বৃথাই একই তর্কবৃত্তে ঘুরে ঘুরে না মরে, বৃত্তের বাইরে এসে দাঁড়ান। চিন্তা করে দেখুন নিজের বা তার এই দর্শনটা বদলানো সম্ভব কি না। যদি না হয়, মেনে নিন।
মেনে নেয়া বলতে কি বোঝায় যত খারাপই লাগুক, হাসিমুখে মেনে নেয়া? মোটেও না। সঙ্গীকে জানিয়ে দিন, তোমার এই দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি সমর্থন করিনা। আমি নিজে এভাবে জীবন কাটাতে চাইনা। এমনকি সেটা যদি হয় স্বচ্ছলতা-কৃচ্ছ্রতার দ্বন্দ্ব, নিজের জীবনে আপনারটা মেনে চলুন, আর তাকেও তারটা মানতে দিন।
আগেই বলেছি, জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থাকলে প্যারেন্টিং ইস্যুতে এসে খুব সমস্যা হয়ে যায়। একজন হয়ত দামি দামি খেলনা, কাপড় কিনে দিচ্ছে, অন্যজন সহজ জীবনের কথা বলেই যাচ্ছেন – এতে করে ছেলেমেয়েরা বাবামায়ের অন্তর্দ্বন্দ্বটা বুঝতে পারে খুব সহজে, আর তারা জীবন সম্পর্কে নির্দেশনাটাও ঠিকমত পায়না।
সমাধান কী? সমাধান হচ্ছে আগে থেকেই এ বিষয়গুলো চিহ্নিত করে জীবনসঙ্গীর সাথে কথা বলা। তাকে জানানো আমি এভাবে জীবনকে সাজাতে চাই, তুমি কী মনে কর? আমার সন্তানদের এভাবে বড় করতে চাই, তোমার আপত্তি থাকলে আগে থেকেই কথা বলে নেয়া ভালো। অন্তত সন্তানদের সামনে যেন দ্বন্দ্বটা প্রকট হয়ে না ওঠে। এমনকি চাইলে এটাও সম্ভব, সন্তানদের বোঝানো, ‘তোর বাবা/মা এমন মনে করে, কিন্তু আমি এমন মনে করি। দুইজনেই ঠিক, তুই তোর পথটা পছন্দ করে নিবি।’ অথবা, ‘তোর বাবা/মা জিনিসটাকে এভাবে দেখে। আমার মনে হয় এভাবে হলে ব্যাপারটা আরো ভালো হত।’ এভাবে প্রকাশ করলে সন্তানেরা ভিন্নমত সহ্য করেও সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার একটা বাস্তব শিক্ষা পাবে।
পরমত-অসহনশীলতার যে মাত্রাতিরিক্ত প্রকাশ দেখা যাচ্ছে আজকাল – ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তার থেকে রক্ষা করতে পরিবারের মধ্যে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টগুলো আগেই চিহ্নিত করে নেয়া ভালো।
পরিশেষে, রেহনুমা আপুর প্রিয় এক উক্তি শরৎচন্দ্রের রচনা থেকে –
অভিমানের যেখানে মূল্য নাই, সেখানে অভিমান প্রকাশের ন্যায় বিড়ম্বনা আর নাই।
প্রতিটা বিষয় মতে মিলতেই হবে এমন কোন কথা নেই। আর না মিললেই অভিমান, দুঃখ নিয়ে জীবনটাকে ব্যর্থ মনে করতে হবে, এমনও কোন কথা নেই। কোন কোন পথ একলা চলেও উপভোগ করা যায়, যদি জানেন সমান্তরাল আরও একটি পথের শেষে আবারও তার সাথে দেখা হবে।
নুসরাত রহমান
পিএইচডি(বায়োলজি)