banner

রবিবার, ০৯ মার্চ ২০২৫ ইং, ,

পোস্টটি 55 বার পঠিত

 

তুরস্কের ক্যালিগ্রাফি শিল্পের নব পথিকৃৎ রুমেয়সা কুরতুলুস

তুরস্কের ক্যালিগ্রাফি দীর্ঘ শতাব্দী ধরে দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম প্রধান অংশ। “শব্দ উড়ে যায়, লেখা থেকে যায়” -এই প্রবাদটি তুরস্কে ক্যালিগ্রাফির স্থায়িত্ব ও গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে। একসময় এই শিল্প রাজপ্রাসাদ, মসজিদ এবং পাণ্ডুলিপিকে অলঙ্কৃত করত, কিন্তু আধুনিক যুগে বিজ্ঞাপন, ডিজিটাল স্ক্রিন ও নিওন সাইনের ভিড়ে এর সৌন্দর্য অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। তবু কিছু শিল্পী এখনো এই ঐতিহ্যকে জীবন্ত রাখার চেষ্টা করছেন, এবং তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রুমেয়সা জয়নেপ কুরতুলুস।
ইস্তাম্বুলের উস্কুদারে নিজের ক্যালিগ্রাফি স্টুডিও ‘কেবিকেচ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাত্র ২৬ বছর বয়সেই কুরতুলুস ক্যালিগ্রাফি শিল্পে নতুন জীবন আনতে শুরু করেন। তার কাজ শুধু ব্যক্তিগত শিল্পীসত্তার প্রকাশ নয়, বরং তুরস্কের ঐতিহ্য রক্ষা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে এই সংস্কৃতিকে তুলে ধরার মাধ্যম।

তুরস্কের ক্যালিগ্রাফি চর্চার ইতিহাস দীর্ঘ। ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর এটি আরও সমৃদ্ধ হয়। তবে ১৯২৮ সালে তুরস্কে লাতিন বর্ণমালা চালুর ফলে আরবি ক্যালিগ্রাফির প্রভাব কমতে থাকে, এবং এখান থেকেই আধুনিক তুর্কি ক্যালিগ্রাফির নতুন শাখার জন্ম হয়। এমিন বারিন ছিলেন এই পরিবর্তনের অগ্রদূত। তিনি আরবি ক্যালিগ্রাফির নান্দনিকতাকে লাতিন শৈলীর সঙ্গে একত্রিত করে এক নতুন ধারা তৈরি করেন।

কুরতুলুসও তার ক্যালিগ্রাফি শৈলীতে ঐতিহ্যগত কুফিক স্ক্রিপ্ট, লাতিন ক্যালিগ্রাফি ও আধুনিক ডিজাইনের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। বিশেষ করে তার সৃষ্টি ‘শব্দ উড়ে যায়, লেখা থেকে যায়’ এক অনন্য উদাহরণ, যেখানে তিনি তুরস্কের বর্ণমালা সংস্কারের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তার কাজে আরবি ও লাতিন অক্ষরের অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়, যা কেবল দৃষ্টিনন্দন নয়, বরং ঐতিহাসিক সংযোগও তুলে ধরে।

তার শিল্পীসত্তা শুধু সৃজনশীলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি এক দীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।
কুরতুলুসের আর্কিটেকচারাল শিক্ষার প্রভাব তার কাজে স্পষ্ট -তিনি ক্যালিগ্রাফিকে শুধুই অক্ষরের নকশা হিসেবে দেখেন না, বরং স্থাপত্যশিল্পের মতোই এটি একটি কাঠামোগত উপাদান হিসেবে বিবেচনা করেন। তার মতে, ক্যালিগ্রাফি শুধু শিল্প নয়, এটি একটি সভ্যতার সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির প্রতিচিত্র।

২০১৭ সালে তার প্রথম প্রদর্শনী ‘রেঞ্জ খোদা’ দর্শকদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে। এটি ছিল একটি মাল্টি-সেন্সরি প্রদর্শনী, যেখানে শুধু চোখ নয়, স্পর্শের মাধ্যমেও শিল্পকর্ম অনুভব করা যেত। বিশেষ করে, একটি ব্রেইল ক্যালিগ্রাফি কাজ ‘আল্লাহ’ দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, যা তাদের প্রার্থনার অনুভূতিকে বাস্তবে রূপ দেয়।

কুরতুলুসের কাজ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বেশ প্রশংসিত। ২০২৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রোমান হলিডে কনফারেন্সে অংশ নেন এবং প্রথন তুর্কি ক্যালিগ্রাফার হিসেবে সম্মাননা স্বরূপ ‘ড্যান্সিং লেটার্স’ স্কলারশিপ অর্জন করেন।

বর্তমানে, তিনি তার স্টুডিওতে নিয়মিত কর্মশালা পরিচালনা করছেন, যেখানে নতুন প্রজন্মকে ক্যালিগ্রাফির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তার কাজ শুধু ঐতিহ্য সংরক্ষণই নয়, বরং এটি একটি নবজাগরণ।

রুমেয়সা কুরতুলুস প্রমাণ করেছেন যে ক্যালিগ্রাফি শুধুমাত্র অতীতের স্মারক নয়,বরং এটি একটি প্রাণবন্ত ও সৃজনশীল শিল্পধারা, যা সময়ের সঙ্গে নবায়িত ও বিকশিত হচ্ছে।

Facebook Comments