কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী এবং ওই কলেজের নাট্য সংগঠন ‘ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটার’র সদস্য সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণপূর্বক হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র।
বুধবার (২৩ মার্চ) বিকেলে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সীমা দত্ত ও সাধারণ সম্পাদক মর্জিনা খাতুন এক বিবৃতিতে এ দাবি জানান।
বিবৃতিতে নারী নেতৃদ্বয় বলেন, ‘সারাদেশে ভয়াবহ নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার চিত্র দেখলে যেকোন বিবেকবান মানুষ শিউরে উঠবে। দেশে বছরে ৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী ধর্ষণসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। কিন্তু রাষ্ট্র এই ধর্ষণকারী-নির্যাতনকারীদেরকে বিচারের আওতায় আনেনি। বরং বর্ষবরণে নারী লাঞ্ছনার ঘটনার বিচার নিয়ে প্রহসন চলছে। রাষ্ট্রের মন্ত্রীরা তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে লাঞ্ছনাকারীদের মদদ দিয়েছে, পৃষ্ঠপোষকতা দান করছে।’
তারা বলেন, ‘মন্ত্রীদের দায়িত্বহীন বক্তব্য শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত দুর্বৃত্তদের অপরাধ সংঘটনে উৎসাহী করেছে। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি নারীসমাজসহ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কেড়ে নিয়েছে। তাই তনু হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার-বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আর এর মধ্য দিয়ে দেশে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে- তার অবসান ঘটবে।’
উল্লেখ্য, গত ২০ মার্চ রাত সাড়ে ৭টায় টিউশন শেষে বাসায় ফেরার পথে সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণপূর্বক নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর ময়নামতি সেনানিবাসের অলিপুর এলাকায় একটি কালভার্টের কাছ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
তনুর ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায় কতটা সুহাসিনী ছিল মেয়েটি। ছিল চোখেমুখে রাশি রাশি স্বপ্ন। পৃথিবী জয় করার সে স্বপ্নের ছোঁয়া পেত সবাই। মুখ দেখলেই কেমন মায়া লেগে যেত। এমন একটা মেয়েকে নরপশুরা খুবলে খেয়েছে। গলাকেটে হত্যার পর অর্ধনগ্ন অবস্থায় ফেলে রেখে গেছে ঝোপঝাড়ে।
গত ২০ মার্চ রাতে ময়নামতি সেনানিবাসের অলিপুর এলাকার একটি কালভার্টের কাছ থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে তনুর অর্ধলগ্ন লাশ।
পুরো নাম সোহাগী জাহান তনু (১৯)। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের (সম্মান) ছাত্রী। শুধু তাই নয়, একই কলেজের নাট্য সংগঠন ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের (ভিসিটি) সদস্যও।
তনুর এভাবে চলে যাওয়া কিছুতেই মানতে পারছে না কেউ। প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছে গোটা দেশ। চলছে নানা কর্মসূচি। একইভাবে ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মধ্যম ফেসবুকেও।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ওয়াহেদ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন: ‘সবার উপরে ময়নামতি’- এই ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে ’৭২ সনে অস্ত্র জমা দিয়েছিলাম। জীবনের প্রথম ময়নামতি ঘুরে ঘুরে দেখি- এতো নয়নাভিরাম ক্যান্টনমেন্ট মনে হয় পৃথিবীতে আর নেই। কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনায় অপরাধীই শুধু অপরাধী- তার পরিচয় যাই হোক না কেন? ভিক্টোরিয়ার ছাত্রী সোহাগীর হত্যাকাণ্ডে শোক জানানোর ভাষা নেই- ‘কোথা থেকে কখন যে কি হয়ে গেল/ সাজানো ফুলের বনে ঝড় বয়ে গেল/ সে ঝড় থামার পরে পৃথিবী আঁধার হলো/ তবু দেখি দ্বীপ গেছো জ্বেলে/ তুমি চলে গেলে।’
তনুর হত্যাকারীদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃণা প্রকাশ করে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন নিজাম উদ্দিন রাব্বি নামে আরেক ব্যক্তি। তিনি লিখেছেন, ‘কুমিল্লা সেনানিবাসে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনুকে। ভাবতেই অবাক লাগে আজ আমরা কোথায় বাস করি। আমাদের প্রাণের নিরাপত্তা নেই। কুকুরের মত মরতে হচ্ছে আমার প্রিয়তম বোন, সহকর্মী, বন্ধুকে। ছিঃ! ধিক্কার এই সমাজের ঘৃণিত মানুষরূপী পশু আর দায়িত্বহীন মহামানবদের! আমরা সকল জাগ্রত জনতা অতি শিগগিরিই তনু হত্যার সঠিক বিচার চাই।
পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তারাও হতবাক হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন তনুর ঘটনায়। ইমতিয়াজ নামে পুলিশের এক ইন্সপেক্টর তার ফেসবুক স্ট্যাটাস লিখেছেন, Proper investigation, The accused must be arrested, demand justice. Need a massive Anti-crime march country wide.
তনুর হত্যাকারীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তার পরিবারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করে হাসান কবীর নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘—–প্রসঙ্গঃ তনু হত্যা—— ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের মেধাবী ছাত্রী এবং ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের দক্ষ নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধনে, শিক্ষক, সাবেক নেতৃবৃন্দ, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি থেকে আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রলীগ এবং কবি নজরুল ইসলাম হল ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে জানাই আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ।
আশা করি, এভাবেই আমার প্রিয় সংগঠন ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রলীগ তনু হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত তার পরিবারের পাশে থাকবে। সর্বশেষ আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং আল্লাহ যেন তাকে পরকালে সুখে শান্তিতে রাখেন সেজন্য সবার দোয়া কামনা করছি।’
সোহাগী জাহান তনু কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বাসিন্দা ইয়ার হোসেনের মেয়ে। তনুর বাবা ময়নামতি সেনানিবাস এলাকায় অলিপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। সেই সুবাদে তনুরা অনেক দিন ধরেই অলিপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করে আসছে। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তনু মেজো। পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে তনু পাড়াশোনার পাশিপাশি বাসার কাছে অলিপুর গ্রামেই এক বাসায় টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে আসছিলেন।
ঘটনার দিন (২০ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৫ টার দিকে প্রতিদিনের মতো তনু ঘর থেকে বের হন। বাসায় ফিরতে দেরি হওয়ায় পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করে। কিন্তু চেষ্টা ব্যর্থ হলে যে বাসায় টিউশনি করতেন সেখানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় ওই বাসা থেকে তিনি বের হয়ে গেছেন।
খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ময়নামতি সেনানিবাসের অভ্যন্তরে পাওয়ার হাউসের পানির ট্যাংক সংলগ্ন স্থানে তনুর মৃতদেহ পাওয়া যায়। গলাকাটা মৃতদেহ নগ্ন অবস্থায় কালভার্টের পাশে ঝোপঝাড়ের ভেতর পড়েছিলো। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিলো। মোবাইল ফোনটিও পড়েছিল পাশে।
লাশ উদ্ধারের পর কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ-আল-মামুন বাংলামেইলকে জানিয়েছিলেন, মরদেহ দেখে প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তাকে ধর্ষণ ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।
>ধর্ষণের পর ভিক্টোরিয়ার ছাত্রীকে হত্যা
>তনু মাফ করে দিস আমাদের….
>মা, কাল নতুন জামা পরে কলেজে যাবো
>কুমিল্লায় তনু ধর্ষণ-হত্যা : প্রতিবাদের ঝড়
>নাট্যকর্মী তনু ধর্ষণ-হত্যার প্রতিবাদে কুমিল্লায় জনসমুদ্র
>তনু ধর্ষণ-হত্যা : কুমিল্লায় দেড় ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ
সূত্রঃ বাংলামেইল২৪.কম