banner

মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৫ ইং, ,

পোস্টটি 551 বার পঠিত

 

ঢেউয়ের বিরুদ্ধে হাল ধরেছেন নয় নারী

নদের নাম বুড়াগৌরাঙ্গ। তবে বয়োবৃদ্ধ নয়। ভাটার সময়ও তীব্র স্রোতের টান, ঢেউ আছড়ে পড়ে দুপাড়ে। জোয়ার এলে তো কথাই নেই। ঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের সময় যেন দানব হয়ে ওঠে বঙ্গোপসাগর-ঘেঁষা পটুয়াখালীর এই নদ।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নদীর রূপ যা-ই হোক না কেন, বুড়াগৌরাঙ্গ কিন্তু হার মেনেছে কয়েকজন নারীর কাছে। প্রশস্ত এই নদের ঢেউ চিরে তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন দ্রুতগামী জলযান, ইংরেজি ‘স্পিডবোট’ নামে সবাই যাকে চেনে। ক্ষিপ্রগতিতে স্পিডবোট চালিয়ে তাঁরা উপার্জন করছেন অর্থ, হাল ধরেছেন দারিদ্র্যের কবলে পড়ে ধুঁকতে থাকা সংসারের।
নদের স্রোতের বিরুদ্ধে এভাবে হাল ধরেছেন মাত্র নয়জন—কুলসুম বেগম, খাদিজা বেগম, নূপুর আক্তার, ফাতেমা বেগম, নীলুফার, মমতাজ, সুজাই রানী, সালেহা ও নূরজাহান। ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সের এসব নারী থাকেন পটুয়াখালীর গলাচিপার চর বিশ্বাস ও চর কাজল ইউনিয়নে। জন্ম থেকেই এই চরাঞ্চলকে ঘিরে থাকা দুরন্ত সব নদ-নদী তাঁদের চিরচেনা।
দুর্গম এ চরাঞ্চলে বাল্যবিবাহের প্রচলন আছে। মাছ ধরা আর কৃষিকাজ ছাড়া পুরুষদের অন্য কোনো কাজ নেই। বর্ষার পর কার্তিকের ধানকাটা হলে তাঁরা প্রায় কর্মহীন। এর ওপর কেউ যদি স্বামী পরিত্যক্ত হন, কিংবা কারও স্বামী যদি মারা যান, তাহলে নারীদের একপ্রকার পানিতেই পড়ে যেতে হয়। এই নয়জন নারীই এভাবে অসহায়ত্বের কবলে পড়েছিলেন।
ব্যবসায়ী আদু আকন্দ বছর কয়েক আগে মরণঘাতী ক্যানসারে ভুগে মারা যান। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন খাদিজা আক্তার। একইভাবে ফাতেমা আক্তারের স্বামী আবদুর রহমান খানের আয়-রোজগারে সংসারে অভাব-অনটন লেগেই ছিল। ওদিকে মধ্যপ্রাচ্যে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান নূপুরের স্বামী দুই সন্তানের জনক শাহ আলম।
কিন্তু যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অ্যাকশনএইডের আর্থিক সহায়তায় চরবাসীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের (পিআরসিডি) অধীনে চর বিশ্বাস ও চর কাজলে অসহায় নারীদের জন্য শুরু হয় স্পিডবোট প্রশিক্ষণ। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে অ্যাকশনএইডের অংশীদার সাউথ এশিয়ান পার্টনারশিপ (স্যাপ)। ৯ জন নারী ও ১১ জন পুরুষকে স্পিডবোট চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ছয় মাসে প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন তাঁরা। বর্তমানে চার মাস ধরে বুড়াগৌরাঙ্গসহ আশপাশের নদ-নদীতে স্পিডবোট চালিয়ে আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন কুলসুম, খাদিজা, নূপুর, ফাতেমা, নীলুফাররা।
২১ নভেম্বর দুপুরে বন্যাতলী ঘাটে কথা হয় খাদিজা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এমন কু-কথা নাই যে আমারে শুনতে হয়নি। বোট যেন চালাইতে না পারি, হের লইগা আমারে নিয়া প্রভাবশালীরা সালিস বসাইছে। আমার স্বামী না থাকার সুযোগ যারা নিতে চাইছে, তারাই আবার অপবাদ দিসে।’
নূপুর অনেকটা কান্না মেশানো কণ্ঠে বলেন, ‘ভাই, আমাগো এই চরে কাম করনের সুযোগ নাই। হাতও পাততে চাই না। পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে আইসা স্পিডবোট চালানো শিখছি। অহন এই বোট চালাইতে পারলে বাচ্চা দুইডার মুখে খাওন দিতে পারমু। ভাই, খুব কষ্টে আছি।’
স্পিডবোট মাত্র একটি। চালক নয়জন নারী। বোট চালাতে মেরিন অফিস থেকে নিবন্ধন করা হয়েছে। এখন বন্যাতলী থেকে চর কাজল ঘাট পর্যন্ত চালাতে রুট পারমিটের আবেদন করা হবে। এরপরই বাণিজ্যিকভাবে স্পিডবোট চালানো শুরু হবে বলে জানান পিআরসিডির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক ভুঁইয়া ফরিদউদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন গর্ভবতী মা-সহ অসুস্থ রোগীদের দুর্গম চরাঞ্চল থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছে দেওয়া, লাশ বহনের সেবামূলক কাজ করা হয় এই স্পিডবোটের মাধ্যমে। পর্যটক, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন কার্যক্রমের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। এই টাকার একটি অংশ স্পিডবোটের নারী চালকদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। বাকি অংশ একটি ব্যাংক হিসাবে জমা করা হয়।
জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৬০ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এভাবে নতুন স্পিডবোট কেনা হবে। তবে অ্যাকশনএইড থেকে
নতুন আরও একটি অত্যাধুনিক স্পিডবোট কেনা হবে, যার আসন ১৬টি।

Facebook Comments