‘তারে জামিন পার’ নামের হিন্দি মুভিটির কথা মনে আছে? যারা দেখেছেন তারা অবশ্যই ডিসলেক্সিয়া শব্দটির সাথে পরিচিত। মুভির প্রধান চরিত্র ঈশান নামের ছেলেটি পড়া ও লেখার ক্ষেত্রে যে সমস্যায় পড়েছিল তা-ই হলো ডিসলেক্সিয়া। আমাদের দেশে অনেক শিশু এই সমস্যায় ভুগে থাকে। এটি একটি স্নায়ুগত সমস্যা যা জন্মগত ভাবেই অনেক শিশুর মধ্যে থাকে। এর সম্পর্কে কিছুটা ধারনা দেয়ার জন্যই এই লেখা।
ডিসলেক্সিয়া কি?
ডিসলেক্সিয়া (Dyslexia) বা স্পেসিফিক লার্নিং ডিজেএবিলিটি (শিখনমূলক অক্ষমতা) হলো এমন এক ধরনের সমস্যা, যা হলে শিশুর পড়তে অসুবিধা হয়। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ নিউরোলজিস্টের মতে, এটা শিশুদের একটা সমস্যা যেখানে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা ঠিক থাকা সত্ত্বেও তারা কোনো কিছু লেখা বা পড়ায় সমবয়সী অন্য শিশুদের মতো সক্ষম হয় না। বিকাশগত ডিসলেক্সিয়া প্রথমবার বর্ণিত হয়েছিল ১৮৮৬ সালে একটি ১৪ বছরের ছেলের ঘটনায়, যে পড়তে শিখছিল না। ১৯৬০ সালের পরেই এটি গবেষণা চিকিত্সার ক্ষেত্র থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে সরে এসেছিল, এবং ইউএসএ -তে ৮০ এর দশকে “পড়ার অক্ষমতা” শব্দটির দ্বারা ডিসলেক্সিয়া শব্দটিকে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল।
ডিসলেক্সিয়ার কারণ ও ধরন
আঘাতজনিত ডিসলেক্সিয়া: মস্তিস্কের একটি নির্দিষ্ট স্থান থাকে যেটি পড়ালেখার ক্ষমতা কন্ট্রোল করে। শিশুর জন্মের সময় অথবা অন্য কোনো কারণে মস্তিস্কের সেই স্থানে আঘাত পেলে ডিসলেক্সিয়া হতে পারে। তবে চিকিৎসা ব্যবস্থার অগ্রগতির সাথে সাথে বর্তমানে এ ধরনের ডিসলেক্সিয়া খুব একটা দেখা যায় না।
প্রাথমিক ডিসলেক্সিয়া: প্রাথমিক ডিসলেক্সিয়াতেই শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়। এ ক্ষেত্রে ব্রেইনের বাম দিকের একটি অংশ কোনো কারণ ছাড়াই ঠিকভাবে কাজ করে না। বয়স বাড়লেও ব্রেইনের ওই অংশ ঠিকভাবে কাজ করে না। ফলে বড় হয়েও এরা ঠিকমতো লিখতে, পড়তে ও বলতে পারে না। এ সমস্যা বংশ পরম্পরায় ছড়াতে পারে। মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
সেকেন্ডারি বা জন্মগত ডিসলেক্সিয়া: শিশু গর্ভে থাকা অবস্থায় হরমোনগত কারণে এ সমস্যা হতে পারে। শিশু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। এ ধরনের সমস্যা ছেলেদের ক্ষেত্রে বেশি হয়ে থাকে।
লক্ষণসমূহঃ
আমরা যেটা দেখি তার আকার-আকৃতি ব্রেইনে স্থায়ীভাবে গেথে যায়। সে কারণে চারপাশের জিনিসগুলো আলাদাভাবে চিনতে পারি। কাউকে না দেখেও শুধু তার কথা শুনে বলে দিতে পারি সেটা কার কণ্ঠস্বর। কিন্তু ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ব্রেইন এ ধরনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে ভালো স্কুল, ভালো শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করালেও এরা পড়াশোনায় পিছিয়ে যায়। বর্ণমালার অক্ষরগুলো ঠিকমতো চিনতে পারে না বা উল্টা-পাল্টা দেখে। এমনকি ক্লাসে বসে শত চেষ্টা সত্ত্বেও শিক্ষকের পড়া ঠিকমতো বুঝতে পারে না। এরা স্কুলে বোর্ড দেখে দেখে খাতায় লিখতে খুব অসুবিধা অনুভব করে। একটি প্রশ্ন করলে অনেক সময় উত্তর করতে সমর্থ হলেও এক সঙ্গে অনেক প্রশ্ন করলে এরা কোনোটিরই উত্তর দিতে পারে না। কানে তেমন সমস্যা না থাকলেও এরা কোনো কিছু শুনে মনে রাখতে পারে না। একটি বাক্য বলার সময় মাঝের কিছু শব্দ তারা ভুলে যায় অথবা হারিয়ে ফেলে। ফলে বাক্যের অর্থ এমন হয়ে যায় যে, অনেকের কাছে তা হাস্যকর মনে হয়। তারা জানে তারা কি বলতে চাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করে ফেলে ভিন্ন কিছু। যার কারণে এরা পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়ে। একসময় পরিবার তথা শিক্ষকদের রোষানলে পড়ে। ফলে তারা নিজেদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। সাধারনত শিশুরা ডান কিংবা বাম হাতে শক্তিশালী হলেও এরা দুই হাতে মোটামুটি সমান শক্তি প্রকাশ করে থাকে। যেহেতু সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে এই সমস্যাগুলো সারা জীবন থাকে, তাই বড় হলে সে বিষণ্নতায় ভোগে।
অথচ বুদ্ধির দিক থেকে এদের কোনো ঘাটতি থাকে না। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এসব শিশুর না আছে কোনো চোখে সমস্যা, না আছে কোনো কানে সমস্যা। এমনকি মানসিকভাবে এরা বিকারগ্রস্ত থাকে না।
যদি আপনার শিশু
– অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় দেরিতে কথা বলতে শেখে।
– দিক নির্দেশনা বুঝতে সমস্যা হয়। ডান ও বাম দিকের মধ্যে তফাত ধরতে পারে না।
– সাধারনত যে বয়সে জামার বোতাম লাগাতে এবং জুতার ফিতা বাঁধতে পারার কথা তা না পারে বা করতে সমস্যা হয়।
– অকারণেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।
– প্রতিটা শব্দ ধরে ধরে পড়ে কিন্তু মানে বুঝতে পারে না বা বুঝতে দেরি হয়।
– দাঁড়ি, কমা, প্রশ্নবোধক চিহ্ন ইত্যাদির মানে বুঝতে পারে না।
– কোনো কিছু বানান করে পড়তে তারা দুর্বলতা প্রকাশ করে।
– শুদ্ধ উচ্চারনে সমস্যা
– পড়া, দেখে বা শুনে লেখা সঠিকভাবে অন্যরা যত দ্রুত পারে, তত দ্রুত পারেনা। তাই তাদের লেখা অসুন্দর হয়। এক পৃষ্ঠায় একই শব্দ বিভিন্ন ভুল বানানে লেখে বা এক বানানের সাথে অন্য বানান মিলেনা।
– কখনো কখনো উল্টো বা বিভিন্ন প্যাটার্নে শব্দ লেখে।
– অনেক সময় পড়তে গিয়ে লেখা শব্দের জায়গায় বেশি চেনা অন্য শব্দ ব্যবহার করে।
– পড়তে পড়তে লাইন বাদ দিয়ে যায়। অনেক সময় নিজের থেকে শব্দে অতিরিক্ত অক্ষর যোগ করে দিতে পারে। আবার অনেক সময় বাদও দিতে পারে।
– পড়তে পড়তে অন্য দিকে তাকালে যে লাইনটা পড়ছিল সেটা আর খুঁজে পায় না।
– কোনো কিছুর সঙ্গে এরা তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। এমনকি মিউজিকের তালেও এরা শরীর দোলাতে পারে না।
এই সমস্যার পাশাপাশি এই শিশুদের আরো কিছু উপসর্গও থাকে। যেমনঃ
* সামষ্টিক কাজে অনগ্রসরতা এবং অমনোযোগ
* অতিরিক্ত লজ্জা ও একা থাকার প্রবনতা
* গতি ও অবস্থান নির্ণয়ে অসামন্জস্যতার কারনে খেলায় অপারদর্শিতা
* দিবাস্বপ্ন দেখার প্রবণতা
* প্রচণ্ড স্কুল-ভীতি
ওপরের লক্ষণগুলো যদি থাকে, তাহলে হতে পারে যে শিশুটি ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে বাড়তে থাকতে পারে। এমনটি হলে যথাশীঘ্র শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এবং সঠিক দিকনির্দেশনা মত চলতে হবে।
চিকিৎসা ও করনীয়ঃ
ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুর জন্য প্রথম চিকিৎসাই হলো তার সমস্যাকে শনাক্ত করা। প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগটি নির্ণয় করা বেশ কঠিন। মা-বাবা কিংবা ক্লাসের শিক্ষক রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরতে পারেন না। তবে মানসিক বিশেষজ্ঞ কিংবা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগটি সহজেই নির্ণয় করতে পারেন। শিশুর ডিসলেক্সিয়া থাকলে তা সাধারণত বোঝা যায় স্কুলে ভর্তি করার পর। তাই এ সময়ে শিশুর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখুন। এর চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত কোনো ওষুধ তেমন কার্যকরী ভুমিকা রাখতে সক্ষম হয় নি। ডিসলেক্সিয়ার কোনো নির্দিষ্ট চিকিত্সা হয় না। কবে কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করে শিশুদের দৈনন্দিন জীবন সহজ করে তোলা যেতে পারে।
– শিশুর ঠিক কোন জায়গায় সমস্যা তা বোঝার চেষ্টা করুন। সেই অনুযায়ী স্ট্র্যাটেজি ঠিক করুন।
– নির্দিষ্ট পড়ানোর স্টাইল ছেড়ে ইন্টারঅ্যাক্টিভ স্টাইলের আশ্রয় নিন। সম্ভব হলে কমপিউটারের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
– ডিসলেক্সিক শিশুরা যেন সহজে পড়াশোনা করতে পারে তার জন্য বড়দের আচরণ ঠিক রাখতে হবে। পড়াশোনা নিয়ে শিশুকে বেশি চাপ দেবেন না। আবার এত বেশি ছুট দেবেন যাতে আর পড়তেই না চায়।
– হোমওয়ার্ক একটানা না করে কিছুটা বিরতি দিয়ে করানো উচিত। কোনো পড়া ঠিকমতো করলে শিশুর প্রশংসা করুন।
– পড়ার সমস্যা কমাতে শিক্ষক-ছাত্র একসঙ্গে বসে পড়লে ভালো হয়। যেটা পড়া হবে সেটার মানে যদি শিক্ষক বুঝিয়ে দেয়, তাহলে বাচ্চার পড়তে সুবিধে হয়। দুজনকেই একসাথে শুরু করতে হবে, যাতে শিক্ষকের গলার আওয়াজ শিশুর কাছে সাপোর্টের কাজ করে। শিক্ষকের গলার আওয়াজ আস্তে আস্তে কমিয়ে দিতে হবে যেন শিশু একাই পড়তে পারে।
– একটানা ক্লাস না নিয়ে বিরতি দিয়ে ক্লাস করতে হবে।
– যেসব শিশুরা পড়তে পড়তে খেই হারিয়ে ফেলে তাদের আঙুল ব্যবহার করে পড়তে শেখানো যেতে পারে। এতে লাইন বাদ দেবার প্রবণতা কমে যাবে।
– অনেক সময় স্পিচ মাসল ঠিকমতো কাজ করে না বলে শিশু ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে না। অনেক ব্যায়াম আছে যেগুলো স্পিচ মাসল শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। শিশুকে এসব ব্যায়াম করান।
– ছোট ছোট খেলাও অনেক সময় উপকারী হয়। যেমন- শিশুর সাথে শব্দের পাজেল/ লেগো থেকে লুকানো শব্দ খুঁজে বের করার খেলা খেলুন।
ডিসলেক্সিক শিশু ও অভিভাবকের করণীয়ঃ
পৃথিবীতে সব শিশুই সমান ব্রেইন কিংবা মেধা নিয়ে আসে। এরপরও সে-ই ভালো ছাত্র/ছাত্রী হয় যে বেশি চর্চা করে। কিন্তু ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশু চর্চা করার ক্ষমতা হারায়। শিশুর এ সমস্যা কাটাতে মা-বাবার ভূমিকাই প্রধান। শিশুর আশপাশের লোকজনের সহানুভূতিশীল হওয়া জরুরি। প্রথমে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলুন। প্রয়োজনে বিষয়টি নিয়ে স্কুল শিক্ষকের সঙ্গেও কথা বলতে পারেন। তবে একজন চাইল্ড সাইকিয়াট্রিস্টের সহায়তা নিলে খুব ভালো হয়। শিশুকে তার ব্যর্থতার জন্য কোনোভাবেই গালমন্দ কিংবা মারধর করবেন না। পড়াশোনা না করার জন্য বকুনি শুনতে শুনতে হারিয়ে যায় ওদের ‘আমিও পারি’ বোধটা। তাই ‘ফাঁকিবাজ’রা এড়িয়ে চলতে শুরু করে ভালবাসার জিনিসও। সেখান থেকেই তৈরি হতে পারে ‘কনডাক্ট ডিসঅর্ডার’ বা আচরণের অসঙ্গতি। হয়ে উঠতে পারে আত্মহত্যাপ্রবণও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিসলেক্সিয়া অসুখ নয়। অক্ষমতা মাত্র। এই অক্ষমতা পুরোটা সারে না, তবে সচেতনতাই আসল। ফাঁকিবাজি না অন্য কিছু, তা বুঝতে হবে বাবা-মাকে, স্কুলকে, বিশেষত শিক্ষককে। ডিসলেক্সিকদের ‘অ্যাটেনশন স্প্যান’ খুব কম। তবে ডিসলেক্সিক বাচ্চারা খুব প্রতিভাবান হয়। তাদের খুবই ভাল চিন্তাশক্তি/কল্পনাশক্তি এবং কখনো কখনো ভাল গানিতিক প্রতিভা থাকে। বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে তাদের অসাধারন আগ্রহ ও পারদর্শিতা দেখা যায়। ওদের যে দিকে আগ্রহ সে দিকে উৎসাহ পেলে দারুণ উন্নতি করে। ‘স্পেশ্যাল লার্নিং’ ও ‘স্পেশ্যাল কেয়ার’ও এই সমস্যার বেশ খানিকটা সমাধান হতে পারে। অনেক সময়ই দেখা যায়, ওপেন স্কুল ব্যাপারটা ডিসলেক্সিকদের ক্ষেত্রে খুব খেটে যায়। কারণ, সেখানে পছন্দসই বিষয় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা থাকে। যা প্রচলিত কাঠামোয় নেই। তা ছাড়া উৎসাহ দিয়ে যেতে হবে ওদের ভাল লাগার বিষয়ে। সে দিকে বইতে দিলে সফল হয় ওরা। দেখা গিয়েছে, ওদের পিছনে লেগে থাকলে, অর্থাৎ সমস্যাটা বুঝে ওদের একটু সময় দিলে, সাহায্য করলে ওরা সফল হয়। সুতরাং শিশুর ডিসলেক্সিয়া থাকলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। দরকার ভালবাসা, উৎসাহ আর বোঝার মন। সমস্যা গুলো জন্মগত হলেও বিশেষ ভাবে দেখলে সেগুলো অনেকাংশে দুর করা যায়। আর তাদের গুণগুলো এগিয়ে নিতে পারলে মেধাবী কিছু মানুষ পাওয়া সম্ভব।
লিখেছেন- সিফাত মাহজাবিন,নিউট্রেশনিস্ট।