ডা. মারুফ রায়হান খান
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ হচ্ছে ডায়রিয়া। প্রতি বছর অনূর্ধ্ব -৫ বছরের শিশুদের ১০ ভাগই মারা যায় ডায়রিয়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বারবার পাতলা পায়খানা হওয়াই ডায়রিয়া।
কী হয় ডায়রিয়ার ফলে?
১. শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি ও ইলেক্ট্রোলাইটস (সোডিয়াম, পটাশিয়াম, বাইকার্বোনেট) বেরিয়ে যায় পাতলা পায়খানার মাধ্যমে। এর ফলে রোগী পানিশূন্যতায় এবং রক্তে ইলেক্ট্রো- লাইটসের অসামঞ্জস্যতায় ভোগে।
২. পাতলা পায়খানার মাধ্যমে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক বেরিয়ে যায়। যা হলে রোগীর আরোগ্য দীর্ঘায়িত হয়, আর তা শিশুকে পরবর্তীতেও ভোগায়।
৩. ডায়রিয়াতে শিশুর ওজন কমে যায়। কারণ: খাওয়া কমে যায় – পুষ্টি উপাদান শোষণ হওয়া কমে যায়। – শরীরে পুষ্টি উপাদানের চাহিদা বেড়ে যায়।
ডায়রিয়া কয় ধরনের?
৩ ধরনের। যথা :
১. একিউট ওয়াটারি ডায়রিয়া
২. পারসিসটেন্ট ডায়রিয়া
৩. ডিসেন্ট্রি।
এর প্রত্যেকটি নিয়েই আমরা সামনে আলোচনা করব ইন শা আল্লাহ।
একিউট ওয়াটারি ডায়রিয়া
যখন ডায়রিয়া ১৪ দিনের কম স্থায়ী হয় তখন তাকে একিউট ডায়রিয়া বলে। এক্ষেত্রে রোগী প্রতিদিন অনেকবার (৩ বার বা তারও বেশি) পাতলা পায়খানা করে। – এক্ষেত্রে পায়খানায় রক্ত থাকে না। – কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাথে বমি এবং সামান্য জ্বর থাকতে পারে।
কোন কোন জীবাণু দিয়ে এটি হয়ে থাকে?
১. রোটা ভাইরাস
২. ভিব্রিও কলেরি (ব্যাকটেরিয়া)
৩. ই. কোলাই (ব্যাকটেরিয়া)
শিশুর ডায়রিয়া
পানিশূন্যতার প্রকারভেদ ও মারাত্নক পানিশূন্যতারর চিকিৎসা একটি ডায়রিয়ার রোগীর কী কী যাচাই করা হয়?
১. পাতলা পায়খানা কতোবার হয়েছে?
২. পাতলা পায়খানা কতোদিন ধরে হচ্ছে?
৩. পায়খানার সাথে কি রক্ত যায়?
৪. বমি হয়েছে কি?
৫. প্রস্রাবের পরিমাণ কেমন?
৬. কী খাবার এবং পানীয় খেয়েছিল?
৭. সম্প্রতি কি এন্টিবায়োটিক বা অন্য কোনো ওষুধ খেয়েছিল?
৮. পরিবারে বা প্রতিবেশিদের মধ্যে কারও ডায়রিয়া বা ডায়রিয়াজনিত মৃত্যু হয়েছে?
৯. চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন : – পানিশূন্যতার কোনো চিহ্ন আছে কিনা – পেট ফুলে গেছে কিনা – মারাত্নক অপুষ্টির কোনো চিহ্ন আছে কিনা।
পানিশূন্যতার চিহ্নগুলো কী কী?
♣. যদি নিচের ৪টি চিহ্নের মধ্যে শিশুর দুটো বা তার বেশি চিহ্ন উপস্থিত থাকে, তবে শিশুর “মারাত্নক পানিশূন্যতা” দেখা দিয়েছে বলে জানতে হবে।
১. নেতিয়ে পড়া/ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
২. চোখ খুব ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া ৩. কোনো কিছু পান না করতে পারা অথবা পান করলেও খুব দুর্বলভাবে পান করা।
৪. ত্বক টান দিয়ে ছেড়ে দিলে তা খুবই ধীরে ধীরে আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া (২ সেকেণ্ড বা তারও বেশি সময়)।
♣. যদি নিচের ৪টি চিহ্নের মধ্যে শিশুর দুটো বা তার বেশি চিহ্ন উপস্থিত থাকে, তবে শিশুর “কিছু পানিশূন্যতা” দেখা দিয়েছে বলে জানতে হবে।
১. অস্থিরতা, অল্পতে বিরক্ত হয়ে যাওয়া। ২. চোখ ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া। ৩. খুব আগ্রহসহকারে যদি শিশু পান করে, যদি তৃষ্ণার্ত থাকে।৪. ত্বক টান দিয়ে ছেড়ে দিলে কিছুটা ধীরে ধীরে আগের জায়গায় ফিরে আসে।
♣. আর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত যেসব শিশুর “মারাত্নক পানিশূন্যতা” বা “কিছু পানিশূন্যতা”র ক্যাটাগোরিতে পড়ার পর্যাপ্ত চিহ্ন নেই তাদেরকে “পানিশূন্যতা নেই” ক্যাটাগোরিতে রাখা হয়।
একিউট ডায়রিয়ার চিকিৎসা
ক. যাদের “মারাত্নক পানিশূন্যতা” আছে
১. শিরাপথে কলেরা স্যালাইন/ রিংগার’স ল্যাকটেট দেওয়া হয়। যদি না থাকে তবে ডেক্সট্রোজ ইন নরমাল স্যালাইন অথবা নরমাল স্যালাইন দেওয়া হয়।
২. স্যালাইন দরকার হয় : ১০০ মিলিলিটার/কেজি বডি ওয়েট।
৩. শিশুর বয়স যদি ১২ মাসের কম হয় তাহলে ৩০ মিলিলিটার/কেজি বডি ওয়েট প্রথম এক ঘণ্টায় দেওয়া হয়। তারপর পরের ৭০ মিলিলিটার/কেজি বডি ওয়েট পরের ৫ ঘণ্টায় দেওয়া হয়। ৪. শিশুর বয়স যদি ১২ মাস বা তার বেশি হয় তাহলে ৩০ মিলিলিটার/কেজি বডি ওয়েট প্রথম আধা ঘণ্টায় দেওয়া হয়। তারপর পরের ৭০ মিলিলিটার/কেজি বডি ওয়েট পরের আড়াই ঘণ্টায় দেওয়া হয়।
৫. স্যালাইন চলার সময় বুকের দুধ ছাড়া বাকি সব খাবার বন্ধ রাখা হয়।
মনিটরিং
১৫-৩০ মিনিট পরপর শিশুকে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে যতোক্ষণ না পর্যন্ত শিশুর হাতে জোরালো রেডিয়াল পালস না পাওয়া যায়। – যখন হিসেব অনুযায়ী পুরো পরিমাণের স্যালাইন দেওয়া শেষ হয়ে যাবে, তখন শিশুকে
আবার যাচাই করতে হবে এবং
নিম্নোক্তভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে :
*১. যদি তখনও “মারাত্নক পানিশূন্যতা” থাকে, তবে আবার “মারাত্নক পানিশূন্যতা”র চিকিৎসা পূর্ববর্ণিত উপায়ে দিতে হবে।
*২. যদি “কিছু পানিশূন্যতা” থাকে, তবে শিরাপথে স্যালাইন বন্ধ করে মুখে খাবার স্যালাইন দেওয়া হয় ৪ ঘণ্টার জন্যে।
*৩. যদি কোনো পানিশূন্যতা না থাকে, তবে মা-কে প্রতিবার শিশুর পাতলা পায়খানা হবার পর মুখে খাবার স্যালাইন খাওয়াতে বলা হয়।
খ. কিছু পানিশূন্যতা ও কিছু পানিশূন্যতা নেই
এমন ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসা, ডায়রিয়া পরবর্তী যত্ন যাদের “কিছু পানিশূন্যতা”র চিহ্ন আছে তাদের চিকিৎসা :
১. মুখে খাবার স্যালাইন খেতে দেওয়া হয় হিসেব অনুযায়ী।
২. স্যালাইনের পরিমাণ : ৭৫ মিলিলিটার/ কেজি বডি ওয়েট।
৩. সময় : ৪ ঘণ্টা
৪. এ সময় বুকের দুধ ছাড়া বাকি সব খাবার বন্ধ রাখা হয়।
মনিটরিং
৪ ঘণ্টা পর শিশুকে পুনরায় যাচাই করা হয়।
তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় :
*১. যদি কোনো পানিশূন্যতার চিহ্ন না থাকে, মা-কে প্রতিবার শিশুর পাতলা পায়খানা হবার পর মুখে খাবার স্যালাইন খাওয়াতে বলা হয়।
*২. যদি “কিছু পানিশূন্যতা”র চিহ্ন থাকে, তবে আবার ৪ ঘণ্টার জন্যে উপরোক্তভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
*৩. যদি “মারাত্নক পানিশূন্যতা” এর চিহ্ন থাকে, তবে শিরা পথে স্যালাইন দেওয়া হয়।
গ. যাদের পানিশূন্যতার চিহ্ন নেই তাদের ক্ষেত্রে
*১. এ চিকিৎসা শিশু বাসায় নিয়ে থাকে, তাই একে “হোম ট্রিটমেন্ট” বলা হয়।
*২. মুখে খাবার স্যালাইন, চিড়া পানি, ভাতের মাড়, লাচ্ছি ইত্যাদি খেতে বলা হয়।
*৩. প্রতিবার পাতলা পায়খানা হবার পর যদি শিশুর বয়স ২ বছরের কম হয় তাহলে ৫০-১০০ মিলিলিটার তরল খাবে। আর যদি শিশুর বয়স ২ বছর বা তার বেশি হয় তবে ১০০-২০০ মিলি তরল খাবে।
প্রভাষক
ফার্মাকোলজি বিভাগ
এনাম মেডিকেল কলেজ