তানজীল আহমদ সিদ্দিকী
আলতানগর প্রাথমিক বিদ্যালয়। কদিন আগেও গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে স্কুলটার প্রত্যেকটা ঘর মুখর হয়ে উঠতো। অ আ ক খ ধ্বনি উড়ে উড়ে বেড়াতো স্কুলের প্রতিটি ঘরে। আর এখন স্কুলের প্রতিটি ইটে পাক খায় হানাদারদের দ্বারা নির্যাতিত মানুষগুলোর মরণ আর্তনাদ। জানালার কপাটে ঠুকে মরে ধর্ষিতাদের নিস্ফল কান্না। দেয়ালে লেপ্টে যায় হতভাগীদের অসহায় হাতের ছাপ।
দীপককে কখন ওরা স্কুলের একটা ঘরে বেঁধে রেখে গেছে টের পায়নি সে। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলো একটার অন্ধকার রুমে সিলিং থেকে ঝুলে থাকা দুটো দড়িতে হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দীপক প্রথমে ভেবছিলো এ ঘরে সে একা, পরে অন্ধকারে চোখ একটু সয়ে আসতে বুঝতে পারলো তার পাশে আরেক জন একইভাবে বাঁধা। হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো দীপকের। প্রচন্ড দূর্বল লাগছে। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো দীপকের। তার ভুলের জন্য পুরো মিশনটাই বোধহয় ভেস্তে যেতে যাচ্ছে। এমন সময় পাশের মানুষটা খুব মৃদু গলায় বলে উঠলো, ‘পানি! পানি! কেউ আমাকে একটু পানি খেতে দাও! ‘ কণ্ঠস্বরটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। দীপক ভালো করে কান পাতলো। এ তো তপেশ মাস্টারের গলা!
‘ মাস্টার সাব, ও মাস্টার সাব! ‘
তপেশ মাস্টার প্রথমে বুঝতে পারলেন না কোথা থেকে আসছে কণ্ঠটা। এই পিশাচের দঙ্গলে কে-ই বা তাকে এত সম্মানের সহিত ডাকবে! তবে সাড়া দিলেন!
‘ কে বলছো? তুমি কি এ ঘরেই আছো? ‘
‘ আমি দীপক, মাস্টার সাব! আপনার পাশেই বাঁন্ধা আছি। আপনার এই অবস্থা ক্যান, স্যার? ‘
তপেশ মাস্টার অতি কষ্ট করে একটু হাসলেন। সেই হাসিতে লেগে আছে ব্যথাহত হৃদয়ের উথলে ওঠা আবেগের পরশ। তারপর অসহায় গলায় বললেন, ‘ মিলিটারিরা ধরে নিয়ে এসেছে, নজর আলির নির্দেশে। আমার স্ত্রী, বোন এদের আমি রক্ষা করতে পারিনি। জানিও না এমুহুর্তে কি অবস্থায় আছে ওরা। তোমাকে ধরেছে কেন? ‘ তার চোখ খানিক উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ‘ তুমি মুক্তিবাহিনীর লোক? ‘
দীপক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘ জে, মাস্টার সাব। ‘
হঠাৎ করে ভারী কাঠের দরজাটা খুলে গেলো। নজর আলি আর মেজর ওয়াসিমসহ কয়েকজন মিলিটারি ঘরে ঢুকলো। নজর আলির হাতে হারিকেন। সেই আলোয় পুরো ঘর আলোকিত হয়ে উঠলো। দীপক খেয়াল করলো তপেশ মাস্টারের শরীরের সর্বত্র অত্যাচারের চিহ্ন। বিভিন্ন জায়গায় চামড়া ছিলে ফেলা হয়েছে। রক্ত ঝরছে সেসব ক্ষত থেকে। আসন্ন অত্যাচারের কথা চিন্তা করে দীপকের পুরো শরীর খানিক কেঁপে উঠলো। মেজর ওয়াসিম খান সোজা এগিয়ে আসলেন দীপকের সামনে। তার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ তুম মুক্তি হ্যায়? ‘
পাশ থেকে তপেশ মাস্টার চিৎকার করে উঠলেন, ‘ কিচ্ছু বলো না, দীপক। একদম কিচ্ছু বলো না। পশুগুলো তোমা…’ কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি। নজর আলি সজোরে একটা চড় কষিয়ে দিলেন তিনি। তপেশ মাস্টারের চুলের মুঠি ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ‘ একদম চুপ, শালা মালাউন। তোর বউটারে তো সৈন্যরা ভোগ কইরা জঙ্গলে ফালায়ে রাইখা আসছে। আর তোর বোইনের মজা লুটসেন আমাগো মেজর। আর একটা কথা যদি কস, তাইলে তোর বউয়ের কাছে তোরে আর তোর বইনরে একলগে পাঠায় দিমু। ‘
নজর আলির কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন তপেশ মাস্টার। তার স্ত্রী আর বেঁচে নেই! তার অনাগত সন্তানও আর বেঁচে নেই। ছোট বোনটার ইজ্জত লুটে নিয়েছে পশুগুলো। আর কি লাভ বেঁচে থেকে! হতভাগিনী বোনটাকে সাথে নিয়ে মরে গেলেই বোধহয় সব জ্বালা জুড়িয়ে যায়! ফিসফিস করে শুধু বললেন, ‘ মেরে ফেল আমাকে। ‘
মেজর আবার জিজ্ঞেস করলেন দীপককে, ‘ তুম মুক্তি হ্যায়? ‘
হ্যাঁ না যা-ই বলুক পরিণতি কি হতে পারে জানা আছে দীপকের। তাই ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো কোনভাবেই সহযোগিতা করবে না। পিশাচদের সাথে কোন আপোস করা যাবে না। মুখ ভর্তি থুতু ছুঁড়ে মারলো সে মেজরের দিকে। মেজর মুখ খারাপ গাল দিয়ে উঠে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে সজোরে চড় মারলেন দীপককে । এমন সময়ে হঠাৎ বাইরে থেকে প্রচন্ড গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে এলো। দুম করে গ্রেনেডও ফুটলো একটা। ঘরে উপস্থিত সকলে চমকে উঠলো। এক পাক সৈন্য ছুটতে ছুটতে এসে জানালো মুক্তিরা এট্যাক করেছে এবং সংখ্যায় মনে হচ্ছে বেশ ভারী ওরা! দীপকের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আসাদ ভাইরা এসে পড়েছেন! দীপক বিজয়ী ভঙ্গিমায় হেসে মেজরকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘ এবার কোথায় পালাবি? ‘ মেজর সৈন্যদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর দীপকের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে নজর আলিকে সাথে নিয়ে নিজেও বেরিয়ে গেলেন। দীপকের চোখ তখন জ্বলছে। ক্রোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। আজ পিশাচ বধ হবে। বহুদিন পর আলতানগরের আকাশে আবার স্বাধীন সূর্য উঠবে।
শিবু আর আসাদ যখন দীপকের বাড়িতে পৌঁছেছিলো তখন দীপকের মা-কে তারা বাড়ির উঠোনে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়েছিলো। জ্ঞান ফেরানোর পর তিনি কাঁদতে কাঁদতে তাদের জানান যে মিলিটারিরা দীপককে ধরে নিয়ে গেছে। তারা তারপর সিদ্ধান্ত নেয় যে ওপারে ফিরে গিয়ে কমান্ডারকে জানানো যাবে। তারপর সম্ভব হলে একটা রেসকিউ অপারেশন চালাবে। পরবর্তীতে দীপকের মা-কে শান্ত করে খেয়াঘাটে পৌঁছে তারা দেখতে পায় তাদের পুরো গেরিলা দলটা খেয়াঘাটে অবস্থান নিয়ে আছে। কমান্ডার সাদেকও চলে এসেছেন। আসাদ আর শিবু অবাক হয়ে কমান্ডারের কাছে জানতে চেয়েছিলো – দলের একজন যোদ্ধার জন্য কমান্ডার এতবড় একটা ঝুঁকি নিলেন? কমান্ডার মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘ দেশটারে বাঁচাইতেই তো আমরা বেবাক্কে এক হইসি। ধইরা নাও দীপকই দেশ। কি? বাঁচাইবা না নিজের দেশরে? ‘ আসাদ অবাক তাকিয়ে ছিলো। কমান্ডারকে সবাইকে ডেকে পুরো মিশনটা বুঝিয়ে বললেন। চারদিক থেকে স্কুলটা ঘিরে ধরতে হবে। তারপর একসাথে সব দিক থেকে ফায়ারিং শুরু হবে।
প্ল্যান অনুযায়ী কমান্ডারের সাদেকের নেতৃত্বে গেরিলা দলের সবাই স্কুলের চারদিকে অবস্থান নিয়ে নেয়। আসাদ, শিবু সাথে আরো কয়েকজন অবস্থান নেয় স্কুলের সামনের দিকে। স্কুলের সামনে পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকা কোন পাক সৈন্য কিচ্ছুটি টের পায়নি। তারপরই কমান্ডারের নির্দেশে শুরু হয়ে যায় গুলি বর্ষণ। স্টেনগান আর থ্রি নট থ্রি রাইফেলের একটানা গুলিবর্ষণে পুরো আলতানগর কেঁপে উঠলো। স্কুলের ভেতরে তখন মেজর দীপককে ইন্টারোগেট করছেন। পাক সৈন্যরা হামলার প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিতেই বেশ হিমশিম খেয়ে গেলো। তিন জন সৈন্য গোলাগুলি শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই লুটিয়ে পড়লো। বাকি সৈন্যরা ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। কাভার নিয়ে ওরাও পালটা গুলি করতে লাগলো। পুরোদমে শুরু হয়ে গেলো এক মরণপণ লড়াই। গেরিলা দলটা জীবন বাজি রেখে লড়ছে আলতানগরকে হানাদারমুক্ত করবে বলে। আর পাক বাহিনী দাঁতে দাঁতে চেপে লড়ে যাচ্ছে এই অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিলিটারি ঘাঁটির দখল রাখবে বলে। দুই পক্ষই সংখ্যায় ভারি। যদিও পাক বাহিনীর হাতে আছে একটা মেশিনগান। স্কুলের বাউন্ডারি ঘেঁষেই বসানো হয়েছে সেটি। অনবরত গুলি বর্ষিত হচ্ছে তা থেকে। ইতিমধ্যেই দুজন গেরিলা সেই মেশিনগানের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। কমান্ডার সাদিক সবাইকে খানিক পিছিয়ে যেতে বললেন। মেশিনগানটা কব্জা করতে না পারলে ক্যাম্পের দিকে আগানো সম্ভব না। বাঁশঝাঁড়ে অবস্থান নিয়ে থাকা কমান্ডারের পাশেই ছিলো শিবু। সে বলে উঠলো, ‘ আমি দখল নিমু মেশিনগানের। ‘ কমান্ডার অবাক হয়ে বললেন, ‘ কি কইরা? ‘
এই প্রথম শিবুকে হাসতে দেখলেন কমান্ডার। দু হাতে দুটো গ্রেনেড নিয়ে শিবু বললো, ‘ এইগুলান দিয়া। আপনেরা শুধু আমারে কাভার দেন। ‘ কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই শিবু বাঁশঝাড় থেকে বেরিয়ে এলো। আঁকাবাঁকা করে দৌড় দিলো স্কুলের দিকে, ঠিক যেখানে মেশিনগানটার অবস্থান। কমান্ডার চিৎকার করে সবাইকে নির্দেশ দিলেন শিবুকে কাভার দিতে। সবাই একযোগে গুলি শুরু করলো। স্টেনগানের কড়কড় আওয়াজে কান পাতা দায়। ওদিক থেকে চাইনিজ এসএসজি দিয়ে পাক বাহিনীও সমানে জবাব দিয়ে যাচ্ছে। আর সেই নরকের ভেতর দিয়ে শিবু এঁকেবেঁকে দৌড়ে যাচ্ছে। গুলির নহর ছুটে যাচ্ছে তার পাশ দিয়ে। তবু একটা গুলিও স্পর্শ করছে না তাকে। যেন অসম সাহসী মৃত্যুভয়হীন এই মানুষটাকে পরম শ্রদ্ধায় পথ করে দিচ্ছে গুলিগুলো। মেশিনগানের সামনে বসে গুলি রিলোড করতে পাক সৈন্যটা অবাক হয়ে দেখলো এক বাঙ্গাল দু হাতে দুটো গ্রেনেড নিয়ে ঠিক তার দিকেই ছুটে আসছে। মেশিনগানের গুলি রিলোডিং ফেলে সে তার রাইফেলটা হাতে তুলে নিলো এবং সাথে সাথেই গুলি করে দিলো। তবে তার আগেই ‘ ও মা, তোর লাইগা ‘ চিৎকার দিয়ে শিবু একটা গ্রেনেড ছুঁড়ে দিয়েছে মেশিনগানের দিকে! বিকট আওয়াজ করে দুটো গ্রেনেড একসাথে ফুটলো। মেশিনগান গানার আর তার মেশিনগান টুকরো টুকরো হয়ে গেলো মুহুর্তে। অসম সাহসী শিবুর শরীরও টুকরো হয়ে মিশে গেলো তার বাংলা মায়ের শরীরের সাথে। সাথে সাথে কমান্ডার সাদেক চিৎকার করে সবাইকে আগে বাড়তে বললেন। ক্যাম্পের চারদিক থেকে যোদ্ধারা গুলি করতে করতে এগিয়ে আসতে লাগলো। মেশিনগানটা উড়ে যেতে দেখেই পাক সৈন্যদের সাহস উবে যেতে শুরু করেছিলো, চারদিক থেকে গেরিলাদের এভাবে ছুটে আসতে দেখে অবশিষ্ট সাহসটুকুও আর রইলো না। নির্দিষ্ট কোন টার্গেট ভুলে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে লাগলো। ফলস্বরুপ বেশিরভাগ গুলিই যোদ্ধাদের আশপাশ দিয়ে চলে যেতে লাগলো। একটাসময় এসে পাক সৈন্যদের আর কেউই বেঁচে রইলো না ক্যাম্পটার দখল বজায় রাখার জন্যে। ভেতরে যারা ছিলো তারা সবাই মাথার উপরে হাত তুলে বেরিয়ে এলো। কমান্ডার সাদিক এগিয়ে আসলেন সামনে। সাত-আট সিপাহীকে সাথে নিয়ে মেজর ওয়াসিম খান সাদিকের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। তাদেরকে কড়া পাহারায় রেখে কমান্ডার কয়েকজনকে সাথে নিয়ে স্কুলের ভেতরে ঢুকলেন। একটা ঘরের দরজা খোলা দেখে ভেতরে ঢুকলেন। তপেশ মাস্টার আর দীপককে এ ঘরেই বেঁধে রাখা হয়েছে। কমান্ডার তাড়াতাড়ি দুজনের বাঁধন খুলে দিলেন। বাঁধন খুলে দিতেই তপেশ মাস্টার মূর্ছা গিয়ে কমান্ডারের শরীরের উপর ঢলে পড়লেন। কমান্ডার আস্তে করে তাকে মেঝেতে শুইয়ে দিলেন। তারপর তিনি দীপকের বাঁধন খুলে তাকে বাইরে নিয়ে এলেন। দীপককে দেখে আসাদসহ অনেকে ছুটে এলো। আসাদ উদ্বিগ্ন স্বরে দীপককে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ দীপক, ঠিক আসো তুমি? পশুগুলান মারে নাই তো? ‘ দীপক ক্লান্ত স্বরে বললো, ‘ আমি ভালা আছি, আসাদ ভাই। আপনেরা মাস্টার সাহেবরে দেখেন। ‘ কমান্ডারের মনে পড়লো তিনি মাস্টারকে ঘরে রেখে এসেছেন। সাথে সাথে তিনি একজনকে নির্দেশ দিয়ে দিলেন মাস্টার-কে যেন বাইরে নিয়ে আসা হয়। ততক্ষণে স্কুলের প্রত্যেকটি ঘরের দরজা খুলে বন্দিদের বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। সবই যুবতী মেয়ে। তাদেরকে দিনের পর দিন এখানে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে। গায়ে একটা সুতো পর্যন্ত ছিলো না কারো। উপস্থিত গেরিলা দলের প্রত্যেকে তাদের নিজেদের শার্ট-গেঞ্জি খুলে তাদেরকে ঢেকে দিয়েছে। মানসিক আর শারীরিক অত্যাচার হাঁটার শক্তি পর্যন্ত নিয়ে নিয়েছে তাদের। দুজন তাদেরকে নিয়ে গ্রামের দিকে আগালো। আলতানগত যে শত্রুমুক্ত হয়ে গেছে, গ্রামবাসীকে সেকথা তারা-ই জানিয়ে দেবে।
তপেশ মাস্টারকে ধরে ধরে যখন স্কুলঘরের বাইরে নিয়ে আসলো, তিনি তার বোনের খোঁজ জানতে চাইলেন। কমান্ডার সাদিক গম্ভীর মুখে বললেন, ‘ মনডারে শক্ত করেন মাস্টার। ‘ কমান্ডারের কথা শুনে তপেশ মাস্টার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। এমন সময় ভেতর থেকে দুজন মুক্তিযোদ্ধা একটি মেয়ের লাশ ধরাধরি করে নিয়ে এলো। তারা সেই লাশটা পরম যত্নে শুইয়ে দিলো বারান্দার মেঝেতে। তপেশ মাস্টার এগিয়ে আসলেন। এ যে তার বোনেরই লাশ। তিনি আস্তে করে বসে পড়লেন তার বোনের পাশে। তারপর শান্ত গলায় কমান্ডারের কাছে জানতে চাইলেন, ‘ কিভাবে? ‘ কমান্ডার ধরা গলায় বললেন, ‘ পরনের শাড়ি দিয়া। পশুগুলোর অমানুষিক অত্যাচার আর নিতা পারেনি বেচারি। ‘ কমান্ডারের কথা শোনার পর তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তপেশ মাস্টার শান্তভাবে তার বোনের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। কমান্ডার আর দাঁড়াতে পারলেন সেখানে। আস্তে করে সরে আসলেন। মাটিতে হাঁটু গেড়ে মাথায় হাত দিয়ে বসা আত্মসমর্পণকারী পাক সৈন্যদের দিকে এগিয়ে এলেন। মেজর ওয়াসিম খানের সামনে এসে ডাক দিলেন তার এক সহযোদ্ধা-কে। শিক্ষিত লোক তিনি। শহরের কলেজে শিক্ষকতা করতেন, যুদ্ধের দামাম বাজতেই দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে অস্ত্র কাঁধে নেমে পড়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। কমান্ডার তার হয়ে মেজরের সাথে কথা বলতে অনুরোধ করলেন তাকে।
তিনি কমান্ডারের কথা মতো মেজরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ ডু ইউ ফিল গিলটি ফর হোয়াট ইউ হ্যাভ ডান, মেজর? ‘
মেজর ঠান্ডা গলায় জবাব দিলেন, ‘ নো। বাট আই রিপেন্ট ওয়ান থিংগ। ‘
ভদ্রলোক তার মাথায় চেপে বসা রাগটা কোনরকমে ঠেলে সরিয়ে রেখে জানতে চাইলেন, ‘ হোয়াট? ‘
মেজর কুৎসিত একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘ ইফ আই কুড ফাক মোর ওব ইওর গার্লস! ‘ আর সহ্য করতে পারলেন সেই শিক্ষক। অন্তরের সব ঘৃণা এক করে হাতের মুঠোয় এনে সজোরে এক ঘুষি মেরে বসলেন মেজরকে। মেজরের নাক দিয়ে রক্তের ফোয়ারা ছুটলো। কমান্ডার তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে সরিয়ে নিয়ে গেলেন ভদ্রলোককে।
ভোর হবার খানিক আগে, কমান্ডার সাদিকের আদেশে মেজর ওয়াসিমকে স্কুলের পেছনে নিয়ে গিয়ে একটা বড় আমগাছের সাথে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাকি সৈন্যদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটকে রাখা হয় স্কুলের একটা ঘরে। পরে সুযোগমতো অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হবে। পরিবেশ একটু শান্ত হতেই সবার মনে পড়লো নজর আলির কথা! আশেপাশের দশ-বারোটা গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত রাজাকারটা কোন ফাঁকে যেন পালিয়ে গেছে। কমান্ডার সাদিকের নেতৃত্বে গেরিল দলের একাংশ নজর মেম্বারের বাড়িতে পৌঁছুলো। কমান্ডার ঘরের বাইরে থেকে জোরে ডাক দিলেন, ‘ নজর আলি! নজর আলি, তুমি বাইর হয়া আহো। আলতানগরে স্বাধীন মাটিতে আইজ তোমার বিচার হইবো। ‘ খানিকক্ষণ পর সদর দরজা খুলে গেলো। জোহরা বেগম বেরিয়ে এলেন ভেতর থেকে। ঘোমটার আড়াল থেকে আশ্চর্য শান্ত গলায় তিনি বললেন, ‘ তিনি বাড়িতে নাই। ‘ কমান্ডার একটু রেগেই বললেন, ‘ অবশ্যই সে বাড়িতে আছে। বাইর হইতে কন তারে। ‘
জোহরা বেগম বললেন, ‘ তিনি গোয়ালঘরে আছেন। যান। ‘
কমান্ডার কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলেন এই মহিয়সী নারীর দিকে। তারপর তার সহযোদ্ধাদের আদেশ দিলেন নজর আলিকে ধরে আনার জন্যে। কিছুক্ষণ বাদেই তারা নজর আলি-কে টানতে টানতে নিয়ে এলো। নজর আলির দুচোখে মৃত্যুভয় স্পষ্ট। কমান্ডার ঘৃণাভরে কণ্ঠে বললেন, ‘ উপরে বিচার করবেন আল্লাহ, আর নিচে তোমার বিচার করবো এই আলতাগরের মানষে, যাগোর লগে বেঈমানি করসো তুমি। ‘ কমান্ডারের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা নজর আলিকে তুলে দেয় ক্রোধের আগুনে জ্বলতে থাকা গ্রামবাসীদের হাতে। দা, বটি, কুড়াল কি দিয়ে তারা আঘাত করেনি নজর আলিকে! শেষপর্যন্ত যখন গ্রামবাসীদের ক্রোধের আগুন নিভলো, তখন নজর আলির শরীরটা একদলা মাংসপিন্ড ছাড়া আর কিছুই না। ততক্ষণে চারপাশ আলো হয়ে গেছে। গেরিলা দলটা স্কুলটাকে তাদের অস্থায়ী ঘাঁটি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মুসেগুল থেকে এসে যদি হানাদাররা আক্রমণ করে, তাই শক্ত অবস্থান নিতে হবে তাদের। অনেক রক্ত ঝরেছে আলতানগর মুক্ত করতে। সেই রক্তের প্রতিটি ফোঁটার সম্মান তাদের বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।
আজ অনেকদিন পর আলতানগরের আকাশে মেঘের ভেলা সরে গিয়ে ঝকঝকে লাল সূর্য উঠেছে। সেই চোখ ধাঁধানো আলোয় একজন নিঃসঙ্গ মানুষ একা বসে আছে নদীর ধারে। মানুষটা তপেশ মাস্টার। নদীর ওপারে দৃষ্টি তার। কিংবা শুধু চোখটাই সেখানে ফেরানো, দৃষ্টি নেই তাতে। সূর্য পরম ভালোবাসায় তার পবিত্র আলো বুলিয়ে দিতে লাগলো মানুষটার সারা গায়ে। সব গেছে তার, শুধু প্রাণটা আছে। ঠিক যেন এই অভাগা দেশটার মতো। সব যাচ্ছে তার, শুধু ধুকপুক করা প্রাণটা আছে। একদিন এই প্রাণ থেকে আবার সব হবে। নকূল বাউলরা আবার এই আলতানগরের পথে হেঁটে বেড়াবে। শিবুরা আবার পরম ভালোবাসায় তার দেশমায়ের জন্য জীবন বাজি রাখবে। তপেশ মাস্টারের হতভাগিনী বোনটার মতো ষোড়শীরা আবার আলতানগরের পথে হাসতে হাসতে ছুটে বেড়াবে। ঝড়ের দিন শেষ হয়েছে। এখন প্রতিদিন সূর্য উঠবে, উঠবেই উঠবে।
এইচ এস সি শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম