তানজীল আহমদ সিদ্দিকী
যে রাতে মেজর ওয়াসিম খানের নির্দেশে নকূল বাউলকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, তার পর চার চারটে মাস পেরিয়ে গেছে। আলতানগরের পরিবেশ আর আগের মতো নেই। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখন আর ক্ষেতের আইল জুড়ে ঘুড়ি হাতে উড়ে বেড়ায় না। জমির উদ্দিনের বাড়ির উঠোনে এখন আর মার্বেল খেলার আসর জমে না। রাতের বেলা ছোট বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে গেলে মায়েদের আর বর্গির গল্প করতে হয় না, উড়ে এসে জুড়ে বসা হায়েনার দলকে এখন তারা ভালোভাবেই চেনে। আজকাল মাগরিবের আজান পড়ে গেলে সে-ই যে সবাই ঘরে ঢোকে, বিশেষ কোন প্রয়োজন না পড়লে ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ বের হয় না। মড়ক লাগা গ্রামে যেমন চারদিক সুনসান থাকে, আলতানগরের অবস্থাও এখন তেমনি। মড়ক এখানেও লেগেছে, আতংকের মড়ক।
নজর আলির পরামর্শ মতো গ্রামের স্কুলেই মিলিটারিরা ক্যাম্প বসিয়েছে। আশপাশের দশ-বারোটা গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্যাম্প এটাই। মুসেগুল থেকে জীপভর্তি সৈন্য এনে এখানে মোতায়েন করা হয়েছে। তাদের অত্যাচারে গ্রামবাসীর জীবন বাঁচানো দায় হয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে মশামাছির মতো মেরে ফেলা হয়। মানুষ মারতে তাদের কোন অজুহাতের প্রয়োজন পড়ে না তাদের। দুদিন আগে দুজন মিলিটারি ক্ষেতের আইল দিয়ে হাঁটছিলো। সেখানে তাদের একটা মোটাসোটা ছাগী চোখে পড়ে। ক্ষেতে গাঁড়া খুঁটিতে বাঁধা ছিলো ওটা। মিলিটারি দুজন দড়ি খুলে সেই ছাগল নিয়ে হাঁটা দেয় ক্যাম্পের দিকে। এমন সময় ছাগলের মালিক দৌঁড়ে এসেছিলো। মিলিটারি দুজনের পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো ছাগীটা না নিয়ে যেতে, গরীব মানুষ ও। অসহায় মানুষটাকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে ক্যাম্পে নিয়ে গেছিলো ওরা। পরদিন সকালে, গ্রামবাসীরা রাস্তার একধারে খুঁজে পায় হতভাগ্য লোকটার মৃতদেহ। নকূল বাউলের মতোই ফেঁড়ে ফেলা হয়েছে দেহটা। টুঁ শব্দটি করতে পারেনি কেউ। হাতে দা-কাস্তে নিয়েও নিশ্চল দাঁড়িয়ে ছিলো তারা। রাইফেল কাঁধে পিশাচের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর হিম্মত তাদের নেই। দুমাস আগে এই মানুষগুলোই তপেশ মাস্টারের বাড়িতে বসে শেখ সাহেবের কণ্ঠে যখন শুনেছিলো – ” এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ” তখন চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলো। কোদাল আর কাস্তে হাতে মিলিটারির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা ভেবেছিলো। সব স্বপ্নের আগুন নিভে গেছে। পরিবার পরিজন নিয়ে একেকটা দিন বেঁচে থাকাটাই যখন সংগ্রাম, স্বাধীনতার স্বপ্ন তখন কুহকিনীর মিথ্যে আশ্বাস।
আজকাল নজর আলির কাজের অন্ত নেই। পিস কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তার কাঁধে এখন প্রচুর দায়িত্ব। মেজর সাহেবের খেদমতের দায়িত্ব তিনি নিজ হাতে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। মেজর সাহেবের প্রতিবেলার খানাদানা থেকে শুরু করে অবসর সময়ে বিনোদনের ব্যবস্থা পর্যন্ত সবকিছু তিনি নিজে দেখভাল করেন। মেজর সাহেব বহুদিন ধরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। জোয়ান মানুষ, শরীরে যে মাঝেমধ্যে বেচাইন করে সে তিনি ভালোভাবেই বোঝেন। তাই অবসর সময়ে একটু আধটু বিনোদনের জন্য মাঝেমধ্যেই ক্যাম্পে মেয়ে পাঠান তিনি। গ্রামে কোন কোন ঘরে সুন্দরী যুবতী আছে সব তার জানা। সেসব ঘর থেকেই যুবতী মেয়েদের জোর করে তুলে আনেন তিনি। সৈন্যরাই টেনে হিঁচড়ে বের করে আনে, তিনি শুধু প্রয়োজনীয় নির্দেশটুকু দেন। এই তো সেদিনই জামাল নাপিতের বড় মেয়েটাকে তুলে আনতে গেছিলেন। চোখ ধাঁধানো রূপ মেয়ের। মেয়েটাকে কায়দামতো পেলে তিনিই ভোগ করতেন, মেজরের জন্য নিয়ে যেতেন না। সৈন্যরা যখন টেনে হিঁচড়ে বের করছিলো মেয়েটাকে, জামাল নাপিতের বৌটা দা হাতে ছুটে এসেছিলো তার দিকে। আরেকটু হলেই ঘাড় থেকে তার মাথাটা নেমে যেতো যদিনা এক সিপাহী মহিলাকে গুলি না করতো। নজর আলি মেয়েটাকে সেদিন তার মায়ের লাশের উপর দিয়ে টেনে হিঁচড়ে এনে ক্যাম্পের একটি ঘরে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। পরে শুনেছিলেন শুধু মেজর না, ক্যাম্পের প্রায় সব সৈন্যই সেদিন রাতটা সেই ঘরে কাটিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত মেয়েটার পরিণতি কি হয়েছে সেটা জানা নেই তার, জানার ইচ্ছেও নেই। এমন কত গণিমতের মাল আসবে আর যাবে!
শেষ বিকেল। সূর্য বিদায় নেবার আগে তার শেষ রশ্মিটুকু অকাতরে বিলাচ্ছে। বাড়ির উঠোনে সেই রশ্মিগুলো কানামাছি খেলছে। তপেশ মাস্টার জানালা দিয়ে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছেন। বয়স তার চল্লিশের উপর। শান্ত সৌম্য চেহারা। জুলফির গোড়ায় খানিক পাকা চুল ছাড়া বয়সের চিহ্নমাত্র পাওয়া যায় না। তবে এ কদিনে স্বাস্থ্যের বেশ অবনতি ঘটেছে তার। আর হবে নাই বা কেন! মাত্র কয়েক মাসে সবই কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে। মূর্খ পশুগুলো তার স্কুলটা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে তারা ক্যাম্প বসিয়েছে। যে ঘরগুলোতে বসে বাচ্চারা অ আ শিখতো, সেই ঘরগুলোতে এখন মানুষ জবাই হয়। মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়। সব দেখে শুনেও কিছু করতে না পারার অক্ষমতার গ্লানিতে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন তিনি। কদিন ধরে কানাঘোষা শুনছেন দেশের অনেক জায়গায় নাকি পাক হানাদারদের সাথে খন্ড খন্ড যুদ্ধ হচ্ছে। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষরাই এই যুদ্ধে শামিল হয়েছে। আশেপাশের গ্রামের অনেকেই নাকি ইন্ডিয়ায় পালিয়ে গেছে। সেখান থেকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে আবার দেশে ঢুকবে। তারও ইচ্ছে হয় সেই সংগ্রামীদের সাথে যোগ দিতে কিন্তু সন্তান সম্ভাবা স্ত্রী আর ছোট বোনটাকে এই নরকে ফেলে রেখে যাবেনই বা কি করে? তিনি কিংবা তাঁর স্ত্রী কারোরই তিনকূলে কেউ নেই যে কোন আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠবেন। শেষপর্যন্ত মনে হচ্ছে ইন্ডিয়াতেই পালিয়ে বাঁচতে হবে। এমন সময় একটা ডাকে তপেশ মাস্টারের ভাবনায় ছেদ পড়লো।
‘ মাস্টার! ও মাস্টার! একটু বাইরে আহো।
তপেশ মাস্টার চিনতে পারলেন গলাটা। নজর মেম্বার এসেছে। লোকটা সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত, যখন যেখানে যায় মৃত্যুর দুর্গন্ধ ছড়ায়। তিনি তাড়াতাড়ি তার বোন আর স্ত্রী-কে ডেকে বললেন, ‘ তোমরা কিছুক্ষণ বাড়ির পেছনে খড়ের গাদায় লুকিয়ে থাকো। আমি না বলা পর্যন্ত বের হবা না। ‘ বিনাবাক্য ব্যয়ে তারা তার নির্দেশ মেনে বাড়ির পেছনে চলে গেলো। তপেশ মাস্টার উঠোনে গিয়ে দেখলেন নজর আলি, সবুজ আর পাঁচ-ছজন মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে।
‘ কি ব্যাপার মেম্বার? এসময়ে এখানে? ‘
‘ মেজর সাব তোমারে তলব করসেন,মাস্টার। পুরা পরিবার সহ। ‘
‘ আমি ওদের আগেই অন্য জায়গায় রেখে এসেছি। আর তোমার মেজরকে গিয়ে বলে দিও, আমি তার হুকুমের চাকর নই যে তিনি তলব করলেই সাথে সাথে দৌঁড় দেবো। দরকার পড়লে তিনি নিজে এসে যেন আমার সাথে দেখা করে যান। ‘
‘ তোমার তেজ খুব বাড়সে, মাস্টার। ছুটাইতেসি তেজ ‘, বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সিপাহীকে হাত দিয়ে ইশারা দিলেন। সাথে সাথে সেই সিপাহী তপেশ মাস্টারের তলপেটে সজোরে লাথি মারলো। তপেশ মাস্টার মাটিতে ছিটকে পড়লেন। বাকি সিপাহীরা এবার এগিয়ে আসলো। বন্দুকের বাঁট দিয়ে উপর্যুপরি মারতে লাগলো মাস্টারকে। মাথায় একটা শক্ত বাড়ি খেয়েই তপেশ মাস্টার অজ্ঞান হয়ে গেলেন। নজর আলি তখন দুজন সৈন্যকে নির্দেশ দিলেন তপেশ মাস্টারকে যেন মরা কুকুরের মতো হিঁচড়ে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আর বাকি চর সৈন্যকে নির্দেশ দিলেন পুরো বাড়ি খুঁজে দেখতে। মেয়েমানুষ দুটো যাবে কোথায়! একটু বাদেই নারীকণ্ঠের চিৎকার শোনা গেলো। সৈন্যরা নির্দয় হাতে টেনে হিঁচড়ে তপেশ মাস্টারের ষোড়শী বোন আর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী-কে নিয়ে এলো। তপেশ মাস্টারের বোনকে দেখে নজর আলির ভেতরে আবার কামনার আগুন জ্বলে উঠলো। মেয়েটাকে ঘরে আটকে রেখে এখানেই…! না, নজর আলি নিয়ন্ত্রণ করলেন নিজেকে। ঘটনাটা জানতে পারলে মেজর রেগে যাবেন। নজর আলি তপেশ মাস্টারের বৌকে এখানেই শেষ করে দিতে বলে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাওয়া মেয়েটার হাত ধরে টানতে টানতে ক্যাম্পের দিকে হাঁটা দিলেন। সাথে রইলো আরেক সৈন্য। বাকি তিন সৈন্য চিৎকার করে কাঁদতে থাকা অসহায় প্রসূতি মহিলাটাকে টানতে টানতে জঙ্গলের দিকে নিয়ে গেলো।
তপেশ মাস্টারের স্ত্রী সৈন্যগুলোর পায়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘ আপনারা আমার ভাইয়ের মতো। ছাইড়া দেন আমারে। ভাই হয়া বোনের ইজ্জত নিয়েন না। ‘
সৈন্যরা অট্টহাসি দিয়ে উঠলো। বাঙ্গালি নারী তো বরাবরই তাদের কাছে ভোগের সামগ্রী, ” বেহেন ” হতে যাবে কোন দুঃখে! মানুষের মতো দেখতে সেই হায়েনাগুলো তারপর ঝাঁপিয়ে পড়লো অসহায়ভাবে পড়ে থাকা সেই মহিলার উপর।
একটা নারীকে শারীরিকভাবে যত রকমভাবে অসম্মান করা যায়, সব করলো তারা। উপর্যুপরি কয়েকবার গণধর্ষণ শেষে হতভাগিনী মহিলা যখন তার মৃত্যুর প্রহর গুনছেন, তখন পশুগুলো তার পেট বরাবর বেয়োনেট চার্জ শুরু করলো। অবাক প্রকৃতি নিশ্চুপ শুনে গেলো এক মৃত্যুপথযাত্রী গর্ভবতী মায়ের অসহায় আর্তনাদ। পৃথিবীর প্রতি একরাশ ঘৃণা আর অভিমান নিয়ে তপেশ মাস্টারের হতভাগিনী স্ত্রী অবশেষে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। নরপশুগুলো প্যান্ট পরা শেষ করে বেল্ট পড়তে পড়তে হাঁটা দিলো ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে।
ততক্ষণে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তপেশ মাস্টারের মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রী-র মৃত্যু চিৎকার সহ্য করতে না পেরে যে কাকটা উড়ে চলে গিয়েছিলো, সে-ই কাকটা আবার এসে বসলো বিশাল বড় আমগাছটার মগডালে। তারপর স্থির চেয়ে রইলো হাঁটতে হাঁটতে দূরে সরে যাওয়া মিলিটারিদের গমনপথের দিকে। মানুষ অনেক দেখেছে সেটি। তবে অমানুষ বোধহয় এই প্রথম দেখলো! (চলবে)
এইচ এস সি শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম