তানজীল আহমদ সিদ্দিকী
নজর আলির বাড়ি গ্রামের আর সকল বাড়ির মতো নয়। বিশাল বড় একটা আড়তের মালিক হওয়ার সুবাদেই হোক কিংবা এটা-সেটা ইলিগ্যাল ব্যবসায় টাকা খাটানোর সুবাদেই হোক গ্রামের সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর বাড়িটাই নজর আলির। তার বাড়ির সামনে দিয়ে যে-ই যায় সে-ই বলে, ‘ নজর আলির নজর বেশ উঁচু। ‘ বাড়ির সামনে আছে বিশাল বড় একটা উঠান। আর পেছনে পেল্লাই এক পুকুর। নজর আলি অবশ্য সেটাকে দিঘী বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। বাড়ির আর সকল ঘরের কথা বাদ, শুধুমাত্র বৈঠকখানাতেই কমপক্ষে দশ জন লোক আয়েস করে বসে যেতে পারে। সেই বৈঠকখানার চেহারাই আজ পাল্টে গেছে। মেহমান আসবে বলে সুন্দর করে সাজানো সবকিছু। নজর আলির মতো মানুষদের স্বভাব সাধারণত পোষা কুকুরের মতো। মালিককে খুশি করে দেয়ার শেষ চেষ্টাটা পর্যন্ত তারা ছাড়তে চায় না।
নজর আলি মেহমানদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বাইরে উঠোনে বসে ঝিমুচ্ছিলেন। হঠাৎ পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকালেন, দেখতে পেলেন সবুজ মিলিটারিদের নিয়ে আসছে। তিনি দৌঁড়ে উঠোনে নামলেন।
‘ আসসালামু আলাইকুম, মেজর সাব। আইয়্যে আইয়্যে। ‘
মেজর সিপাহীদেরকে বাইরে পাহারা দিতে বলে নজর আলি আর সবুজের সাথে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলেন। নজর আলি তাদেরকে তার সুদৃশ্য বৈঠকখানায় নিয়ে বসালেন।
মেজর সাহেব শুধু উর্দু আর ইংরেজি বোঝেন। এদিকে নজর আলির উর্দু খুব একটা আসে না। তাই সব কথাবার্তা সবুজের মাধমেই হতে লাগলো। প্রথমেই মেজর জানতে চাইলেন গ্রামবাসীদের মধ্যে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কেমন? জবাবে নজর আলি এক গাল হেসে বললেন, ‘ সে আগেই অনেক কম আছিলো। আপনারা স্যার গ্রামে আসতেসেন শুইনা বেবাক্কেই ভাগসে। দুই একটা পরিবার মাটি কামড়ায়া আছে শুধু। ‘ উত্তরটা সবুজ মেজরকে উর্দুতে অনুবাদ করে দিলো।
মেজর তারপর জানতে চাইলেন ক্যাম্প করার জন্য গ্রামের কোন জায়গাটা সবচেয়ে ভালো হবে? নজর আলি প্রথমে তার পুরনো গোলাঘরের কথা বলতে যাচ্ছিলেন। তারপর হঠাৎ করে তার মনে এলো গ্রামের স্কুলের কথা। আজকাল তপেশ মাস্টারের বাড় বড্ড বেড়েছে! সেই শালার স্কুলে মিলিটারি ক্যাম্প বসালে সবদিক দিয়েই ভালো হয়। মেজর সাহেবও ক্যাম্প করার জন্য ভালো একটা জায়গা পেয়ে তার উপর খুশ হবেন, সেই সাথে সেই তপেশ মালাউনটাকেও উচিত শিক্ষা দিয়ে দেয়া যাবে। নজর আলি সবুজকে বলে দিলো মেজর সাহেবকে স্কুলঘরের কথাটা বলতে। সবুজের থেকে স্কুলঘরের কথাটা শুনে মেজর সাহেব বেশ সন্তুষ্ট হলেন। গ্রামে ঢোকার পর স্কুলটা দেখেছেন তিনি। গ্রামের স্কুল হিসেবে বেশ বড়ই বলা যায় সেটাকে। ক্যাম্প বসানোর জন্য একদম আদর্শ জায়গা। নজর আলি দেখলেন মেজর সবুজের সাথে কথা বলছেন। তিনি আস্তে করে উঠে পড়লেন। মেজর সাহেবের নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়ে গেছে। বড়বিবি টেবিল সাজিয়েছে কিনা কে জানে।
নজর আলির বড়বিবি জোহরা বেগম মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভালো। ধীর-স্থির স্বভাব তার। তাকে কেউ কখনো উঁচু গলায় কথা বলতে শোনেনি। তাকে কিছু না জানিয়েই নজর আলি যখন ছোটবিবিকে বিয়ে করে ঘরে এনেছিলেন সেদিনও শান্ত ছিলেন তিনি। নজর আলি পান চিবোতে চিবোতে নতুন বউয়ের ঘরে ঢুকে ছিটকিনি লাগানোর আগ পর্যন্ত এক ফোঁটা চোখের পানি পড়েনি তার। তারপর সেই রাতে খুব কেঁদেছিলেন জোহরা বেগম। তার কান্নায় কারো কিছু যায় আসেনি। কেউ ছুটে এসে বলেনি, ‘ সব ঠিক হয়ে যাবে, মা।’ পূর্ণ নারীত্বের স্বাদ কখনোই পাননি তিনি। স্বামীর ভালোবাসা আর সন্তান সুখ এ দুটোই সৃষ্টিকর্তা দেননি তাকে। এখন আর এসব পোড়ায় না তাকে। শুধু আক্ষেপ রয়ে গেছে, ম্লান হয়ে গেছে অনুভূতি।
ছোটবিবিকে কখনোই সতীন হিসেবে ভাবতে পারেননি জোহরা বেগম। বরং ছোট বোনের মতো বুকের ভেতরে আগলে রেখেছেন সবসময়। নজর আলি যখনই শাসন করতে যান তার ছোটবিবিকে, বট বৃক্ষের মতো আড়াল করে রাখেন তিনি মেয়েটিকে। আজো যখন নজর আলির থেকে শুনেছেন রাতে কারা আসবে মেহমান হয়ে, তিনি ছুট্টে এসেছেন ছোটবিবির ঘরে। ঘরের দোরে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন জোহরা বেগম। আস্তে করে ডাক দিলেন, ‘ বইনা, সজাগ আসোস? ‘
‘ হ বুবু, আহো না ঘরে। ‘
জোহরা বেগম ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন ছোটবিবি বিছানার উপরে বসে কাঁথা সেলাই করছে। জোহরা বেগম প্রথম যখন ছোটবিবিকে দেখেছিলেন, অবাক হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়েছিলেন। তার কাছে মনে হচ্ছিলো স্বর্গ থেকে কোন হুর ভুল করে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। ছোটবিবির গাত্র বর্ণ ধবধবে ফর্সা, চিকন ঠোঁট, সরু নাক। চুল ছেড়ে দিলে একদম কোমরে নেমে আসে। পেটে বাচ্চা আসার পর সেই রূপ যেন আরো খুলেছে। মেয়েটার দিকে তাকালে জোহরা বেগম যেন তার নিজের অতীতকেই দেখতে পান।
‘ কি হইলো বুবু? এমন কইরা চায়া আছো ক্যান? ‘
‘ এমনেই রে বইন। তোরে দেখি। ‘
‘ আমি কি যাত্রাপালার নায়িকা যে আমারে দেখবা? ‘ বলে খিলখিল করে হেসে উঠে ছোটবিবি। তার সেই হাসিতে যেন মুক্তো ঝরে।
‘ রাইতেবিরেতে মেয়েমানুষরে এত হাসতে নাই। কর্তার অমঙ্গল হয়। ‘
ঠোঁট ওল্টালো ছোটবিবি। জোহরা বিবির হঠাৎ করে মনে পড়লো তার স্বামী সাবধানবাণীর কথা।
‘ বইন, একটু বাদে মেহমানরা আইবো। তুই কিন্তু একদম ঘর থিইকা বের হবি না। ‘
‘ ক্যা বুবু? ‘
‘ হেরা মানুষ ভালা না। সুন্দর মেয়েমানুষ দেখলে হুশ থাকে না। ‘
ছোটবিবি মুখ নিচু করে প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে বললো, ‘ আমাগো স্বামীর মতোন। ‘
জোহরা বিবি চোখ গরম করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় দরজার কাছে আওয়াজ পেয়ে থেমে গেলেন। নজর আলি এসে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার কাছে!
‘ কি হইলো, বড়বিবি? টেবিল সাজাইসো? ‘
‘ এইতো সাজাইতেসি। ‘
‘ তাড়াতাড়ি করো। মেজর সাহেব কতক্ষণ হইসে বইসা আসেন। হুশ থাকে কই? ‘
জোহরা বেগম তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। ছোটবিবির দিকে একদৃষ্টিতে খানিক চেয়ে থেকে নজর আলিও বেরিয়ে গেলেন। ছোটবিবি ঘরে একা হয়ে গেলো, যেমনটা সে বরাবরই থাকে।
খাওয়াদাওয়ার সময় টেবিলে কোন কথা হলো না। জোহরা বেগমের রান্নার হাত ভালো, মেজর সাহেব খুব তৃপ্তি সহাকারেই খেলেন।ল বাকি সিপাহীদের আলাদা ঘরে খেতে দেয়া হলো। খাওয়া শেষ করে নজর আলি মেজর আর সবুজকে নিয়ে উঠোনে চলে এলেন। মেজর উর্দুতে কিসব বললেন নজর আলিকে। বেশিরভাগই বোধগম্য হলো না তার। সবুজ বুঝিয়ে বললো। মেজর বলেছেন কয়েকদিনের ভেতরেই আলতানগরে ক্যাম্প বসিয়ে দেয়া হবে। আর একটা কমিটি গঠন করা হবে, পিস কমিটি। মেজর সাহেব নজর আলির উপর খুশ হয়েছেন, তাকেই বানাবেন সেই কমিটির চেয়ারম্যান। তবে পরেরবার থেকে তার সাথে মালাউনের ভাষা বাংলাতে কথা না বলে উর্দুতে কথা বললেই তিনি খুশি হবেন। সবুজের কথা শুনে নজর আলি খুশিতে একদম গদগদ হয়ে গেলেন। তিনি কথা দিলেন এখন থেকে সাচ্চা পাকিস্তানি নাগরিকের মতোই উর্দুতে কথা বলবেন। রাত বেশি বেড়ে গেলে কুয়াশাও বেড়ে যাবে। তাই মেজররা রওয়ানা হয়ে গেলেন। আগের মতোই টর্চ হাতে সবুজ সামনে। নজর আলি তাদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেজর সাহেবের মতো মানুষই হয় না। পাকিস্তানটা যাতে ভেঙ্গে না যায় সেকারণে কত কষ্ট করে ছুটে এসেছেন সেই সুদূর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। আর মালাউনের বাচ্চারা কিনা স্বাধীনতা চায়! এসব ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকে গেলেন নজর আলি। আজ রাতে ভালো ঘুম হবে তার।
কুয়াশা বাড়ছে। আলতানগরের পথ-ঘাট অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে দৃশ্যপট থেকে। জোনাকিরা পর্যন্ত পথ হারিয়ে দিগ্বিদিক ঘুরছে। আলতানগরের আকাশে বাতাসে যে অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে সেই অন্ধকারের সীমা ছড়িয়ে গেছে বহুদূর। আলতানগরের মতো এমন হাজারো গ্রাম ডুবে আছে এই অন্ধকারে। এখন অন্ধকারের যুগ। মানুষের মতো দেখতে নিষ্প্রাণ চোখের পিশাচের যুগ। জোনাকিরা এখন মৃত। (চলবে)
এইচ এস সি শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম