তানজীল আহমদ সিদ্দিকী
আলতানগরে অন্ধকার নেমে এসেছে। শীতের বিকেল, দেখতে না দেখতেই ফুরিয়ে যায়। তারপর বিশ্ব চরাচর আঁধার করে দিয়ে নেমে আসে রাত। নজর আলি তার বাড়ির বারান্দায় বসে সেই রাতেরই অপেক্ষা করছেন। আজ রাতে তার বাড়িতে কিছু মেহমান আসবেন। তাদেরকে ভালোভাবে আপ্যায়ন করতে হবে, নইলে একেবারে জীবন সংশয়। নজর আলি তার বড় বিবিকে ডাক দিলেন। রান্নাবান্নার কদ্দুর কি হলো সেটা জানা দরকার।
‘ বড়বিবি। এ বড়বিবি। ‘
জোহরা বিবি দৌড়ে আসলেন। স্বামী পরিচয়ের এই অমানুষকে ভয় পান তিনি।
‘ দুই ডাক দেয়া লাগলি ক্যান? ‘
জোহরা বিবির চোখ মাটির দিকে। সামনে বসে থাকা এই মানুষটার মুখের উপর টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করার সাহস তার নেই।
‘ রাইতে যে মেহমান আইতেসে হেইডা মনে আছে তো? ”
‘ জে। ‘
‘ যা যা পাক করতে কইসিলাম সব পাক করসো তো? তেনারা কিন্তু গোশত খুব শখ কইরা খান। কি হইলো কথা কও না ক্যান? ‘
‘ জে, সব রান্না শেষ করসি। গোশত আমি নিজে দাঁড়ায়া রান্না করসি। ‘
‘ ঠিক আছে। যাও তাইলে। না না, দাঁড়াও। ‘
জোহরা বিবি ঘুরে চলে যাচ্ছিলেন। স্বামীর ডাকে আবার ফিরলেন।
‘ জে? ‘
‘ ছোটবিবিরে কয়া দিয়ো আইজ রাইতে যাতে ঘর থেইকান না বাইর হয়। ‘
জোহরা বিবির চোখে ভয় ফুটলো। নজর আলির মেহমান কারা সেটা তিনি ভালো করেই জানেন। আর সেই মেহমানদের কুকীর্তির কথা আর সবার মতো তার কানেও এসেছে।
‘ আইচ্ছা ‘, বলে জোহরা বানু দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। ছোট বিবিরে সাবধান করতে হবে। আইজ রাতে যারা ঘরে আসছে তারা যে নজর আলির থেকেও বড় পিশাচ!
নজর আলি তার বড়বিবির গমনপথের দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইলেন। একটাসময় খুব সুন্দরী ছিলো তার বড়বিবি। এখন বার্ধক্যের ঘুণপোকায় শরীর ক্ষয়েছে। নতুন শরীরের নেশায় কদিন আগে আরেকটা বিয়ে করেছেন তিনি। তবু নেশা মিটে না। গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে কোন যুবতীকে হাঁটতে দেখলেই শরীরে কেমন অদ্ভূত শিরশিরানি উঠে। অবশ্য এ কারণেই গাঁয়ের লোকেরা তাকে লুইচ্চা নজর ডাকে। যদিও সবই তার পশ্চাতে।
‘ বাইঞ্চোদের দল ‘, দাঁত কিড়মিড় করেন নজর আলি। মালাউনের বাচ্চাদের কেমন করে সিধা করতে হয় সেটা ভালো করে জানা আছে তার।
রাত বাড়ছে। জোনাকিরা সবে বাসা থেকে বের হচ্ছে। ভালো করে তাকালে বাঁশঝাড়ের কোণায় কোণায় একটা দুটো আলোর ফুটকি চোখে পড়ে। বাঁশঝাড়ের পাশেই হাঁটাপথ। আলতানগরের একদম মধ্যখান দিয়ে সরু ফিতার মতো চলে গেছে সেই মেহেদিগঞ্জ পর্যন্ত। অন্য সকল দিনে এসময়ে কেউ বেরোয় না। সন্ধ্যার একটু পর খেয়েদেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। তাই রাত হলে শেয়ালের পাল আর নকূল বাউল ছাড়া আর কেউ চলাচল করে না এই পথ দিয়ে। নকূল বাউল পাগলাটে মানুষ। তার দিনও যা, রাতও তাই। রাত-বিরেতে গান গেয়ে গেয়ে পথ হাঁটা তার পুরনো অভ্যেস। মেহেদিগঞ্জে আজ একটা আসর ছিলো। সেটা শেষ করে বাড়ি ফিরছে নকূল। আসর জমজমাট ছিলো, তাই মনে তার বড় সুখ। আপনা থেকেই গলা দিয়ে গান বেরুতে লাগলো। নজর মেম্বারের বাড়ি থেকে খানিক দূরে এসে নকূল দাঁড়িয়ে গেলো। ওপাশ থেকে টর্চের আলো এসে তার মুখে পড়েছে। টু সেল ব্যাটারির টর্চ, ওপাশের কিচ্ছু ঠাওর করতে পারলো না নকূল।
‘ নকূল, এত রাইতে এনো কি করো? ‘
টর্চটা নেমে গেলো। নকূলের সামনে ছয়-সাত জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে শুধু একজন তার পরিচিত, সবুজ। টর্চটা সে-ই মেরেছিলো। সবুজের সাথে বাকি যারা আছে তারা মিলিটারি। পাকিস্তানি মিলিটারি।
‘ জলসা ছিলো, এখন ঘরে ফিরতাসি। ‘ নকূল ভালো করে তাকালো মিলিটারিদের দিকে। ছয় জনের মধ্যে পাঁচজনই সাধারণ সৈন্য। খাকি পোশাক, মাথায় সবুজ হ্যালমেট। প্রত্যেকের পিঠে একটা করে করে বন্দুক, ধারালো বেয়নেট সহ। আর একজনকে দেখে মনে হচ্ছে অফিসার। নকূল যদি ইংরেজি পড়তে পারতো তাহলে বুঝতে পারতো সেই অফিসারের বুকের কাছে লেখা আছে – মেজর ওয়াসিম খান। মেজর সবুজকে কিসব যেন বললেন। উর্দু বোঝে না নকূল, তাই হা করে তাকিয়ে রইলো তাদের দিকে। মেজরের কথা শেষ হওয়ার পর সবুজ নকূলের দিকে ফিরে বললো, ‘ মেজর সাব জানতে চাচ্ছেন তুমি মুসলমান নাকি মালাউন? ‘
‘ জে আমি বাউল মানুষ। প্রকৃতি আমারে জন্ম দিসে, মইরা গেলে প্রকৃতিই আবার নিয়া যাবে। সৃষ্টিকর্তা বলতে আমি আমার মাটিরেই চিনি। আলাদা কইরা কোন ধর্মের গান আমি গাই না, সবুজ। তাই মেজর সাব রে কয়া দাও আমি মুসলমানও না, আবার মালাউনও না। আমি মানুষ। ‘
সবুজ মেজরের কানে গিয়ে ফুসুরফুসুর করে কিসব বললো। সাথে সাথে মেজরের মুখের ভাব কেমন বদলে গেলো। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই মেজর সামনে এগিয়ে এসে নকূলের তলপেট বরাবর বুট দিয়ে সজোরে একটা লাথি দিলেন। নকূল দু হাত দূরে ছিটকে পড়লো। মেজর দাঁত কিড়মিড় করে করে বলে উঠলেন, ‘ সব বাঙ্গাল সালে মালাউনকা বাচ্চে। বেয়নেটসে গাঁড়দো ইসে। ‘
সিপাহীরা কাঁধ থেকে বন্দুক নামিয়ে এগিয়ে এলো নকূলের দিকে। তারপর শুরু হলো এলোপাথাড়ি বেয়োনেট চার্জ। আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠলো নকূলের আর্তচিৎকারে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি। রক্তের স্রোত সবুজের পা পর্যন্ত আসা মাত্র আর সহ্য করতে পারলো না সে। বসে পড়লো পথের তারপর হড়বড় করে বমি করে দিলো। এদিকে সিপাহীরা কাঁটাচামচ দিয়ে মোরব্বা গাঁথার মতো বেয়োনেট দিয়ে গেঁথেই যাচ্ছে নিথর নকূলকে। অবশেষে মেজর থামতে বলার পর থেমে গেলো তারা। ততক্ষণে সবুজ কিছুটা সামলে নিয়েছে নিজেকে। মেজর সবুজকে হুকুম দিলেন নকূলের লাশটা পথের ধারে ফেলে রাখতে। সবুজ সামনে এগিয়ে এসে নকূলের লাশের দিকে তাকাতেই আবার প্রচণ্ডভাবে অসুস্থ বোধ করতে লাগলো। বেয়োনেটের খোঁচায় নকূলের ডান চোখটা বেরিয়ে ঝুলে আছে গালের কাছে। বাম চোখ বলে কিছু নেই। অক্ষিকোটরের ভেতরে চোখ থেঁতলে গেছে। মুখের বাকি অংশে আলাদা করে নাক ঠোঁট কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কণ্ঠনালি ফালা ফালা করে ফেলা হয়েছে। শরীরের নিচের দিকের অবস্থাও বর্ণনাতীত। সবুজ কোনরকমে লাশের পা দুখানা ধরে টানতে টানতে রাস্তার পাশে এনে ফেললো। তারপর বিবর্ণ মুখে মেজরের সামনে গিয়ে বলল,’ হো গায়া, মেজর সাব। ‘ মেজর কিছু বললেন না, শুধু হাত দিয়ে ইশারা করে আবার হাঁটা শুরু করার নির্দেশ দিলেন। এ গ্রামের মেম্বার নজর আলির বাড়িতে আজ তাদের দাওয়াত আছে। গ্রামে ক্যাম্প বসাতে লোকটার সাহায্য দরকার হবে তার। সবুজের দেখানো পথে এগিয়ে চলা মিলিটারির ছোট্ট দলটা আস্তে আস্তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। আর পেছনে পথের ধারে অবহেলায় তাচ্ছিল্যে গায়ে ধূলো রক্ত মেখে পড়ে রইলো নকূল বাউলের নিথর দেহ। পাশে তার প্রিয় একতারা। আলতানগরের পথেঘাটে আর কেউ কখনো দেখবে না নকূলকে। রাতবিরেতে বাতাসের ভাঁজে ভাঁজে আর ভাসবে না নকূলের দরাজ গলা। একতারার ঝংকারে আর কেউ কখনো বলবে না, ‘ নকূল, তুমি একখান হীরা আছো বাহে! ‘ ঘুমিয়ে গেছে নকূল। পরম শান্তিতে সে তার প্রকৃতি মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। বাতাসে হঠাৎ মাতম উঠলো। নকূলের শেষকৃত্যে প্রকৃতি তার দূত পাঠিয়েছে। একটু পরই বাতাস থেমে গেলো। শেষ রাতে বোধহয় ঝড় আসবে। ঝড়ের দিন তো কেবল শুরু হলো… (চলবে)
এইচ এস সি শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম