banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1179 বার পঠিত

 

জোনাক নগরের আঙিনায়…৩


আফরোজা হাসান


আপনি সত্যি সত্যিই এমন করবেন আমার সাথে?

যায়েদ হেসে বলল, আচ্ছা চলো তোমাকে আমার আরো এক ক্লাসমেট দম্পতির গল্প শোনাই। ওরাও পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওদের বিয়েটা টেকেনি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেই পরিবারের অমতে ওরা বিয়ে করেছিল সেই পরিবারের কারণেই আবার বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিল। ওদের ভালোবাসার কলোকাকলি দাম্পত্য কলহে রূপান্তরিত হয়েছিল একে অন্যের পরিবারের প্রতি বিদ্বেষ আর নিজ নিজ পরিবারের প্রতি সন্তোষের কারণে। পরিবারের কথা উঠলেই দু’জন নিজ নিজ পরিবারের পক্ষে সুপারিশ করতো এবং একে অপরের পরিবারকে দোষারোপ করতো। ফ্যামেলি ইগো যাকে বলে। অর্থাৎ, তোমার পরিবারের চেয়ে কিসে কম আমার পরিবার? তোমার চেয়ে কি আমার যোগ্যতা কোনদিন দিয়ে কম? এই ধরণের মানসিক দৈন্যতায় ভুগতো দুজন। যা ধীরে ধীরে ঘুণ পোকার মত ক্ষয় করে দিয়েছিল সম্পর্কের মধ্যে বিরাজমান মিষ্টতা ও স্বিগ্ধতা। পরিণতিতে দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেল বেঁকে। গত কয়েক বছরে এমন অসংখ্য কেস এসেছে যেখানে স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যের প্রতি ভালোবাসার কোন কমতি ছিল না। যাদের মধ্যে বেশ কিছু দম্পতি একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, বিশ্বাসও লালন করতো মনে। একে অপরকে ভালো মানুষ স্বীকৃতিও দিতো। কিন্তু তবুও দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্য ও ঝগড়া লেগেই থাকতো। সেই ঝগড়ার বিষয় ছিল দু’জনের পরিবার। কার পরিবার বেশি খারাপ কিংবা দ্বায়িত্বহীন এটা প্রমাণ করাটাই যেন সার্থকতা। একে অন্যের পরিবার দ্বারা কে কতটা বেশি কষ্ট পেয়েছে সেটা খুঁজে বের করাটা পার্ট টাইম জবের মত ছিল তাদের কাছে। যার সেলারি হিসেবে তারা লাভ করতো মানসিক অশান্তি।

নূরি বলল, মানুষ কেন জেনে বুঝেও ছোট থেকে ছোট কারণকে ইস্যু করে নিজেদের জীবনের এভাবে অশান্তি ডেকে আনে?

এই প্রশ্নটা নিয়ে আমিও প্রায়ই ভাবি। মানুষ কেন এত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারণে নিজের জীবনের শান্তি ও স্বস্থিকে নষ্ট করে অবলীলায়?! পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কারণে কেন মানুষ নিজের সুখের সংসারে অশান্তি ডেকে আনে?! কেন মনটাকে একটু বড়, একটু উদার করতে পারে না?! কেন সবসময় শুধু অন্যের দোষটাকেই দেখে?! কেন ক্ষমা করে দিতে বা ভুলে যেতে পারে না অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো?! কেন সবসময় নিজেকে সঠিক আর অন্যেকে বেঠিক মনে করে?! কেন ভাবে না যে যদি সংসারের সুখের কথা চিন্তা করে ধৈর্য্য ধারণ করে তাহলে এর কল্ল্যাণময়তা তাকেই ঘিরে আবর্তিত হবে? এমন আরো অসংখ্য কেন ঘুরতে থাকে মাথায়। মাঝে মাঝে কিছু কিছু ক্যাপলকে দেখে মনেহয় সংসার না বরং কোন একটা প্রতিযোগিতা চলছে। পরিবারের দোহাই দিয়ে কে কাকে হারাতে পারবে বা দাবিয়ে রাখতে পারবে সেই প্রতিযোগিতা। এতে তারা এতটাই হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে যে বুঝিতেই পারে না জিত একজনের হলেও হার মূলত দু’জনেরই হয় এই প্রতিযোগিতাতে।
কিন্তু এর সমাধান কি?
যায়েদ হেসে বলল, তুমি নিশ্চয়ই জানো সবজি রান্নার ব্যাপারে আমার এলার্জি আছে। আমার কথা হচ্ছে তেল, মশলা সবকিছু দিয়ে রান্না করবো। কিন্তু কিছুতেই সবজির রঙ চেঞ্জ হতে পারবে না। রান্না করার পরও প্রতিটা সবজিতে নিজ নিজ রঙ ঠিক থাকবে। এরজন্য অনেক রাঁধুনির সাথে কথা বলেছি, নিজে বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করেছি। শেষপর্যন্ত এখন রান্নার পরও সবজির রঙ মোটামুটি ঠিক থাকে আলহামদুলিল্লাহ। এই যেমন এখন আমরা বাপীর জন্য মিক্সড সবজি রান্না করলাম। দেখো আগুনের তাপে তেল, মসলা, পানি ইত্যাদি দিয়ে সেদ্ধ করার পরও প্রতিটি সবজির আলাদা রঙ একদম ঠিক আছে আলহামদুলিল্লাহ। এর কারণ সবজির রঙ যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য আমি অনেক চেষ্টা ও সাধনা করেছি। এই বিষয়ে যারা পারদর্শী তাদের সাথে আলোচনা করেছি, পরামর্শ নিয়েছি। সবকিছু মিলিয়ে আমি এই যোগ্যতাটুকু অর্জন করেছি আলহামদুলিল্লাহ। এখন তুমি জীবন বলো, পারিবারিক জীবন বলো কিংবা দাম্পত্য জীবন। দুঃখ-কষ্ট, হতাশা-নিরাশা, বেদনা অপ্রাপ্তি আসবেই, থাকবেই। এসবের প্রভাব থেকে নিজেকে, নিজের মনকে মুক্ত রাখতে চাইলে চেষ্টা ও সাধনার প্রয়োজন। প্রয়োজন জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী কারো সাহচর্য ও পরামর্শ। এবং প্রয়োজন নিরলস ভাবে লেগে থাকার। এভাবেই আসলে ধীরে ধীরে আয়ত্তে আসে কোন বিশেষ যোগ্যতা। তবে যে কোন ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আল্লাহর উপর ভরসা। কেননা আল্লাহ বলেছেন“ যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন।”
হুম, সমস্যা বা বিপদে মানুষ এতটাই অস্থির হয়ে যায় যে, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেই ভুলে যায়।
আসলে নিজের মনের চাওয়া-পাওয়ার বিপরীত কিছু হলে, প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে আমরা মানসিক ভাবে বিক্ষিপ্ত ও এলোমেলো হয়ে পড়বো এটাই স্বাভাবিক। যখন বিরূপ বা নেতিবাচকতা ঘিরে ধরবে বিরক্তি, রাগ, হতাশা মনকে আঁকড়ে ধরতে চাইবে এটাও স্বাভাবিক। নির্ভরতার আশ্রয় পরিবারই যখন জীবনের অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে তখন হাল ছেড়ে দিতে চাইতেই পারে কেউ। এই সব অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র পথ হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর উপরে ভরসা করা, সাহায্য প্রার্থনা করা। কিন্তু মানুষ বেশির ভাগ সময়ই লেগে থাকে অন্য মানুষের পেছনে। স্ত্রী স্বামীকে বলে সব ঠিক করে দাও। স্বামী স্ত্রীর কাছে দাবী করে শান্তি প্রতিষ্ঠার। একে অন্যের কাছে চাইতে গিয়ে নিজেদের করণীয় তো ভুলে যায়ই, সাথে সাথে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতেও ভুলে যায়। যারফলে মন অতৃপ্ত ও অশান্তির বেড়াজাল ছিঁড়ে বেড়োতে পারে না। তুমি সমাধান কি জিজ্ঞেস করেছিলে।
হুম!
যায়েদ হেসে বলল, একটা বাণী মনে পড়ে গেলো “কিছু কিছু প্রশ্ন অনেক কঠিন কিন্তু তার উত্তরটা খুবই সহজ।” ঠিক তেমনই মনেহয় কিছু কিছু সমস্যা খুব জটিল কিন্তু তার সমাধানটা খুবই সহজ। দাম্পত্য কলহের কারণ যদি পরিবার হয়, একটি সুন্দর সম্পর্ক যদি পরিবারের কারণে টানাপোড়নের স্বীকার হয়, তাহলে বিবেচনা করে দেখতে হবে কে সঠিক। আর সঠিক বেঠিকের মানদন্ড হিসেবে শরীয়ত তো আছেই। মানুষ যখন আল্লাহর বিধান মেনে চলে তখন তাদের মনের আকার এমনিতেই বড় হয়ে যায়। তারা নিজ নিজ স্বার্থের গন্ডিকে পেরিয়ে স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে শেখে। সর্বাবস্থায় আমিই সঠিক এই ক্ষুদ্র ও কলুষিত চিন্তা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে। আসলে দাম্পত্য সম্পর্কটাকে হওয়া উচিত সকল প্রকার প্রভাব মুক্ত। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই বোঝাপড়া টুকুন যদি থাকে যে একমাত্র শরীয়ত ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন কিছু বা অন্য কেউ তাদের জীবনের করণীয়-বর্জনীয়র মানদন্ড হবে না। তাহলে পরিবারের কারণে দাম্পত্য কলহ মুক্ত থাকা সম্ভব হয়। আরেকটা বোঝাপড়া অবশ্যই থাকা উচিত স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কেউ বা কোন কিছুই যেন তাদের মনে একে অপরের প্রতি বিদ্বেষের বীজ বপন করে দিতে না পারে। পরিবারকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে যেন আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এখন তুমি আমার একটা কথা মন দিয়ে শোনো।
জ্বি বলুন।
রান্না করতে আমি খুব বেশি পছন্দ করি। তাই তুমি যদি দাম্পত্য কলহ এড়াতে চাও কখনোই এই আনন্দময় কাজটি করার সময় তোমার ঝুড়ি থেকে এইসব সমস্যা বের করবে না। ক্লিয়ার?
নুরি হেসে বলল, অল ক্লিয়ার স্যার।
যায়েদ হেসে বলল, তাহলে সমস্যার ঝুড়ি বন্ধ। গত সপ্তাহে যে তোমাকে আমি এত সময় লাগিয়ে ভেজিটেবল স্টু বানানো শেখালাম। আজ তাহলে পরীক্ষা হয়ে যাক কেমন স্টুডেন্ট তুমি।
ওক্কে স্যার। বলে হাসি মুখে নূরি ভেজিটেবল স্টু বানানোতে মনোযোগ দিলো।

চলবে…

Facebook Comments