জেলা ও উপজেলা হাসপাতালগুলোতে স্তন ও জরায়ু ক্যান্সার নিরূপণ করা হচ্ছে
নারী সংবাদ
দেশে ও দেশের বাইরে নারীদের প্রাণঘাতি রোগের মধ্যে স্তন ক্যান্সার ও জরায়ু-মুখ ক্যান্সার অন্যতম। একটুখানি সচেতন হলে আর বাড়ির কাছের সরকারি হাসপাতালগুলো এবং মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে আসলে যে কোন নারী খুব সহজেই ক্যান্সারের প্রাথমিক নিরূপণ কাজ করাতে পারেন। গুরুত্ব বিবেচনা করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্তন ও জরায়ু ক্যান্সার পরীক্ষা করা হচ্ছে।
সেন্টার ফর সার্ভিক্যাল এন্ড ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং এন্ড ট্রেনিং প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, বিশ্বে ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের একটি বড় অংশ জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সারের শিকার। আমাদের দেশে ২০১৮ সালে ৮ হাজার ৮৬ জন জরায়ু-মুখ ক্যান্সার আক্রান্ত নারীকে সনাক্ত করা হয়েছে। আর ক্যান্সারে আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন পাঁচ হাজার ২১৪ জন। অন্যদিকে ওই বছরে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৭৬৪ জন। আর এই ক্যান্সারে আক্রান্তদের মধ্যে মারা যান ছয় হাজার ৮৪৬ জন। প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ১২ হাজার মহিলার জরায়ু-মুখে নতুনভাবে ক্যান্সার হচ্ছে।
অপরদিকে দেশে বছরে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা পনের হাজার। এর মধ্যে মারা যান আট হাজার। ৪০ বছরের পর থেকে নারীদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। প্রাথমিকভাবে স্তন ক্যান্সারের উপসর্গের মধ্যে আছে- স্তনের কিছুটা অস্বাভাবিক অবস্থা বা চাকা অনুভব, স্তনের চামড়ার রং পরিবর্তন বা চামড়া কিছুটা পুরু হয়ে যাওয়া, নিপল ভেতরে দেবে যাওয়া, নিপল দিয়ে রক্ত বা পুঁজ পড়া। আর স্তন ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে যকৃতের ক্ষেত্রে পেটে ব্যথা বা জন্ডিস, ফুসফুসে ছড়ালে কাশি হওয়া বা কাশির সাথে রক্ত যাওয়া এবং হাড়ে তীব্র ব্যথা অনুভব হয়।
জরায়ু-মুখ ক্যান্সারের লক্ষণ হচ্ছে- অতিরিক্ত সাদা ¯্রাব, দুর্গন্ধযুক্ত ¯্রাব, অতিরিক্ত অথবা অনিয়মিত রক্ত¯্রাব, সহবাসের পর রক্ত¯্রাব, মাসিক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবার পর পুনরায় রক্তপাত, কোমরে বা তলপেটে অথবা উরুতে ব্যথা।
এই ধরনের কোন সমস্যা হলে জাতীয় পরিচয়পত্রের ছায়ালিপি সহযোগে চলে আসতে হবে যে কোন জেলা সদর হাসপাতাল, মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র এবং নির্বাচিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে। ৩০ বছরের বেশী বয়স হলেই জরায়ু-মুখ অবশ্যই পরীক্ষা (ভায়া) করাতে হবে। তবে ১৮ বছরের আগে বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে ২৫ বছর বয়স হলেই জরায়ু-মুখ পরীক্ষা করাতে হবে। বয়স্কদের জন্যে ভায়া পরীক্ষা আরো জরুরী। এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অন্যান্য স্ত্রী-রোগের চিকিৎসারও সুযোগ তৈরী হয়।
রোগের চিকিৎসার পরিবর্তে প্রতিরোধ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। জরায়ু-মুখ ক্যান্সার খুব সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। রোগে আক্রান্ত হবার আগে জরায়ু-মুখে অনেকদিন ধরে ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা বিরাজ করে। ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা ধরা পড়লে সামান্য চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে জরায়ু ফেলে দেবার প্রয়োজন হয় না এবং চিকিৎসার পরেও সন্তান ধারণ করা সম্ভব।
নাটোর সদর হাসপাতালে স্তন ও জরায়ু-মুখ ক্যান্সারের প্রাথমিক পরীক্ষণ কাজে নিয়োজিত হোসনে আরা বলেন, যে পদ্ধতিতে জরায়ু-মুখ ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা শনাক্ত করা হয় তাকে ‘ভায়া’ এবং স্তন ক্যান্সার পরীক্ষা পদ্ধতিকে ‘সিবিই’ বলে। এই পদ্ধতিতে জরায়ু-মুখ পরীক্ষা করলে ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা সাদা রং ধারণ করে এবং রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করে। আর স্তন ক্যান্সার বোঝার জন্যে স্তনে চাকা বা অস্বাভাবিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়। ‘বিএসএমএমইউ-এ সার্ভিক্যাল এন্ড ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জাতীয় কেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্পের পক্ষ থেকে মোট তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০০৭ সাল থেকে আমরা কাজ করছি এবং প্রতিমাসে এই হাসপাতালে গড়ে দুইশ’ নারীর পরীক্ষা কাজ সম্পন্ন হচ্ছে।
পরীক্ষা শেষে অনাক্রান্ত রোগীকে সবুজ রঙের কার্ড প্রদান করে কাউন্সিলিং শেষে তিনবছর পরে আবার আসতে অনুরোধ করা হয় এবং পজিটিভ রোগীকে গোলাপী কার্ড প্রদান করে গাইনী বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে উন্নত চিকিৎসার জন্যে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা বিশেষায়িত হাসপাতালে রেফার করা হয় বলে জানালেন অপর স্টাফ নার্স আশরাফুন্নেছা।
নাটোর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের স্টাফ নার্স সুফিয়া খাতুন জানান, এই কেন্দ্রে নিয়মিত স্তন ও জরায়ু-মুখ ক্যান্সার পরীক্ষা করা হয়।
সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নাটোর সদর হাসপাতাল এবং জেলার পাঁচটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০১৮ সালে মোট এক হাজার ১৬৯ জন নারীর স্তন ও জরায়ু-মুখ ক্যান্সার পরীক্ষা করে ৫২ জনের ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা সনাক্ত করা হয়েছে