আফরোজা হাসান
মেইল খুলে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো অধরার। একশো বাইশটা মেইল এসে জমেছে। তিন সপ্তাহ ইচ্ছে করেই মেইল চেক করেনি। কিন্তু এখন মনেহচ্ছে বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছে। এই মেইল দেখতে এখন আরো তিন সপ্তাহ লাগবে। আর চলতি তিন সপ্তাহে যেসব মেইল আসবে সেসব কি করবে? জীবন থেকে পিছিয়ে পড়া কি এটাকেই বলে? এভাবেই কি নানা ধরণের কাজে ছোট ছোট অবহেলা বা গাফলতি মানুষকে একটু একটু করে পিছিয়ে দেয় জীবনের পথে? মনের অসৎ ইচ্ছে গুলোকে মূল্য দিয়ে গিয়ে এভাবেই অবমূল্যায়ন করা হয় মহামূল্যবান সময়ের! মোবাইলের শব্দে ভ্রু কুঁচকে গেলো অধরার। এখন কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু পর মুহুর্তেই মনে হলো যে, এটাও মনের একটা অসৎ ইচ্ছা। এমন তো হতে পারে কেউ খুব প্রয়োজনে ফোন করেছে।
মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রীনে জুম্মির নাম্বার দেখে হাসলো। না জানি আবার কি আজগুবি কথা বলার জন্য ফোন করেছে। মাঝে মাঝে কিছু মানুষকে বোঝাতে গেলে মনে হয় বিশাল এক মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। যার কোথাও কিছু নেই, চারিদিকে শুধু ধূ ধূ প্রান্তর। যা বলা হয় সেটা প্রতিধ্বনিত হয়ে নিজের কাছেই ফিরে আসে। আবার কারো ক্ষেত্রে মনে হয় কালবৈশাখীর ঝড়ের কবলে পড়েছে। চারপাশে মটমট করে ভাঙছে ডালপালা, উড়ে যাচ্ছে টিনের চাল। কখন না জানি কি এসে আঘাত হানে এই আতঙ্কে জড়োসড়ো হয়ে উঠে মন। আবার কিছু মানুষকে বোঝাতে গেলে তাদের মনের কোমলতা ও নিজেকে শুধরানোর আকাঙ্ক্ষা মনে ঝরিয়ে দেয় এক পশলা বৃষ্টি। কেউ বা ফুলে ফুলে ভরিয়ে দেয় মনের আঙিনা। জুম্মি ঠিক এমন একজন যার ভুল গুলোকে ফুল করে দিতে কখনোই বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হয় না অধরাকে।
সালাম বিনিময়ের পর জুম্মি বলল, ম্যাম আমি জানি আজ আপনি ভীষণ ব্যস্ত। আমি বেশিক্ষণ সময় নেব না। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা জানিয়েই ফোন রেখে দেবো।
অধরা হেসে বলল, হুমম…বুঝলাম। আচ্ছা বলো শুনি আবার কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো তুমি!
ম্যাম ঠিক করেছি সন্ন্যাসী হয়ে যাবো। আইডিয়াটা কেমন বলেন তো?
অধরা হেসে বলল, আইডিয়ার পেছনে কারণগুলো জানার আগে বলতে পারছি না যে আইডিয়াটা ঠিক কেমন।
অনেকগুলো কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি ম্যাম। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে জীবনের এত সব জটিলতা, কুটিলতা ভালো লাগে না। মানুষের ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদল খুব কষ্ট দেয় আমাকে। তারচেয়েও বেশি কষ্ট দেয় মানুষের মধ্যের ক্ষুদ্রতা। মানুষকে জার্জ করতে চাই না আমি কিন্তু বেসিক বিবেকবোধের ঘাটতি যখন দেখি চোখ ফিরিয়েও নিতে পারি না।
এর জন্য তুমি ঠিক করেছো সন্ন্যাসী হয়ে যাবে?
জ্বী ম্যাম। এইসব কারণে আমার মনের ভিতর যে রাজ্যটা আছে সে রাজ্যের রাণী একা থাকাটাকেই ভালো মনে করছে। তাছাড়া নিরবতা, নিস্তব্ধতা, নিবিড়তা, শান্ত-স্বিগ্ধ পরিবেশে তীব্র ভাবে আকর্ষণ আমাকে। ইচ্ছে মত যখন যেখানে ইচ্ছে ঘুরতে বেড়াতে ইচ্ছে করে। চাই যখন আপন মনে চিন্তা ভাবনা করবো তখন কেউ এসে বাঁধাগ্রস্ত না করুক আমাকে। গুহা আর পাহাড়ে ধ্যান করাটাকে এখন জীবনের একমাত্র স্বপ্ন মনেহয়। রাসুল (সাঃ) হিরা গুহাতে ধ্যানরত ছিলেন, সেটা উপলব্ধি করার পর থেকেই এই ইচ্ছাটা মনে বাসা বেঁধেছে। আপনি কি আমার কথাতে বিরক্ত হচ্ছেন?
অধরা হেসে বলল, উহু আমার তো শুনতে বেশ লাগছে তোমার কথা। তুমি নিশ্চিন্তে তোমার মনের সব কথা বলো আমাকে।
আপনি তো জানেন ম্যাম আমি বড্ড স্বাধীনচেতা কিন্তু বিদ্রোহী নই। মনে প্রাণে চাই যে আমার নিজের একান্ত একটা সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে। কেউ যেখানে নাক গলাতে আসবে না, কেউ নাক উঁচুও করবে না যে সিদ্ধান্ত শুনে। মোটকথা এমন অন্ধ বন্ধন থাকবে না যাতে করে চাইলে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারবো আমি। তবে সন্ন্যাসীরা সাধারণত ঘর ছাড়া কিন্তু আমি ঘরে থেকে সন্ন্যাসী হতে চাই। আর আমি সন্ন্যাসী হতে চাই সমাজকে নতুন করে নতুন রূপে সাজাতে। ম্যাম এবার বলেন আইডিয়াটা কেমন?
অধরা হেসে বলল, তোমার আইডিয়াটা কেমন সেটা পরে বলছি। তবে তোমার সন্ন্যাসী হতে চাইবার কারণটা অনেক সুন্দর। কিন্তু সমাজকে নতুন করে নতুন রূপে সাজাতে হলে আগে নিজেকে নতুন করে নতুন রূপে সাজাতে হবে। নিজেকে গড়ো অতঃপর জগতটাকে। সুতরাং, আগে নিজেকে গড়তে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে নিজেকে গড়ার জন্য সন্ন্যাস জীবন ধারণ করার যোগ্যতা তোমার আছে কিনা?
প্রশ্নটা বুঝিনি ম্যাম।
আচ্ছা বুঝিয়ে বলছি। যেমন ধরো আমাদের এই দুনিয়াবী জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে জান্নাত লাভ। এখানে লক্ষ্য হচ্ছে জান্নাত আর মাধ্যম হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। এখন যদি প্রশ্ন করা হয় জান্নাত লাভের জন্য কি করতে হবে? জবাব হচ্ছে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি কিভাবে অর্জন করবো? আল্লাহর পাঠানো শরীয়তের বিধান মত জীবন যাপন করে। ঠিক তেমনি তোমার লক্ষ্য সমাজকে নতুন করে নতুন রূপে সাজানো। মাধ্যম হিসেবে তুমি বেছে নিয়েছো সন্ন্যাস জীবনকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তোমার সন্ন্যাস জীবনের ভিত্তি কি? কিসের আলোকে তুমি সমাজকে নতুন করে নতুন রূপে সাজাতে চাও?
অবশ্যই শরীয়তের আলোকে ম্যাম।
কিন্তু শরীয়ত তো সন্ন্যাস জীবন সমর্থন করে না। সূরা নাহলের ৯নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-“ সরল পথ আল্লাহ্র দিকে পরিচালিত করে,কিস্তু পথগুলির মধ্য বক্রপথও আছে। আল্লাহ্ যদি ইচছা করতেন তবে তিনি সকলকেই সৎ পথে পরিচালিত করতে পারতেন।” এই আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে-“ এই পার্থিব জীবন, হাসি, কান্না, ভালোবাসা, হিংসা-দ্বেষ, লোভ-লালসা দ্বারা আবৃত। আর এ সব মিলেই আমাদের পৃথিবীর জীবন। সংসার ত্যাগ করে বনে গিয়ে আল্লাহ্কে পাওয়ার ইবাদত ইসলাম স্বীকার করে না। এই পার্থিব জীবনের মাধ্যমে স্রষ্টাকে পাওয়ার সাধনাই হচেছ ইসলামের শিক্ষা। আল্লাহ্ ইচছা করলে মানুষকে “সীমিত স্বাধীন ইচছা শক্তি”দান না করলেও পারতেন। তাহলে ফেরেশতা বা অন্যান্য জীবন্ত প্রাণীজগতের মত তাকে পরকালে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হতো না। কিন্তু স্রষ্টার পরিকল্পনা হচেছ মানুষের ইচছা শক্তিকে প্রশিক্ষিত করা,যেনো সে স্ব-ইচছায় স্রষ্টার ইচছার কাছে আত্মসর্ম্পন করে।” সুতরাং, আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে দুনিয়াতে কোন সমস্যাগ্রস্ত মানুষ ও সমস্যা কিছুই থাকতো না। তাহলে আমাদের জীবনটা পরীক্ষাও হতো না। তাই প্রতিকূলতার মধ্যেই দিনযাপন করতে করতে আমাদেরকে নিজ নিজ লক্ষ্য পানে ছুটে চলতে হবে। কি মুখ ভার হয়ে গেলো?
হেসে, আপনি কি করে বুঝলেন আমার মুখ ভার হয়েছে?
অধরা হেসে বলল, তুমি যে রাস্তায় চলছিলে আর আমি তোমাকে নিয়ে এলাম আরেক রাস্তায়। মুখ ভার হওয়া তো স্বাভাবিক। দেখো নিজের সাথে কিছুটা সময় একা কাটানো অবশ্যই উচিত সবার। কিন্তু মন যদি সবসময় একা থাকতে চায় সেটা শুধু অনুচিতই নয়, মনের এই চাওয়া অতি ভয়ংকর। একাকী মানে তার ভুলকে দেখার ও শুধরে দেবার কেউ নেই। আর এই দাবী কেউ করতে পারবে না যে অন্যের সাহায্য ছাড়াই সে নিজের দোষ-ত্রুটি সর্বাবস্থায় যাচাই বাছাই করতে পারে। সুতরাং, মন সর্বদা একা থাকতে চাইলে তাকে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে জনসম্মুখে নিয়ে আসতে হবে।
জুম্মি হাসতে হাসতে বলল, আপনি সত্যিই আরেক রাস্তায় চলে গিয়েছেন ম্যাম। আমি এভাবে ভাবিনি।
তাহলে এখন ভাবো। দেখো সমাজকে গড়তে হলে আগে নিজকে গড়তে হবে। আর একা একা কখনোই নিজকে গড়া সম্ভব নয়। কুরআন ও হাদীস থেকে জ্ঞানার্জন করতেও তোমার অন্যের সাহায্য প্রয়োজন হবে। আর তোমার মন যা কিছু কল্যাণকর ভাবছে, তার সবই যে তোমার জন্য কল্যাণকর হবে এমন তো কোন গ্যারান্টি নেই। সুতরাং, তোমার স্বাধীন ইচ্ছাকে বা চিন্তাকে বাঁধাগ্রস্ত করার মত কেউও থাকা দরকার পাশে। যাতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষন করা যায় নিজের চাওয়া গুলোকে। তাছাড়া জীবনে যা চাইবো তার সবই আমাকে পেতে হবে এমনো তো কোন নিয়ম নেই। কোন কিছু চাওয়ার পথে যদি কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তবে ধরে নেবে ঐটা তোমার প্রাপ্য ছিলই না। আর আমার অভিজ্ঞতা তো অন্য কথা বলে।
কি ম্যাম?
কোন কিছু মনে প্রাণে চাওয়ার পরও যখন আমরা সেটা পাই না। তার অর্থ হচ্ছে এরচেয়েও ভালো কিছু আমাদের জন্য প্রতীক্ষ মান। দেখো আমার মতে সন্ন্যাসী হওয়া মানে নিজের সংশোধনের পথ বন্ধ করে দেয়া। আর সংস্কার বিহীন কারো পক্ষে সমাজকে দেবার মত কিছু থাকতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। তাই আমাদেরকে সংসারের মাঝেই থাকতে হবে। এবং সব প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করতে করতেই নিজেকে গড়তে হবে এবং সমাজকে সাজানোর চেষ্টা করতে হবে। তাছাড়া জীবনটা আল্লাহর দেয়া এক আমানত আমাদের জন্য। এটাকে তাই অজ্ঞতা-অসন্তোষ ও আত্ম-অত্যাচারের দ্বারা নষ্ট করার কোন অধিকার আমাদের নেই। আর একমাত্র জ্ঞানার্জনের দ্বারাই মনে এই বোধের জন্ম হওয়া সম্ভব। মন ও মনন যদি সঠিক জ্ঞানের আলোতে আলোকিত না হয় তাহলে নিজেকে ঠিকভাবে দেখতে পারে না মানুষ।
আমি বুঝতে পেরেছি ম্যাম।
অধরা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। বুঝতে পারলে তো ভালো। আসলে কি জানো জীবন মাঝে মাঝে গোলকধাঁধার মত হাজির হয় আমাদের সামনে। সেই গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাওয়ার হাত থেকে বাঁচার একটাই উপায়। জ্ঞানার্জন করা। যত তোমার জ্ঞান বাড়বে তুমি বুঝে নিতে পারবে পরিস্থিতি অনুযায়ী করনীয়কে। যাইহোক, তুমি ভেবে দেখতে পারো আমার কথাগুলো। সবসময় যে আমার সব কথা তোমার পছন্দ হতেই হবে এমন কোন নিয়ম নেই। এখন তাহলে আমি রাখি। পরে কথা হবে আবার, ইনশাআল্লাহ।
জুম্মিকে বিদায় জানিয়ে আবার মেইল নিয়ে বসলো অধরা। মনের সৎ ইচ্ছা ও অসৎ ইচ্ছার একটা তালিকা বানিয়ে চোখের সামনে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। তাতে কোন ইচ্ছাকে আদর করে কাছে টেনে নেবে আর কোন ইচ্ছাকে জালিবেত দিয়ে সপাৎ সপাৎ দুটা লাগাতে হবে সেটা জানা থাকবে। নয়তো ভুল ইচ্ছারাও জীবনকে পরিণত করে দেয় স্বনির্মিত গোলকধাঁধায়। আর গোলকধাঁধা তৈরি হচ্ছে এই সচেতনতা যেহেতু থাকে না। নিজেকেই তখন ঘুরপাক খেতে হয় নিজের তৈরি গোলকধাঁধার মাঝে।
প্রথম মেইলটা ওপেন করতে করতে অধরা মনে মনে বলল, হে প্রভু রক্ষা করো মোরে নিজেই নিজের জন্য এমন গোলকধাঁধা তৈরি করা থেকে।