banner

মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫ ইং, ,

পোস্টটি 1098 বার পঠিত

 

জীবনে কেন শান্তি নেই

জীবনে কেন শান্তি নেই


ডা. মারুফ রায়হান খান


২০০৬ সাল, আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। ফুটবল বিশ্বকাপ চলছিল তখন। সেই ফুটবল বিশ্বকাপটা আমার জন্য খুব আনন্দের স্মৃতি হতে পারতো, কারণ আমার ফেভারিট টিম ইটালি সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। কিন্তু তা ঘিরে আমার আনন্দ নেই, বরং রয়েছে একরাশ বেদনা আর কান্না। কারণ সেই বিশ্বকাপটি চলার সময় আমার একজন বন্ধু আত্নহত্যা করে। হ্যাঁ, এই ১৪/১৫ বছরের মানুষটিই ফ্যানে দড়ি ঝুলিয়ে আত্নহত্যা করে। ও নাকি পড়াশোনা না করে খেলা দেখতো, বাবা-মা সে রাতে নাকি বেশ বকাঝকা করেছিলেন, বন্ধু আমার আর সে জীবন রাখার কোনো মানে খুঁজে পায়নি।

আমাদের এই প্রজন্মের অজস্র দিক আছে যেগুলো বেশ পজিটিভ কিন্তু একটা ভয়ঙ্কর রকমের অন্ধকার দিক আছে। আমরা বোধহয় খুব অল্পতেই ধৈর্য হারাই, এই অতি মূল্যবান জীবনটিকে আমরা মূল্যায়ন করতে পারি না, তার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি না, জীবনটিকে হয়তো ঠুনকো ভাবি কিছু থেকে কিছু হলেই–কী হবে আর এ জীবন রেখে। তার প্রমাণ পাই যখন আমরা জানতে পারি, কাউকে ‘পাখি ড্রেস’ কিনে দেওয়া হয়নি বলে আত্নহত্যা করে, প্রিয় দল আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিল খেলায় হেরেছে বলে ঐ দেশের হাজার হাজার মাইল দূরে বসবাসরত বাঙালি যুবক যখন তার জীবন বিনষ্ট করে ফেলে, প্রিয় মানুষকে না পেলে আত্নহত্যা করে ফেলে, বাবা-মা একটুখানি বকাঝকা করলে গলায় দড়ি দেয়, পরীক্ষায় একবার কাঙ্খিত সাফল্য না পেলে সে জীবন রাখার আর কোনো অর্থ খুঁজে পায় না। এসবের কারণ কি এটা হতে পারে যে, আমাদের জীবনের আসলে ব্রড কোনো ভিশন নেই, আমাদের স্পেক্ট্রাম অফ থিঙ্কিংটা ন্যারো?

আমার সাথে এটা প্রায় সবাই হয়তো নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেবেন যে, আমাদের প্রজন্মের একটা বিশাল অংশ মারাত্নক রকমের ডিপ্রেশানে ভোগে। জীবনটাতে যেন কোনো শান্তি নেই, স্বস্তি নেই, ছন্দ নেই। আমাদের ‘নেই’-এর পাল্লাটাই যেন খুব ভারী, ‘আছে’-এর পাল্লাতে যেন কিছুই নেই। বাস্তবতাটা কি আসলেই তাই?

আচ্ছা, এ লেখাটি যারা পড়ছেন তাদের মধ্যে এমন একজন মানুষও কি আছেন, যিনি সকালে খেতে পান না, দুপুরে খেতে পান না, রাতে খেতে পাবেন কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই? ডায়েট কন্ট্রোলের জন্যে না, খাওয়ার সামর্থ্য নেই সেজন্যে? মনে হয় না এমন কোনো পাঠক এখানে আছেন। আমি আপনাদের একটা জরিপ শোনাই। ২০১১ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক একটা জরিপ করে, সেখানে দেখা গেছে পৃথিবীতে প্রায় ১ বিলিয়ন মানুষ এরকম ‘Chronically hungry’ থাকে। পৃথিবীতে ৬ বিলিয়ন মানুষ আছে তার মধ্যে ১ বিলিয়নই এভাবে ক্রমাগত ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করে–প্রতি ৬ জনে ১ জন! এটা আমাদের প্রতি আল্লাহর কতো বড় রহমাত যে তিনি আমাদের অন্তত ৩ বেলা ভালোভাবে খাবার মতো তাওফিক দিয়েছেন।

ক্ষুধার কষ্ট যে কত বড় একটা কষ্ট, সেটা আমরা বুঝব না। বুঝেছিল ঐ পরিবারটা, বাংলাদেশেরই একটা পরিবার, দীপালিদের পরিবার। যে পরিবারে দুটো সন্তান; বড় মেয়ে আর ছোট ছেলে। সে পরিবারের নিয়ম ছিল দুপুরবেলা খাবে ছেলেটা আর রাতেরবেলা খাবে মেয়েটা। দুবেলা দুজন খেতে পারবে না, কারণ দুজনকে দুবেলা খাওয়ানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি পরিবারটির ছিল না। একদিন দুপুরবেলা ছেলেটি খেলো, রাত হলে তার আবার ক্ষুধা লেগে গেলো, অসহনীয় ক্ষুধা–ছেলেটি তার বোনের জন্য বরাদ্দকৃত রাতের খাবারটা খেয়ে ফেলে। সারাদিন ক্ষুধায় কষ্ট করেছে বোন, রাতের বেলায় যখন সে দেখলো তার খাবারটুকু নেই, রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে সে রাতে আত্নহত্যা করে বোন।

ক্ষুধার কষ্টটা আমরা বুঝব না। বোঝে ঐ মানুষটা, সোমালিয়ার ঐ মানুষটা, যিনি রমাদানে একজন স্কলারকে প্রশ্ন করেছিলেন–আমাদের সাহরিতে খাবার মতো কিছু নেই, ইফতারেও খাবার মতো কিছু নেই; আমাদের রোজাটা কি হবে?!

আমার স্মৃতিপটে প্রায়শই গাজার ১১ বছরের এক শিশুর একটা গায়ে শিহরণ জাগিয়ে দেয়া প্রশ্ন ভেসে ওঠে। ২০১৪ সালে লাস্ট এটাকের সময় ছেলেটি একজন স্কলারকে প্রশ্ন করে, এই যে এতো বোমা হামলা হচ্ছে এর মধ্যকার ডাস্ট পার্টিকলগুলো যে আমাদের নাক দিয়ে মুখ দিয়ে যাচ্ছে –আমাদের রোজাটা কি হবে!?

আচ্ছা এবার এ লেখার পাঠকদের জন্যে আরেকটি প্রশ্ন। আপনাদের মধ্যে এমন একজনও কি আছেন যিনি জন্মগ্রহণের পর তার মা ছিলেন না, বাবা ছিলেন না, এমনকি অন্য কোনো নিকটাত্মীয় ছিলেন না আপনাদের দেখাশোনা করার জন্য? একজনও বোধহয় নেই। আপনি শুনে অবাক হবেন, ইউনিসেফের এক জরিপে উঠে এসেছে পৃথিবীতে ২২০ মিলিয়ন, দুইশত বিশ মিলিয়ন শিশু আছে যারা জন্মের পরে তাদের মা পায়নি, বাবা পায়নি, এমনকি কোনো নিকটাত্নীয় ছিল না তাদের দেখাশোনা করার জন্যে।

তবুও নাকি আমাদের জীবনটাতে কোনো শান্তি নেই, সুখ নেই, স্বস্তি নেই, ছন্দ নেই…

আমি বছর কয়েক আগে একটা পত্রিকায় সম্পাদনার কাজের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে বার্ণ ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ডা. সামন্ত লাল সেন স্যারের একটা সাক্ষাতকার পড়ছিলাম। সেখানে তিনি বলেছেন, তার মেয়ের ছোটবেলায় একবার মিজেলস (হাম) রোগ হয়েছিল, তারপর রোগ সারলেও চেহারায় দাগ পড়ে যায়। তার মেয়ের মনে খুব দুঃখ ছিল মুখে এই দাগের জন্য। তো একবার প্রফেসর সামন্ত লাল স্যার তার কাছে আসা আগুনে দগ্ধ হয়ে যাওয়া একটি মেয়ের ছবি তুলে এনে তার মেয়েকে দেখালেন। মেয়ে এবার অনুধাবন করলেন অন্য অনেকের চাইতে তিনি অনেক ভালো আছেন। তার বাবাকে বললেন, আমার চেহারার দাগ দূর করতে হবে না, তুমি বরং এই মেয়েটিকেই চিকিৎসা করো।

আসলে আমরা যখন আমাদের অবস্থানের চাইতে নিচের কারও দিকে তাকাব, তখন এই জীবনটাই আমাদের কাছে অনেক বেশি সুখের মনে হবে, অনেক মূল্যবান মনে হবে। সত্যি বলতে কী পৃথিবীতে অজস্র মানুষ আছে যারা আমাদের মতো একটা জীবন পেলে বর্তে যেতো, ধন্য হয়ে যেতো।

আরেকজন বিখ্যাত ব্যক্তির সাক্ষাতকারের জন্য কাজ করেছিলাম, তিনি হচ্ছেন প্রফেসর ডা. শুভাগত চৌধুরী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিষয়ক যারা লেখালেখি করেন, তিনিই বোধহয় সবচেয়ে এগিয়ে আছেন, ৪০ টি বই উনার। তিনি তার সাফল্যের কথা বলছিলেন, তিনি জীবনে যতটুকু পেয়েছেন, তাই নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। তার অন্য বন্ধুরা কে কতো দ্রুত কতোটা এগিয়ে গেলো এসব নিয়ে তিনি কখনও চিন্তিত ছিলেন না। নিজের যতোটুকু আছে, তাই নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। একজন বিখ্যাত স্কলার ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র.)-এর একটি চমৎকার  বাণী আছে, “Contentment is the paradise of this world.” অর্থাৎ, এই পৃথিবীর জান্নাত হচ্ছে সন্তুষ্টি। আমাদের যতোটুকু যা আছে তাই নিয়ে যদি আমরা পরিতুষ্ট থাকতে পারি, আমাদের জীবন সুখে ভরে উঠবে।

আমাদের মধ্যে একটা ব্যাপার খুব অহরহই দেখা যায়। আমাদের চলার পথে, সামনে এগোবার পথে কোথাও যদি বাধা চলে আসে, তবে আমরা সেখানেই হাল ছেড়ে দিই, নিরাশ হয়ে পড়ি। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করে দেখুন, পৃথিবীতে যারাই বড় হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের জীবনেই কিন্তু অনেক স্ট্রাগল ছিল। পৃথিবীর বুকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ যিনি, সেই মুহাম্মাদ (স.) এর কথাই ধরা যাক। আমরা সবাই জানি তার মিশনের প্রাথমিক পর্যায়ে তাকে কতোটা বাধা-বিপত্তি-অত্যাচার-নিগ্রহ সইতে হয়েছিল। তিনি হাল ছেড়ে নিরাশ হয়ে যাননি, তার মিশন থামিয়ে দেননি–আজ পৃথিবীতে কোটি কোটি অনুসারী তাঁর। এন্ড্রু কার্নেগীর কথা বলতে পারি আমরা, যাকে নোংরা পোষাকের জন্য পার্কে ঢুকতে দেওয়া হয়নি,  ৩০ বছর পর সেই এন্ড্রু কার্নেগীই পুরো পার্কটি কিনে ফেলেন এবং সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেন “সবার জন্য উন্মুক্ত “। বহুল জনপ্রিয় স্টিভ জবসের কথা বলা যেতে পারে, ৭ মাইল দূরের এক গির্জাতে প্রতি রবিবার ভালো খাবার-দাবারের ব্যবস্থা ছিল। সারা সপ্তাহ তার ভালো খাওয়া-দাওয়া করার মতো আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। তাই প্রতি রবিবার তিনি পায়ে হেঁটে ৭ মাইল দূরের গির্জাতে যেতেন এক বেলা ভালো খাবার জন্য।

আমি বেশ কিছুদিন আগে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ডিপ্রেশানের উপর একটা সেমিনারে গিয়েছিলাম। সেখানে যিনি স্পিকার ছিলেন তিনি খুব সুন্দর করে ডিপ্রেশান কাটানোর একটা সহজ বুদ্ধি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আর তা হচ্ছে অন্য মানুষের জন্য কিছু করা, তাদের উপকারে নিজেকে নিয়োজিত রাখা। এখন তো আমাদের দেশে বিভিন্ন রকমের স্বেচ্ছাসেবামূলক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে –শীতবস্ত্র বিতরণ, বন্যা দুর্গতদের সহায়তা, স্বেচ্ছায় রক্তদান, দুস্থদের খাদ্য বণ্টন, হেলথ ক্যাম্পেইন আরও কত কী। এসবের সাথে যদি আমরা নিজেদেরকে জড়িত করে নিতে পারি তবে জীবন নিয়ে খুব বেশি হতাশামূলক চিন্তাভাবনা করার সময়টা আমরা পাব না।

ওখানে আরেকটা জিনিস শিখেছিলাম যারা নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট, কৃতজ্ঞ, তাদের কর্টিসল হরমোন (স্ট্রেস হরমোন নামে পরিচিত)  লেভেলটা কম থাকে তুলনামূলকভাবে। তারা বেশি সুখী থাকেন। আসুন না আমরা আমাদের চারপাশের সবার প্রতি কৃতজ্ঞ হই, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি আমাদের স্রষ্টার প্রতি, মা-বাবার প্রতি, আত্নীয়-পরিজনের প্রতি, বন্ধু-বান্ধবের প্রতি। আপনার জীবন সুখী হোক।

ডা. মারুফ রায়হান খান

এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)

বসুন্ধরা কোভিড হসপিটাল

 

 

Facebook Comments