তাহেরা সুলতানা
শেষ পর্যন্ত সামান্য জমানো টাকা আর কিছু ধার-দেনা করে চাঁদনীকে নিয়ে রাফিয়া আর বাশার ঢাকার পথে রওয়ানা হলো। ততদিনে চাঁদনীর ছোট্ট শরীরটা শুকিয়ে একটা পুটলির মতো হয়ে গেছে। কোন প্রাণ নেই যেন! সারাক্ষণ অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে রাখতে হচ্ছে।
ঢাকায় এসে ওরা প্রথমেই ঢাকা মেডিকেলের শিশু বিভাগে গেল। সেখানে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ পেসেন্ট এর এই অবস্থা দেখে দ্রুত ভর্তি করিয়ে নিলো।
ডাঃ এর সব রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশন দেখে উনার মুখটা থমথমে হয়ে গেলো। আরও কিছু টেস্ট এর কথা বলে ভিতরে চলে গেলো। বাশার ডাঃ এর মুখ দেখে বেশ খারাপ কিছুই আঁচ করলো, কিন্তু রাফিয়াকে কিছু বুঝতে দিলো না। কিন্ত বুকের ভিতরটা যেন ধক করে উঠলো।
অনেকক্ষণ ডাঃ, নার্স কাউকে দেখতে না পেয়ে রাফিয়া কাঁদতে কাঁদতে বাশারকে
জিজ্ঞেস করলো, -আচ্ছা, রুমের মদ্যি এতোক্ষণ ধইরে কি করছে? মেয়ে ডারে দেখতিও তো দেচ্চে না। আমার কিন্তু কিছুই ভালো ঠ্যাকছে না! তুমি এট্টু দেকনা গো!
বাশার এক ধমক দিয়ে বসিয়ে দিয়ে বললো, তুমি চুপ কইরে বসি থাকো। ডাঃ তো দেখতিসে। তুমি কি ডাঃ এতো কতা কচ্চ? মাইয়ে ভালো হইয়ে যাবিনে। তুমি বসি বসি খালি দুয়া পড়।
লাস্টের কথাগুলো বলার সময় বাশারের গলাটা যে ধরে আসছিল, সেটা কিন্তু রাফিয়ার চোখ এড়ালো না।
এভাবে ৭ দিন কেটে গেল। হাতে যা টাকা ছিল, তাও শেষ। কিন্তু চাঁদনীর অবস্থার কোন উন্নতি না হয়ে আরও অবনতি হলো। এখানকার ডাঃ ও ফিরিয়ে দিলো। বললো,
-দ্রুত ইন্ডিয়া নিয়ে যান। এখানে আর সম্ভব না। আপনারা আগে যে ডাঃ দেখিয়ে ছিলেন, উনারা ভুল চিকিৎসা করেছে। বাচ্চার ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছে। অনেকটা জায়গায় ইফেক্ট করেছে।
বাশার ধপাশ করে চেয়ারে বসে পড়লো। ভাগ্য ভালো, রাফিয়া তখন রুমের বাইরে ছিল, বাশার মনে মনে ভাবলো।
বাড়ি পৌছানো পর্যন্ত বাশার রাফিয়াকে কিচ্ছু বললো না। কি বা বলবে! ইন্ডিয়া গিয়ে চিকিৎসা করানোর মতো ক্ষমতা তো তার নাই।
সারাটা রাস্তায় বাশার থমথমে মুখ করে থাকলো। কয়েকবার জিজ্ঞেসও করেছে, ডাঃ কি বললো। অন্য কথা বলে এড়িয়ে গেছে। সঠিক কোন উত্তর পায়নি। উত্তরটা জানতে পারলো পরদিন সকালে, ফুফুর চিৎকার চেঁচামেচিতে।
-আমাগেইরে এতো তালুক নেই যে, ভারতে লিয়ে গিয়ে চিকিৎসে করাতি হবি! বাপের বাড়ি থেইকে আনতি ক! নয়তে যা হবার তাই হবি! আমরা আর পারছিনে! বিয়ের সময় আমার ভাই খালি মেয়েডারেই গছিয়ে দেল! কিছু দিয়েছে নাকি? কি কুলক্ষণেই যে এই অপয়া মাইয়েডারে ঘরের বউ কইরে আনতি গিলাম!
ওর মা একডা….
বাকি কথা আর রাফিয়ার কান পর্যন্ত পৌছালো না। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো।
রাফিয়া চোখ খুলে দেখলো, বাশার মাথার পাশে বসা। হঠাৎ মেয়ের কথা মনে পড়ায় লাফিয়ে উঠে বসলো। বাশার বুঝতে পেরে বললো,
-চাঁদনীক খুজতিছো? মার ঘরে রেকে আইছি। তুমি মাথা ঘুইরে পইড়ে গেলা। আমি তখন তুমারে লিয়া বেস্ত। অক্সিজেন মাস্ক এট্টু পর পর খুলতি হচ্ছে, তাই ভাইবলেম, মার কাছি ভালো থাকপেনে। আমি ভালো কইরে শিখিয়ে দিয়ে এইসেছি। একন সবারি মাতা গরম। তুমি মার কতায়….
বাকি কথা রাফিয়ার কানে আর গেলল না। সে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে পড়লো, এরপর ফুফুর ঘরের দিকে ছুটলো। আজকাল তার কাউকে বিশ্বাস হয় না।
ঘরে ফুফুকে পেলো না। ডাঃ ১০ মিনিট পর পর বিরতি দিয়ে মাস্ক পরাতে বলেছে। শ্বাস-প্রশ্বাস অবজার্ভ করতে বলছে, কিছুই তো হয়নি। ওইভাবে ছুটতে দেখে বাশারও পিছন পিছন চলে আসছে। রাগে গজগজ করে বললো,
-তুমি আমার মারে সন্দেহ করতিচো? আমার মায়ে মাইয়েরে মাইরে ফেলবি, এই ভাবতিছ? ছি! ছি! ছি!
রাফিয়া কাঁদতে কাঁদতে বাশারের পায়ে ধরে বললো,
-আস্তে কতা কও। মা শুইনে ফেললি লংকাকান্ড বেধে যাবিনে। আমি সেকতা কচ্চিনা গো। মেয়েডারে না দেকতি পেয়ে ছুটি চলি আইচি। তোমার পায়ে ধরি কচ্চি, তুমি চুপ করো। চুপ করো।
বাবার সাথে ফুফুর সম্পর্কে চরম টানাপোড়ন চলছে। তাও রাফিয়ার আর নাতনীর কথা ভেবে বাবা-মা ২জনই চলে আসলো। রাফিয়ার মুখে সব কথা শুনে বাবা যেটুকু জমি ছিল, তা বেচে দিয়ে টাকাটা বাশারকে দিয়ে দিলো। আর বললো,
– বাবা, আমার নাতনীর চিকিৎসে বাবদ যা লাগবি, আমিই দেব, তুমি যাওয়ার ব্যবস্থা করো। লাগলি, ভিটেবাড়িও বেইচে দেব। তাও আমার নাতনী যেন সুস্থ্য হইয়ে আসে।
রাফিয়া বাবার পায়ের কাছে বসে অনবরত কাঁদতে লাগলো।
বাশার ইন্টারনেট ঘেটে ভারতের ভেলরে একজন নামকরা শিশু বিশেষজ্ঞ এর খোজ পেল। কিন্তু সিরিয়াল পেল এক মাস পর। এরপর ঢাকার ডাঃ এর মাধ্যমে সেটা এক সপ্তাহ কমিয়ে আনতে পারলো।
এর ওর মাধ্যমে টাকা খাইয়ে যথাসময়ে ভিসা আর ট্রেইনের টিকেটও করে ফেললো। বেনাপোল কাছে হওয়ায় ট্রেইনেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
ভেলর হাসপাতালের প্রধান শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ দীনেশ পান্ডে (ছদ্মনাম) পুরো একদিন ধরে সমস্ত রিপোর্ট আর
প্রেসক্রিপশনগুলো নিয়ে গবেষণা করলো। বাশার আর রাফিয়া কাজিন শুনে ওদের ব্লাডগ্রুপের রিপোর্ট চাইল। বাশার শুধু রাফিয়ার টা বলতে পারলো। কারন ওর নিজের ব্লাডগ্রুপ কি, সে নিজেও জানে না। বাশারের ব্লাডটেস্ট রিপোর্ট এ আসলো, ওর ব্লাডগ্রুপ O(+) আর রাফিয়ার O(-)।
রাফিয়ার ডেলিভারির সময় Anti D ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছে কিনা, সেটা সম্পর্কে জানতে চাইলো। বাশার মাথা নেড়ে জানালো, দেয়া হয়েছে। কতক্ষণ পর দেয়া হয়েছে, জানতে চাওয়া হলে, বাশার সঠিক উত্তর দিতে পারলো না। তবে ডাঃ কনফার্ম হয়ে গেলো, নির্দিষ্ট সময়ের থেকে কিছুটা পার হয়ে গিয়েছিল।
চাঁদনীকে ২৪ ঘন্টা অবজারভেশনে রেখে এবং টোটাল কেস হিস্টরী গবেষণা করে ডাঃ বাশার আর রাফিয়াকে ইচ্ছেমত কতক্ষণ বকলো। এরপর যে রেজাল্ট দিলো, তা হলো,
১। Anti D ইঞ্জেকশন ৭২ ঘন্টার মধ্যে দেয়া হয়নি বলে
পেসেন্ট এর Antibody তৈরি বাধাগ্রস্থ হয়েছে। কারণ তার ব্লাডগ্রুপ O(+)। মায়ের উল্টো।
২। নিয়মোনিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার পর এতোটুকু বাচ্চাকে যে এন্টিবায়োটিক আর যে ওষুধ পুশ করা হয়েছে, তাতে পেসেন্ট এর ফুসফুস ৭০% ড্যামেজ হয়ে গেছে।
৩। একদিকে পেসেন্টের Antibody তৈরি বাধাগ্রস্থ হওয়া এবং অনেক বেশি হাই পাওয়ার ইঞ্জেকশন পুশ করার কারনে পেসেন্ট পুরোই এবনরমালিটির দিকে যাচ্ছে। ডাঃ দের হাতে আর কিচ্ছু করার নেই।
বাশার ইচ্ছে করেই রাফিয়াকে ডাঃ এর চেম্বারে আনেনি। সব শুনে সে ডাঃ এর পায়ে ধরতে গেল। ডাঃ “কি করছেন? কি করছেন?” বলে পা ছাড়িয়ে নিলেন।এরপর বাশার হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-প্লিজ ডাঃ, আমার মেয়েটাকে ভালো করে দিন। আমার মেয়েটাকে বাচান। যতটাকা লাগে দিবো।
ডাঃ আস্তে করে ঘাড়ে হাত দিয়ে বললেন,
-আমার কাছে আসতে অনেক দেরী করে ফেলেছেন। উপরওয়ালাকে ডাকুন, তিনি যদি কিছু করতে পারেন।
একদম শুন্য হাতে ওরা মেয়েটাকে নিয়ে দেশে ফিরে আসলো। ভেলর থেকে আসার পর থেকেই রাফিয়া কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। খায় না, ঘুমায় না, পাথর হয়ে মেয়ের শিয়রে বসে থাকে। বাশার আবার অফিস শুরু করেছে। অনেক কাজের চাপ! এ অবস্থা দেখে রাফিয়ার বাবা মা তাদের কাছে নিয়ে গেলো। প্রথম প্রথম বাশার প্রতি বৃহঃস্পতি আসতো। আবার রবিবার গিয়ে অফিস করতো। আজকাল আসা কমিয়ে দিয়েছে। রাফিয়ার মধ্যে আজকাল কোন অনুভুতিই কাজ করে না। প্রয়োজন না হলে মেয়ের কাছ থেকে উঠেই না। যদি একবার চোখ মেলে দেখে! যদি একবার মা বলে ডাকে!
দিন যায়। মাস যায়। বছরও চলে যায়। কবিরাজি, হোমিওপ্যাথিও বাদ দেয় না। তাতেও যদি মেয়েটা ভালো হয়! যে যা বলে, তাই করে। আজকাল বাশার তেমন একটা আসেও না। মাঝে মাঝে ফোন করে দায়শারা গোসে খোঁজ নেয়।
চাঁদনীর বয়স যেদিন ২ বছর হয়ে ৩ মাসে পড়ে, সেদিন সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায়। চাঁদনীকে শেষ দেখা দেখতে বাশার আর ওর মা এসেছিল। কিন্তু সেদিন রাফিয়া মেয়েকে কারও কাছে দেয়নি। পাথরের মতো কোলে নিয়ে বসেছিল। এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলেনি। মেয়েকে কবরই দিতে দিচ্ছিল না। পরে সবাই জোড় করে নিয়ে যায়। সবাই মিলে ওকে কাঁদানোর অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু কোন লাভ হয় না। কিভাবে কাঁদবে? চোখে আর পানি থাকলে তো বের হবে?
এর এক মাস পর কেউ এসে খবর দিলো, বাশারের মা মাশারের আবার বিয়ে ঠিক করেছে। রাফিয়া এক দৃষ্টিতে বার্তা বাহকের দিকে তাকিয়ে থাকলো। হাত দুটো খাটের ডাসার সাথে বাধা। সুযোগ পেলেই নাকি কবর খুড়তে যাচ্ছে। মেয়েকে তুলে আনবে। তাই এই ব্যবস্থা। হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলো। হাসি যেন আর থামছেই না। কতকাল হাসেনি, না! আজ তাই অনেক হাসি পাচ্ছে। প্রাণখুলে হেসেই যাচ্ছে। হা হা হা! হি হি হি! হো হো হো!
পুনঃশ্চ: বন্ধুরা, ইহাকে নিতান্তই একটা গল্প মনে করিয়া ভুল করিবেন না। ইহা একটি অতীব সত্য ঘটনা। যাহা আমার চোখের সামনে ঘটিয়াছে।