প্রথম আলো পত্রিকায় “জাপানের মা, জাপানের সন্তান (প্যারেন্টিং)” নামে চমৎকার একটা আর্টিকেল বের হয়। সেই আর্টিকেলটায় তুলে ধরা হল।
জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর পড়াশোনা করেছি। এ সময় নানা রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমি জাপানি ভাষা বেশ ভালোভাবে শেখায় তাদের অনেক কাছাকাছি যেতে পেরেছিলাম।
অবাক হয়েছি সন্তানদের প্রতি জাপানি মায়েদের আদর-ভালোবাসা দেখে। সন্তান জন্মের আগে থেকেই সন্তানকে
♦কীভাবে লালন-পালন করতে হবে,
♦তাকে কী খাওয়াতে হবে,
♦কোন ঋতুতে কী ধরনের পোশাক পরাতে হবে,
♦ছোটখাটো সমস্যা হলে বাড়িতে বসেই কী করে তার সহজ সমাধান করতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে জানার চেষ্টা করেন।
জাপানে বেশির ভাগ লোক শিক্ষিত, তাই তাদের জন্য এটি করা সহজ।
মায়ের বুকের দুধ যে শিশুর জন্য একমাত্র উপযোগী খাবার- তা জাপানি মায়েরাও মেনে চলেন। কর্মজীবী মায়েরা বিরতির সময় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে গিয়ে শিশুকে বুকের দুধ খাইয়ে আসেন। বেশি দূরে হলে বুকের দুধ প্যাকেট করে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে রেখে আসেন। আমি জাপানের চিকিৎসক মায়েদেরও এমনটি করতে দেখেছি।
বেশির ভাগ বাড়িতে দেখেছি দাদা-দাদি থাকেন। কোনো কোনো বাড়িতে দাদা বা দাদির একজন থাকছেন। পরিবারের সব সদস্য বয়স্কদের দিকে খেয়াল রাখেন। সন্তান যদি মায়ের কাছে থাকতে না পারেন তার দেখাশোনা করার উপযোগী কর্মী রেখে দেন।
আরেকটি বিষয় আমার খুব ভালো লেগেছে। এক বছর বয়স হওয়ার আগেই শিশুরা জাপানে পাবলিক লাইব্রেরির সদস্য হতে পারে। মা তার সন্তানের নামে প্রতি সপ্তাহে তিনটি বই ধার করতে পারেন। একটু বড় হওয়ার পর মা সন্তানকে নিয়মিত লাইব্রেরিতে নিয়ে আসেন। গল্প ও ছবির বই পড়ে শোনান। হাঁটিহাঁটি পা পা করছে এমন শিশুও দেখেছি সেলফ থেকে নিজের পছন্দমতো ছবি অথবা ছড়া গল্পের বই এনে মায়ের হাতে দিচ্ছে পড়ে দেওয়ার জন্য।
এভাবে বইয়ের প্রতি খুব ছোটবেলা থেকে একটা আগ্রহ সৃষ্টি হয়ে যায়। ছুটির দিনে লাইব্রেরিতে ছোটদের রূপকথার গল্প বলার জন্য কর্মী থাকেন। শুধু তাই নয়, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে যেসব শিশু থাকে, তাদেরও বই পড়ে শোনানো হয়। তিন বছর বয়স হলে প্রতি মাসে বাধ্যতামূলক একটি করে বই কিনতে হয়। ছোটবেলা থেকে এই আগ্রহ জন্মায় বলেই হয়তো বাস বা ট্রেনের জন্য অযথা বসে না থেকে বই পড়তে দেখেছি ওদের।
স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে মায়েরা শিশুকে শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে ওঠা-বসা, আচার-ব্যবহার, আদব-কায়দা (বড়দের সঙ্গে শ্রদ্ধাভরে কথা বলা এবং ভক্তি করা জাপানি সমাজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য) নিজ হাতে খাওয়া ও নিজে বাথরুমে যাওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।
জাপানে মনে করা হয় যে প্রতিটি ভালো ছাত্রের পেছনে একজন নিবেদিত মা থাকেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি নিজে নিয়মিত সন্তানকে পার্কে, সাঁতারের ক্লাসে এবং পিয়ানো অথবা নৃত্যের ক্লাসে নিয়ে যান। মা রাতে সবার পরে বিছানায় যান কিন্তু ভোরে ওঠেন সবার আগে। কারণ প্রত্যেকের পছন্দমাফিক আলাদা টিফিনবাক্স প্রস্তুত করার জন্য তার বেশ সময় প্রয়োজন হয়।
তিনি খুব সতর্কতার সঙ্গে সন্তানের স্কুল এবং গ্রুপ কোচিং নির্বাচন করেন।
কাজ থেকে ফিরে বাড়ির কাজে সাহায্য করেন, ভালো বইয়ের খোঁজ রাখেন। প্রয়োজনে সন্তানের জন্য আরও বেশি কাজ করেন। যাতে সন্তানের পড়তে কষ্ট না হয়। সে জন্য জাপানি মাকে যথার্থই ‘কিউইকু মামা’ অর্থাৎ ‘অ্যাকাডেমিক মাদার’ বলা হয়ে থাকে।
সৌজন্যেঃ দৈনিক প্রথম আলো & মহীয়সী
ডা. লুৎফুন নাহার
লেখক: চর্ম, অ্যালার্জি ও লেজার বিশেষজ্ঞ সেন্ট্রাল হাসপাতাল, গ্রিনরোড, ঢাকা