দেড় মাস ধরে ভারতের আসাম রাজ্যের শিশু আশ্রমে আছে ছয় বছরের শিশু রনি। টেলিফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলে সে। ফিরতে চায় মায়ের কাছে। ছয় বছরের রনি কোনো নিয়ম বোঝে না। মাকে সে বলে, ‘মা মুই তোর কাছে যাইম, মোক বাড়িত নিয়া যাও।’
গতকাল রোববার দুপুর ১২টার দিকে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের কুরুসা ফেরুসা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আশ্রম থেকে স্থানীয় এক বাসিন্দার মাধ্যমে মুঠোফোনে মায়ের কাছে ফোন করেছে শিশুটি। ছেলের আকুতি শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মা। পাশেই ছিলেন রনির বাবা জয়নাল আবেদীন (৩০)। চোখের পানি মুছে বলেন, দেড় মাস ধরে ছেলেটা আসামের একটি আশ্রমে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি দুই দেশের সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই হামার ছাওয়াক আনি দেও। তানা হইলে ওর মাকে বাঁচানো যাবে না।’
রনি কীভাবে আসামের ওই আশ্রয়ে গেল, এ ব্যাপারে বাবা জয়নালের দেওয়া ভাষ্য, এলাকায় রিকশা চালাতেন তিনি। সংসারের অভাব লেগেই থাকত। তাই বাধ্য হয়ে প্রায় পাঁচ বছর আগে এক দালালের মাধ্যমে অবৈধপথে ছয় মাসের শিশু রনিকে নিয়ে ভারতে চলে যান। দিল্লির ঝরঝর জেলার শনিপথ থানার খরগোদা গ্রামে দূর্গা নামের একটি ইটভাটায় স্বামী-স্ত্রী দুজনে কাজ শুরু করেন। সেখানে তাঁদের আরও দুটি মেয়ের জন্ম হয়। তাদের নাম জান্নাতী (৪) ও জেসমিন (দেড় বছর)। এর মধ্যে বড় হয়ে যায় রনি। রনিকে বাংলাদেশের স্কুলে ভর্তি করানোর কথা ভাবেন তাঁরা।
ছেলেকে বাংলাদেশে পাঠাতে আবার দালালের কাছে যান জয়নাল। তাঁর ভাষ্য, সীমান্ত পারাপারের ভারতীয় দালাল মইনুদ্দিনের মাধ্যমে তিনি আসাম রাজ্যের ধুবড়ি জেলার টাকিমারী সীমান্ত দিয়ে রনিকে দেশে তার দাদা-দাদির উদ্দেশে পাঠিয়ে দেন। গত ১১ এপ্রিল টাকিমারী সীমান্ত পার হওয়ার সময় ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যরা মইনুদ্দিন ও রনিকে ধরে ফেলে। মইনুদ্দিন কৌশলে পালিয়ে যান। রনি বিএসএফের কাছে আটকা পড়ে।
জয়নালের তথ্যমতে, খবর পেয়ে রনির দাদা হজরত আলী কুড়িগ্রাম ৪৫ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অধীন চৌদ্দকুড়ি বিজিবি ক্যাম্পে এ ঘটনার কথা জানান। বিজিবি আটক হওয়া রনিকে ফেরত চেয়ে টাকিমারী বিএসএফ ক্যাম্পে চিঠি পাঠায়। এ পর্যন্ত তিন দফা পতাকা বৈঠক হয়েছে। কিন্তু রনিকে ফেরত দেওয়া হয়নি। মাস খানেক আগে দেশে ফিরে এসেছেন রনির মা-বাবা।
এ ব্যাপারে রনির দাদা হজরত আলীর ভাষ্য, যখন জানতে পারেন বিএসএফ তাঁর নাতিকে নিয়ে গেছে, তখন চৌদ্দকুড়ি বিজিবি ক্যাম্পে ঘটনাটি জানান। সেখানে প্রথম পতাকা বৈঠক হয়। ওইদিন বিএসএফ তাঁকে বলেছে যে রনিকে ফেরত পেতে হলে তার বাবা-মাকে উপস্থিত হতে হবে। বিষয়টি জানার পর রনির মা-বাবা নানা কৌশলে ভারত থেকে দেশে ফিরে আসেন। বিএসএফের দাবি অনুযায়ী রনির মা-বাবাসহ স্থানীয় ইউপি সদস্যকে নিয়ে তাঁরা দ্বিতীয় দফা পতাকা বৈঠকে যান। বৈঠকে বিএসএফ শিশুকে ফেরত না দিয়ে জানায়, রনির বাবা-মার রক্ত পরীক্ষার কাগজপত্র, জাতীয় ভোটার আইডি কার্ড, রনির ছবি ও জন্মনিবন্ধন কার্ড লাগবে। সেগুলো নিয়ে গেলে রনিকে ফেরত দেওয়া হবে।
তৃতীয় দফা পতাকা বৈঠকে সপরিবারে কাগজপত্রসহ গেলে টাকিমারী ক্যাম্পের বিএসএফ জানায়, রনি আসামের ধুবরীর একটি শিশু আশ্রমে আছে। তাঁকে পেতে হলে আরও ওপর মহলে যোগাযোগ করতে হবে।
রনির দাদা হজরত আলীর ভাষ্য, রনিকে ফেরত না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। এ সময় আবু তালেব নামের এক ব্যক্তি টাকার বিনিময়ে রনিকে ফিরিয়ে দেবেন বলে আশ্বাস দেন। তাঁর বাড়ি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার কচাকাটা ইউনিয়নের জালিরচর গ্রামে। রনিকে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চার দফায় ১১ হাজার টাকা হাতিয়ে তিনি পালিয়ে যান।
ফুলবাড়ী নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য শান্তাদুল ইসলামের ভাষ্য, তিনি তৃতীয় দফা পতাকা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বিএসএফের কাছে রনির বাবা-মা, দাদার রক্ত পরীক্ষার প্রতিবেদন, ভোটার আইডি কার্ড, ছবি সবই দেওয়া হয়। কিন্তু রনিকে ফেরত দেওয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে বিজিবির দইখাওয়া ক্যাম্পের হাবিলদার আলী আহম্মেদের ভাষ্য, শিশু রনিকে ফেরত চেয়ে বিজিবির পক্ষ থেকে বিএসএফকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিন দফা পতাকা বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন। শিশুটির বাবা-মা ও দাদার রক্ত পরীক্ষার প্রতিবেদন, ছবি, ভোটার আইডি কার্ডসহ প্রয়োজনীয় সব তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু বিএসএফ শিশুটিকে ফেরত দেয়নি। এখনো যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।
সূত্র-প্রথম আলো।