রেহনুমা বিনত আনিস
সবাই খেতে বসে। সামিয়ার শ্বশুর টেবিলের মাথায়, একপাশে স্ত্রী একপাশে বড়ছেলে, স্ত্রীর পাশে ছোটছেলে, মারযান অভ্যাসবশত বড় ভাইয়ের পাশে বসতে গিয়ে জিভ কেটে উঠে দাঁড়ায়, সামিয়াকে হাত ধরে টেনে এনে বলে, ‘আরে ভাবী, এটা তো তোমার জায়গা!’ ওর আত্মত্যাগ সামিয়ার দৃষ্টি এড়ায়না। সে আপত্তি জানালে মারযান চোখ টিপে বলে, ‘টেবিলের মাথায় বসার শখ আমার বহুদিনের। তুমি আসতে দেরী করছিলে বলেই তো এতদিন বসতে পারিনি। এখনও যদি বসতে না দাও!’ আসিয়া রুটি নিয়ে সবার প্লেটে দিতে শুরু করেন, মাসরুর আলুভাজি বেড়ে দিতে থাকে। আনোয়ারা প্রথম রুটিটা দেন স্বামীকে, তারপর সামিয়াকে, তারপর ক্রমান্বয়ে তাঁর তিন সন্তানকে, সব শেষে নেন নিজের পাতে, ছেলেও তাঁকে অনুসরন করে। সামিয়া একটু লজ্জাই পায়, কিন্তু এই পরিবারে সবার পরার্থপরতা ওকে মুগ্ধ করে। খাবার বাড়া শেষ হতেই শুরু হয় গল্প। শ্বশুর সাহেব প্রথম শুরু করেন সামিয়ার বাসায় নাস্তায় কি খাওয়া হয়, ক’টায় নাস্তা খাওয়া হয় ইত্যাদি প্রশ্ন দিয়ে। উত্তর দিতে দিতে সামিয়া খেয়াল করে শাশুড়ি শ্বশুরের প্লেটের দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলেন, সম্ভবত রুটি ছিঁড়ে দেয়ার জন্য, কিন্তু মাসরুরের চোখের ইশারায় তিনি আবার হাত সরিয়ে নেন।
খাওয়া শেষে মাসরুর আর মাসউদ আগের পদ্ধতিতেই বাবাকে নিয়ে যায় সামনের আঙ্গিনায়, ফুলবাগানে হাঁটতে। মারযান বলে, ‘চল ভাবী, তোমার জিনিসগুলো স্যুটেকেস থেকে আলমারীতে তুলতে সাহায্য করি’। কিন্তু শাশুড়ি বলেন, ‘আমাকেও কিছু কথা বলার সুযোগ দিবি তো! মেয়েটা এসেই লেগে গেল রান্নাঘরে! তুই যা, নিজের রুম গুছিয়ে এসে তোর ভাবীকে নিয়ে যা’।
মারযান চলে গেলে তিনি সামিয়াকে বললেন, ‘শোন মা, তুমি আমার কাছে আমার তিনটা সন্তানের চেয়ে আলাদা নও। তুমি আসার আগেও ত্রিশ বছর আমার সংসারের সব কাজকর্ম চলেছে, আরো কিছুদিন এভাবে চললে কোন ক্ষতি নেই। এখন তোমার প্রয়োজন ঘরের সবার সাথে বন্ধুত্ব করার, সবার পছন্দ অপছন্দ বুঝে নেয়ার, আমাদের তোমার পছন্দ অপছন্দ বুঝার সুযোগ দেয়ার, বিশেষ করে মাসরুরের সাথে অ্যাডজাস্ট করার’।
নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় তাঁর, ‘আট বছর আগে মাসরুরের বাবা ব্যাবসায় বিরাট লস করেন। কিন্তু নিজের ক্ষতির চাইতেও তাকে পীড়া দিতে থাকে শেয়ার হোল্ডারদের লস, কর্মচারীদের কি হবে এইসব ভাবনা। একদিন সারারাত চিন্তা করার পর সকালে উঠে দেখেন আর হাতপা নাড়তে পারছেন না। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ওরা বলল রাতে কোন একসময় স্ট্রোক হয়েছে, বেঁচে আছেন এটাই বেশি, হয়ত সুস্থ হবেন, কিন্তু আর কোনদিনই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে পারবেন না। ভাবলাম ব্যাবসা বাণিজ্য সব বিক্রি করে দেই, যা পাওয়া যাবে তা দিয়ে হয়ত মাসরুরের লেখাপড়া শেষ হওয়া পর্যন্ত সংসার চালিয়ে নিতে পারব। কিন্তু ছেলে আমার বেঁকে বসল। বলল, ‘না মা, মানুষের টাকা কর্জ থাকা পর্যন্ত বাবা সুস্থ হবেন না। তাছাড়া এতগুলো পরিবার আমাদের ওপর নির্ভরশীল, তাদের কথা ভুলে গেলেই বা কিভাবে চলবে?’ ছেলে সব ছেড়েছুড়ে ব্যাবসার হাল ধরল, হাল ধরল পরিবারেরও। কুড়ি বছর বয়স ছিলো ওর, হুট করেই বড় হয়ে যেতে হোল ছেলেটাকে। সেই থেকে পরিশ্রম করে ব্যাবসাটাকে আবার টেনেটুনে ঠিক করল, সবার ধার দেনা শোধ করল, ব্যাবসা বর্ধিত করল, নিজে আরেকটা নতুন ব্যাবসা শুরু করল, যেসব কর্মচারীরা এই বিপদের দিনে আমাদের পাশে ছিলো তাদের সবার জন্য বাড়ীর পেছনে ঘর করল, এখন ওরা আমাদের পরিবারেরই অংশ। পরিবারের গায়েও আঁচড়টি লাগতে দেয়নি আমার মাসরুর। বছরের পর বছর আমরা ডাল ভাত ভর্তা খেয়ে সংসার চালিয়েছি ঋণের টাকা শোধ করার জন্য, ঈদেও একটা কাপড় কিনতে পারিনি; কিন্তু ওর বাবার চিকিৎসা কিংবা ভাইবোনদের লেখাপড়ার জন্য কখনও টাকার অভাব বুঝতে দেয়নি মাসরুর। আমার ছেলেটা সারাদিন পরিশ্রম করে এসে বাবার মাথায় হাত না বুলিয়ে, ভাইবোনদের সাথে খুনসুটি করে তাদের মুখে হাসি না ফুটিয়ে কোনদিন ঘুমাতে যেতনা। ক্লাসের প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্র ছিলো আমার ছেলে। ব্যাবসার ফাঁকে ফাঁকে, রাত জেগে পড়ে অনার্সটা তো শেষ করল, কিন্তু মাস্টার্সটা করব করব করেও এখনো করা হোলনা’।
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি, ‘মাগো, কেউ যখন সবার মাথার ওপর ছাতা হয়ে তাদের নিরাপদ রাখতে যায়, তখন রোদ বৃষ্টি তুফানের ঝাপ্টা সব তার ওপর দিয়েই যায়। আমার ছেলেটা সবসময় হাসিখুশি, কিন্তু ওর মনের কষ্টগুলো সে আমাকেও বলেনা; সারাক্ষণ বকবক করে, কিন্তু এর মাঝে নিজের কথা একটিও বলেনা, সব অন্যের সুবিধা অসুবিধার কথা। তুমি যদি ওর মনের গোপন কুঠুরীতে সঞ্চিত কষ্টগুলো বের করে এনে ওখানে আলোয় ভরিয়ে দিতে পারো, সেটাই হবে আমার পরম পাওয়া। তোমার কাছে আমি এর বাইরে আর কিছুই চাইনা’।
তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে সামিয়া খেয়ালই করেনি কখন মারযান পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের সামিয়ার রুমে গিয়ে জিনিসপত্র গুছাতে বলে আনোয়ারা বেগম বাগানে যান যেখানে তাঁর স্বামী ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে একটা ফুটবলে লাথি মারতে পেরে আনন্দে কিশোরদের মত হুঙ্কার ছাড়ছেন!
নিজের রুমে যেতে যেতে সামিয়ার মনটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আসে। সে গতরাতে মাসরুরকে বলেছে, ‘আপনার ঝোঁক টাকার প্রতি, আমার পড়ার প্রতি’। অথচ এখন সে বুঝতে পারছে টাকা সে নিজের জন্য উপার্জন করেনা, বা লেখাপড়ার প্রতি ওর আগ্রহ নেই এই কথাটাও সত্য নয়। না জেনে কত বড় একটা আঘাত দিয়ে ফেলেছে সে! একজন কষ্ট হরণকারীকে কষ্ট দিয়ে ভীষণ অনুশোচনায় ভুগছে সামিয়া। কিন্তু কথাটা সে বলবে কি করে?
তিনমাস কেটে যায়। সামিয়ার শ্বশুর শাশুড়ি দেবর ননদ এমনকি প্রতিবেশীরাও ওকে ভীষন ভালোবাসে, ওদের উদারতা ওকে আপ্লুত করে। কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এই ভালবাসা সে পাচ্ছে তার মতিগতি সে কিছুই বুঝতে পারেনা। মাসরুর ওর সুবিধা অসুবিধা খেয়াল রাখে, বাড়ীর সবার সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার ব্যাপারে উপদেশ উৎসাহ দেয়, বাপের বাড়ী বা কলেজে আসা যাওয়ার সব সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে। কিন্তু এর বাইরে সে সামিয়ার সাথে কোন কথাই বলেনা, ঘুমায় অফিসরুমের সেই সিঙ্গেল খাটে। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে, সারাদিন কাজ শেষে রাতের খাবার খেয়ে পড়তে বসে। ভোরবেলা নামাজের আগে কুর’আন পড়ে, নামাজ পড়ে ঘুমায়। সামিয়া সুযোগ পায়না কোন কথা বলার, আবার লজ্জাবোধের কারণে বলতে পারেনা ভেতরে এসে ঘুমোতে। এক অস্বস্তিকর পরিবেশে কাটতে থাকে তার দিনরাত। ঘরের কেউ কিছু টের না পেলেও মারযান বুঝতে পারে কিছু একটা অমিল হচ্ছে, কিন্তু সে ঠিক ধরতে পারেনা সেটা কি।
(চলবে- ইনশাআল্লাহ)