রেহনুমা বিনত আনিস
সামিয়া ছিল একেবারেই অন্য ধাঁচের একটা মেয়ে। শিক্ষক পিতার সন্তান বলেই হয়ত ওর মাঝে পার্থিব কামনা বাসনার উর্ধ্বে স্থান পেয়েছিল মানবিকতাবোধ এবং পরোপকারের অদম্য ইচ্ছা। যেখানে ওর সহপাঠিনীরা স্বপ্ন দেখত কোন বড়লোকের ছেলেকে বিয়ে করে লন্ডন প্যারিস অ্যামেরিকা ঘুরে ঘুরে জীবন কাটিয়ে দেয়ার, সামিয়ার জীবনের লক্ষ্য ছিল এমন কাউকে বিয়ে করার যার জীবনের সকল অভাব এবং শূন্যতাবোধ সে ভালোবাসা এবং যত্ন দিয়ে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দেবে। মনের সঙ্গোপনে ওর একটা সুপ্ত ইচ্ছা ছিল ওর বাবার প্রিয় ছাত্র আবদুল্লাহ ভাইকে বিয়ে করার। ছেলেটি জীবনের কাছে কিছুই পায়নি। বাবামা ছিলোনা, মানুষ হয়েছে চাচা চাচীর কাছে। একটা বিয়ে করেছিল, বউটা মরে গেল এক বছরের মাথায়। মেধার অভাব ছিলোনা মোটেই, কিন্তু তদবীর করার কেউ ছিলোনা, সামান্য একটা চাকরী করে, চলে কোনক্রমে। ওর শার্টের ছেঁড়া পকেটটা দেখলে সামিয়ার ইচ্ছে করে সেলাই করে দিতে। ওর ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত, বিষন্ন মুখটা দেখলে সামিয়ার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে, ইচ্ছে করে আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিতে। আবার আবদুল্লাহ যখন নামাজে দাঁড়িয়ে সুমধুর স্বরে তিলাওয়াত করে তখন ওর মনটা এক স্নিগ্ধ প্রশান্তিতে ভরে যায়। আবদুল্লাহ কখনো ওর দিকে তাকায়না, চোখ পড়লে দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়, কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠেনা। এতে বরং আবদুল্লাহর প্রতি ওর শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। তবে সামিয়া নিজেও ওর বাবার ছাত্রদের সামনে তেমন আসেনা।
শুধু একজনের সাথে সে পেরে ওঠেনা – মাসরুর ভাই। এই ছাত্রটি যেমন আমুদে তেমন গপ্পবাজ। বাবা না থাকলে রান্নাঘরে এসে মায়ের সাথে গল্প জুড়ে দেয়। সামিয়া মাকে সাহায্য করতে গেলে ওর সাথেও গল্প শুরু করে দেয়, সে হুঁ হাঁ করে পালিয়ে বাঁচে। বিরাট বড়লোকের ছেলে মাসরুর। কিন্তু সেটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়, অল্প বয়সেই সে নিজেও প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী। দেখতে সুন্দর, ভাল পোশাক আর সুগন্ধী তাকে আরো আকর্ষনীয় করে তোলে। সামিয়াদের বাসার সামনে মাসরুরের গাড়ী দেখলেই কিভাবে যেন পাড়ার চাচী, খালা, ফুপুরা দলে দলে তাদের মেয়ে, ভাগনী, ভাতিজিদের নিয়ে ওদের বাসায় বেড়াতে আসতে থাকে। বাসায় কাজ বাড়ে প্রচুর। তাই মাসরুরের আসাটা সামিয়ার পছন্দ নয়। বান্ধবীরা বলে, ‘আহা, উনি আমাদের বাসায় এলে আমরা ধন্য হয়ে যেতাম! তুই একটা নিরামিষ’।
একদিন বিকালে মাসরুর বেড়াতে এসেছে ওর মা বাবাকে নিয়ে। মেহমান দেখেই সামিয়া রান্নাঘরে ছুটলো মাকে সাহায্য করতে। গিয়ে দেখে মা ফ্রিজ থেকে সেমাই, মিষ্টি, দই ইত্যাদি বের করছেন। বুঝলো মাসরুর মাকে আগে জানিয়েছে। যাক, লোকটার কিছু হুঁশজ্ঞান আছে তাহলে! সামিয়াকে দেখে মা বললেন, ‘তুই একটা ভাল কিছু পর, মাসরুরের আম্মাকে ভিতরের ঘরে নিয়ে বসাই। আর শোন, সাইফ সাইদকে বল বাসায় মেহমান এসেছে, সামনের ঘরে গিয়ে বসতে’।
সামিয়া আঁতকে উঠে বলে, ‘ও মাগো! আমি ভাইয়াদের কিছু বলতে পারবনা। ওরা দু’জনই পড়ছে, কিছু বলতে গেলে হত্যাকান্ড হয়ে যাবে! বসার ঘরে আব্বুর গলা শুনেছি, ওদের যেতে হবেনা। ’
মা জোর দিয়ে বললেন, ‘বল, আমি বলেছি সামনের ঘরে যেতে, কিছু বলবেনা’।
বুকের ভেতর হৃৎপিন্ডটার ধড়াস ধড়াস শব্দ যেন কানে শুনতে পাচ্ছে সামিয়া। দুই ভাই মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। সে দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে সাহস করে বলে ফেলল, ‘ভাইয়া, মা বলেছে ঘরে মেহমান এসেছে, সামনের ঘরে যেতে’। চোখ খুলে দেখে সাইদ আয়নার সামনে চুলে চিরুনী বুলাচ্ছে, সাইফ পাশে দিয়ে যেতে যেতে মাথায় হাত বুলিয়ে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। যাক, তবু বকা তো দেয়নি!
নিজের ঘরে গিয়ে কাঠের আলমারিটা খুলল সামিয়া। এককালে এটা ওর দাদীর ছিল, এখন এটা ওর সম্পত্তির আধার। আলমারীর অর্ধেকটা জুড়ে বই। বাকীটায় ক’খানা জামাকাপড় আর কিছু ইমিটেশনের গহনা, নিজের আঁকা কিছু ছবি আর কিছু ডায়রী যার পাতায় পাতায় ওর লেখা কবিতা। গতকাল যে জামাটা নাবিহার বাসায় পরে গেছিল সে জামাটা ভাঁজ করা হয়ে ওঠেনি, ওটাই গায়ে চাপিয়ে নিলো সে। কাপড় বদলে রুমের দরজা খুলতেই দেখে মাসরুরের মাকে নিয়ে আম্মু হাজির। সালাম দিয়ে ওনাকে বিছানায় বসার ব্যাবস্থা করে দিয়ে চলে যাচ্ছিল সামিয়া, মা ডেকে বললেন, ‘তুই ওনার সাথে গল্প কর, আমি নাস্তা দিয়ে আসছি’।
সামিয়া বলল, ‘আমি ভাইয়াদের দিয়ে সামনের ঘরে নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি, তুমি ওনার সাথে বোস’।
কিন্তু মা ওকে বসিয়ে রেখে চলে গেলেন। সামিয়া মাসরুরের মায়ের সাথে কি কথা বলবে? উনি নানারকম কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কি পড় কি কর জাতীয়,যা সচরাচর মুরুব্বীরা জিজ্ঞেস করে থাকেন, সে উত্তর দিয়ে গেল।
খাওয়া দাওয়া গল্পগুজব শেষ, মেহমান চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বাবা এসে সামিয়াকে ডাকলেন, ‘মা, কি করিস?’
‘কিছু না আব্বু, পড়তে বসব’।
‘আচ্ছা। আগে চল তোর সাথে কিছু কথা বলি। তুই এখানে আমার সামনে বস’।
বাবাকে বিছানায় বসতে দেখে সামিয়া সামনে দাঁড়িয়ে রইল। বাবা ওকে হাত ধরে পাশে বসালেন।
‘শোন মা, মেয়ে বড় হলে বাবামায়ের চিন্তার অন্ত থাকেনা – একটা ভাল ছেলে পাব তো? শ্বশুরবাড়ীতে মেয়েটাকে আদর যত্ন করবে তো? মেয়েটা ভাল থাকবে তো? আল্লাহ আমাদের চিন্তা শুরু করার আগেই সেই চিন্তা থেকে মুক্তি দিলেন। মাসরুরের আগে ওর বাবা আমার ছাত্র ছিল। তখন আমি মাত্র শিক্ষকতা শুরু করেছি। সে ছিল আমার বছর চারেকের ছোট। ওর বিয়ে, মাসরুরের জন্ম সব আমার চোখের সামনে। ওর মা খুব ভাল মেয়ে রে। আজ ওরা যখন মাসরুরের জন্য তোকে চাইল আমি তোর সাথে কথা না বলেই হ্যাঁ করে দিলাম। তোর মা, সাইফ, সাইদ সবাই খুশি। কি রে মা? আমরা তোকে জিজ্ঞেস না করেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলাম বলে মনে খুব কষ্ট পেয়েছিস?’
সামিয়ার পাংশুটে মুখ দেখে বাবা ভাবলেন ওর সাথে আলাপ না করেই সিদ্ধান্ত দেয়ায় সে মর্মাহত হয়েছে। কিন্তু তিনি বুঝলেন না ঐ মূহূর্তে সামিয়ার সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন ধূলিস্যাত হয়ে গেল, সে তো রাজরানী হতে চায়নি কখনো, চেয়েছিল ঘুঁটেকুড়ানী হতে! কিন্তু ওর ভুল হয়েছিল এই ভেবে যে পরিবারের সবাই ওর মত করে ভাববে। কিন্তু ওদেরই বা দোষ কোথায়? যার জন্য ঘুঁটেকুড়ানী হতে পারে তেমন কেউ তো আজও আসেনি! রাজা রানী যদি যেচে রাজপুত্রের জন্য ঘুঁটেকুড়ানীকে নিতে চায় তাহলে কোন স্বাভাবিক পরিবার কোন যুক্তিতে মানা করবে? সে জানে মাসরুরের বাবা মা ওর বাবার প্রতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতাবশত ওকে বৌ করে নিতে চেয়েছেন, নইলে আর্থিক এবং সামাজিক দিক থেকে ওদের পার্থক্য আকাশ পাতাল। কিন্তু যে মাসরুরের জন্য দুনিয়ার সুন্দরী মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে কেন ওকে বিয়ে করতে রাজী হোল সেটা কিছুতেই ওর মাথায় এলোনা।
‘কি মা, কিছু বলবিনা?’
বাস্তবতায় ফিরে এলো সামিয়া। মাথা নাড়লো, ‘তোমরা যা ভাল মনে কর আব্বু’।
…..(চলবে)