banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1182 বার পঠিত

 

ছোট ছোট ত্যাগ জীবনকে করে তোলে স্বপ্নিল……শেষ পর্ব

আফরোজা হাসান


এইজন্যই তো আমি বলি কোনদিন বিয়ে করবো না! ছবি আঁকা বন্ধ করে বাক্যটির উৎস সন্ধানে চোখ তুলে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ননদকে দেখে অন্তরা হেসে বলল, আবার কি হলো তোমার? ভাবীর পাশে এসে বসে শারলিন বলল, বিয়ে মানেই হচ্ছে নিজ জীবনের সব স্বপ্ন সাধের অবসান করে অন্যের রঙে রাঙিয়ে যাওয়া।

– অন্তরা হেসে বলল, একে অন্যের রঙে মিশে যাওয়া তো খারাপ কিছু না।

– একে অন্যের রঙে মিশে যাওয়া খারাপ কিছু না ঠিক, কিন্তু এমনটা তো ঘটে না। ছেলেরা নিজেদেরকে বদলায় না, বৌকে বাধ্য করে বদলাতে। এই যে তুমি এত চমৎকার ছবি আঁকো, এক সময় স্বপ্ন দেখতে পেইন্টার হওয়ার। বিয়ের পর কি সেই স্বপ্ন তোমাকে ছেড়ে দিতে হয়নি? তোমার কি মনেহয় না ভাবী তুমি তোমার প্রতিভাকে তার সঠিক পথে চলতে দাওনি? আমি হলে কখনোই এমন করতাম না। কারো জন্যই নিজের স্বপ্নকে ত্যাগ করতাম না। তুমিই বলো অন্যের জন্য নিজের জীবনের স্বপ্নকে বদলে ফেলাটা কি ভুল নয়?

-হয়তো ভুল। তবে জীবনের পথে এগিয়ে চলতে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় মানুষকে মাঝে মাঝে এমন ভুল করতে হয়। তবে ভুলটাকে ধরে বসে না থেকে যদি সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে সেটা জীবনের উপর তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনা। তাছাড়া একটা স্বপ্ন পূরণ করতে হলে মানুষকে আরেকটা স্বপ্ন ছাড়তে হয়।

-এটা তো নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেয়া কথা।

-আমার ধারণা এটা নিজেই নিজের কষ্টের কারণ হওয়া থেকে বাঁচার উপায়। আমার একটু ত্যাগ যদি আমার জীবনকে সুখী-সুন্দর করতে পারে, তাহলে কেন আমি সেটা করতে কার্পন্য করবো বলতো। তাছাড়া আমি কিন্তু আমার স্বপ্নকে হারিয়ে যেতে দেইনি। সময় পেলে আমি ছবি আঁকি, টুকটাক ডিজাইন করি নিজেদের জন্য। আসলে আমরা চাইলেই একই সাথে নিজের এবং আপনজনদের স্বপ্নগুলোকে পূরণ করতে পারি। কিন্তু আমরা সে চেষ্টা না করে নিজের ফলস ইগোর পাল্লায় পরে শুধু শুধু জীবনকে জটিল করে তুলি। হ্যা এটা ঠিক যে একটা স্বপ্নকে ছেড়ে দিতে অনেক কষ্ট হয় আমাদের কিন্তু পুরনোকে বিদায় না দিলে তো নতুনকে পাওয়া যায়না। আর নতুনকে পাবার পথে যদি একটা স্বপ্ন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সে স্বপ্নটাকে ছেড়ে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

-মেয়েরাই কেন ছাড় দেবে সবসময়?

-এখানে আবার ছেলে-মেয়ে আসছে কেন? সংসারের সুখের জন্য স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলেই চেষ্টা করতে হবে। ছাড় দেয়াটা যখন যার জন্য সহজ হবে তখন সে দেবে। সংসার তো কোন প্রতিযোগিতা নয় যে সারাক্ষণ হার-জিতের চিন্তা করতে হবে।

-সবাই তো এভাবে চিন্তা করেনা। একবার মেয়েরা ছাড় দিলে ছেলেরা সুযোগ পেয়ে যায়।

-সবার চিন্তা করে আমি আমার জীবনকে কেন জটিল করবো? অন্যের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি আমার জীবনকে চালাতে চাইনা। সমস্যা কিন্তু ছাড় দেয়া বা না দেয়া নিয়ে নয়। সমস্যাটা হচ্ছে বেশির ভাগ মানুষই জানেনা সে কেন ছাড় দিচ্ছে। যদি জানতো তাহলে ছাড় দেয়াটা কখনোই ইস্যু তৈরি করতো না সংসারে। কিন্তু আমি জানি আমি কেন ছাড় দিচ্ছি। আমি ছাড় দিয়েছি আমার নিজের সুখের জন্য। আমি আমার ছোট্ট একটা স্বপ্নকে ত্যাগ করেছি সারাজীবনকে স্বপ্নিল করার আশা নিয়ে। আর এরজন্য যতবার আমাকে ছাড় দিতে হবে আমি দেব ইনশাল্লাহ। তোমার ভাইয়া কি করছে সেটা তাঁর ব্যাপার। আমি শুধু আমার দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে চাই। আর একজন যখন নিঃস্বার্থভাবে তার দায়িত্ব পালন করবে, অন্যজন সেই প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেনা বলেই আমার বিশ্বাস।

– কিন্তু সবসময় তো এমন হয় না ভাবী। নিঃস্বার্থভাবে ত্যাগ করেও অন্যকে প্রভাবিত করা যায় না। বরং এই ত্যাগের সুযোগই গ্রহণ করে সবাই।

– সেক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে পরীক্ষা। যখন মানুষ তার ভালো কাজের মূল্য পায় না, উল্টো তাকে আরো অবহেলিত হতে হয়, আমি মনেকরি সেটাই তারজন্য পরীক্ষা। আর এরচেয়েও বড় কথা হচ্ছে আমাদের সকল কাজের প্রতিদান শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে আশা করতে হবে।

– তারপরও ভাবী শুনতে যত সহজ শোনায়, এত সহজ নয় এসব বিষয়।

-হেসে, আচ্ছা প্রশ্ন কঠিন এই ভয়ে কি আমরা পরীক্ষা দেয়া ছেড়ে দেই? উহু বরং পরীক্ষায় পাশের লক্ষ্যে খুব ভালো মত প্রস্তুতি নেই। সম্পর্কের মাঝের সমস্যাগুলোকে যদি আমরা পরীক্ষা মনে করে, পাশ করার লক্ষ্যে নিজেদেরকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করতাম তাহলে খুব ভালো রেজাল্ট না করলেও ফেল অন্তত করতাম না। টেনেটুনে পাশ হয়তো করেই যেতাম।

– হেসে, তোমার সাথে তো কথা বলাই মুশকিল। ঠিকই নিজের মত প্রতিষ্ঠা করে ফেলো কথা মায়াজালের ফাঁদ পেতে। এজন্যই তো সবাই তোমাকে এত পছন্দ করে।

-হেসে,আলহামদুলিল্লাহ! তোমাকে একটা গল্প বলি চল। বেতবন আর জলপাইগাছের মধ্যে নিজেদের শক্তি নিয়ে তর্ক চলছিলো। জলপাইগাছ বলল, তুমি তো একটু বাতাসেই নুয়ে পড়ো। তোমার আবার শক্তি কোথায়? বেতবন একথার কোন উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ পর ঝড় এলো। প্রচণ্ড ঝড়। বেতবন ঝড়ের ঝাপটাকে কোনরকম বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলো না। বাতাসের ধাক্কায় একবার সে এদিকে নুয়ে পড়ে আরেকবার ওদিকে। ঝড় শেষে দেখা গেলো ঝড়ের ধাক্কা সামলে উঠেছে সে, দাঁড়িয়ে আছে নিজের পায়ে।
এদিকে বিরাট শক্তিশালী জলপাইগাছ তো নুতে পারেনা। সে বাতাসের ধাক্কাকে ঠেকিয়ে রাখতে না পেরে ভেঙ্গে পড়লো। এখন বলো কি শিখলে এই গল্প থেকে?

-আমাদের উচিত অবস্থা অনুযায়ী খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করা।

– আমি সবার সাথে এই কাজটি করারই আপ্রাণ চেষ্টা করি। আমরা নিজেদের ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, কষ্ট ইত্যাদিকে বড় করে দেখি বলেই আমাদের জীবনটা জটিল হয়ে যায়। এভাবেই সম্পর্কের মাঝে দুরুত্ব আসে, ব্যবধান বাড়ে, কাছের মানুষরা দূরে চলে যায়। শুধু একটু ইচ্ছা, প্রচেষ্টা, অন্যেকে বুঝতে পারার মানসিকতাই সম্পর্কগুলোকে করে দিতে পারে স্বপ্নিল। আর যখন ভালো করেও খারাপ আচরণ পেতে হয়, তখন আমাকে রাসূল (সঃ) এর বাণী ধৈর্য্য ধরে করণীয় করে যেতে প্রেরণা যোগায়। “সে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষাকারী নয়, যে সম্পর্ক রক্ষার বিনিময়ে সম্পর্ক রক্ষা করে। বরং প্রকৃত আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষাকারী সেই, যার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সে তা জোড়া দেয়।” আসলে সমস্যা কি জানো?

– কি ভাবী?

– -পৃথিবীতে জানে এমন মানুষের কোন অভাব নেই, অভাব হচ্ছে জানাকে মেনে চলে এমন মানুষের। আর এর কারণ আমরা মুখেই কুরআন-সুন্নাহর বড় বড় কথা বলি কিন্তু আমাদের মননে ইসলাম অনুপস্থিত। যদি মননে ইসলাম থাকতো তাহলে আমরা শুধু মুখে বলতাম না বরং কাজের দ্বারাও প্রমাণ করতে চেষ্টা করতাম যা বলছি সেটাকে।

– একদম ঠিক বলেছো ভাবী।

– আমাদের আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে কিছু একটা ত্যাগ করেই আমরা মনে মনে নিজেকে মহান ভাবতে শুরু করি। অন্যের জন্য এটা করেছি ওটা করেছি, সুতরাং স্বীকৃতি এখন বাধ্য আমার জন্য এমন হয় আমাদের মনোভাব। এক হাতে দিয়ে, অন্য হাতে প্রতিদান নেবার জন্য তৈরি হয়ে যাই আমরা। যখন হাত শূন্য থেকে যায়, সহ্য করতে পারিনা। মনের মধ্যের কুপ্রবৃত্তি গুলো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ভুলেই যাই আমাদের সব কাজের বহুগুণ প্রতিদান ফিরিয়ে দেবার জন্য একজন বসে আসেন। কিন্তু আমাদের ধৈর্য্য যে বড় কম, যে কোন ত্যাগের তৎক্ষণাৎ মূল্যায়ন চাই আমাদের।

– তুমি কারো কাছ থেকে কিছু পেতে চাও না তাই না ভাবী?

-হেসে, হ্যা চাই না কোন প্রতিদান। কারণ আমি যা করি নিজের জন্য করি, অন্যের জন্য না।

– মানে?

– মানে আমি বিশ্বাস করি যে, আজ যদি আমি তোমার জন্য ছোট কোন একটা ত্যাগ করি, তার বদলে আমাদের ননদ-ভাবীর সম্পর্ক আরো সুন্দর হবে। সুতরাং পরোক্ষভাবে আমিও লাভবান হবো। আবার যদি তোমার কাছ থেকে কোন স্বীকৃতি নাও পাই, আত্মীয়তার হক রক্ষার পুরস্কার আমি পাবোই, ইনশাআল্লাহ।

-হেসে, হুমম…এটাই তাহলে তোমার গিরগিটি হবার রহস্য?

– আমি জীবনে সুখী হতে চাই শারলিন। আর সুখী হবার সবচেয়ে সহজ ও ফলপ্রসূ টিপস হচ্ছে, সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করা। তাহলেই কেবল মানুষ সবকিছুকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে। সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে জীবনের প্রতিটা চড়াই-উৎড়াইকে, করতে পারে ছোট ছোট ত্যাগ যখন প্রয়োজন, যতবার প্রয়োজন। আমরা বড় স্বার্থপর, অন্যের কিছু করতে আমাদের বড় বেশি আপত্তি। তাই যখনই কোন কিছু ত্যাগ করার বা ছাড় দেয়ার প্রশ্ন আসে, আমি নিজের লাভটা সবার আগে ভেবে নেই। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে, আমার ত্যাগ এই দুনিয়াতে যথার্থ মূল্যায়ন না পেলেও, আখিরাতে পাবে ইনশাআল্লাহ। আর তখনই আমার বেশি প্রয়োজন পড়বে এসবের।

– ইনশাআল্লাহ! আমিও আজকে থেকে এভাবে চিন্তা করবো ভাবি।

– কিভাবে?

-হেসে, ছোট ছোট ত্যাগ জীবনকে করে তোলে স্বপ্নিল।

-হেসে, আলহামদুলিল্লাহ্‌! আমি দোয়া করি এই চিন্তার দ্বারা তোমার জীবন হয়ে উঠুক অনেক অনেক সুন্দর-সহজ-সরল ও স্বপ্নিল।

পর্ব-৫

Facebook Comments