নিশাত পারভেজ একটি বেসরকারি টেলিভিশনে কাজ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনার পাট চুকিয়েছেন সম্প্রতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপদ আবাসন হলও ছাড়তে হয়েছে। হল ছাড়ার পর থেকেই শুরু হলো বিড়ম্বনা।
একটি জুতসই আবাসনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঢুঁ দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু টাওয়ার, পলাশীতে সাবলেটে (কোনো পরিবারের সঙ্গে বাসা ভাগাভাগি করে থাকা) থাকার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেখানে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। অন্যদিকে ছোট রুম নিলেও তা তিনজনে নিতে হবে, শুধু এক রুমের জন্য ভাড়া ১০ হাজার টাকা। খাওয়ার পানিও বাইরে থেকে কিনে খেতে হবে। তাই সেখানে থাকার চিন্তা বাদ।
নিশাত বর্তমানে ঢাকা কলেজের বিপরীতে এক গলিতে কয়েকজন মিলে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। একটি ছোট পরিবারের থাকার উপযোগী বাসাটি। এখানে চৌকি বসানোর জায়গাসহ আর খানিকটা জায়গা বরাদ্দ একেকজনের জন্য। ভাড়া চার হাজার টাকা। খাওয়ার খরচ নিজের। এই বাসায় অন্য একজন ভাড়া ছিলেন। ওই নারীর বিয়ে হয়ে গেলে তিনি এখন আবার ভাড়া দিয়েছেন। অর্থাৎ মালিক পরিবর্তিত হয়েছে। এখানে হোস্টেল বা সাবলেটের চেয়ে খরচ একটু বেশি হলেও নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা ভাবতে হয় না।
রাজধানীর ফার্মগেটে একটি নামকরা হোস্টেলের এক বাসিন্দা বললেন, ‘মন চাইলেই মালিক সিটের ভাড়া বাড়ান। ওয়াসার অজুহাত দেখিয়ে প্রায়ই পানি বন্ধ করে দেন। বাজে ব্যবহার তো আছেই। ঘর এতটাই ছোট যেন মনে হয় কবুতরের খাঁচায় বসবাস করছি। নিম্নমানের খাবার দেন, তাই নিজেই রান্না করি। কিন্তু খাবারের পুরো টাকাই দিতে হচ্ছে। নিরাপত্তা নিয়েও খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারি না। তবে হোস্টেলের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে কথা বলতে গেলেই মালিক সিট বাতিলের হুমকি দেন।’ প্রতিবাদ করার কারণে আগামী এক মাসের মধ্যে সিট ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছে ওই বাসিন্দাকে।
উচ্চশিক্ষা এবং চাকরির জন্য রাজধানীতে আসা বিভিন্ন বয়সী নারীদের আবাসনের জন্য এ ধরনের ঝক্কি সামলাতে হচ্ছে। আর ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্ন হোস্টেল পরিচালিত হচ্ছে কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেকেরও বেশি ছাত্রীর আবাসিক সুবিধা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের চলতি শিক্ষাবর্ষের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা ১৮ হাজারের বেশি। পাঁচটি আবাসিক হল ও দুটি হোস্টেলে আবাসিক ছাত্রীর সংখ্যা ৬ হাজার ৩৪৪।
রাজধানীর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ছাত্রীদের আবাসনসংকট চরম আকার ধারণ করেছে। এই শিক্ষার্থীরা বাধ্য হচ্ছেন অলিগলিতে গজিয়ে ওঠা হোস্টেলগুলোতে থাকতে। গণমাধ্যম বা যেসব কর্মক্ষেত্র থেকে কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়, সেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীদের হোস্টেলে সিট পাওয়াই কঠিন ব্যাপার।
হোস্টেলে থাকা নারীদের আবার খানিকটা ভিন্ন চোখেও দেখা হয়। ২০১৪ সালে মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডে সাতটি বাড়ি নিয়ে গড়ে তোলা ্একটি ছাত্রী হোস্টেলে বখাটেরা হামলা চালায়। প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবেদকের সামনেই হোস্টেলটির তত্ত্বাবধায়ক রাবেয়া সুলতানা এক ছাত্রীকে বলেন, ‘হামলা তো হবেই, তোমরা শার্ট-প্যান্ট পরো কেন?’ অর্থাৎ সব দোষ যেন মেয়েদেরই।
ভাড়াটেদের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে—এমন ১৩টি সংগঠনের জোট বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া ফেডারেশনের মহাসচিব মো. বাহরানে সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই বছর আগের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরে একসঙ্গে কয়েকজন মিলে মেস করে থাকা ছেলে ও মেয়ের সংখ্যা ১৪ লাখ। এই হিসাবে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার নারী ও পুরুষদেরও ধরা হয়েছে।’ ঢাকা শহরে মেয়েদের জন্য বেসরকারি হোস্টেলের সংখ্যা বা মোট কতজন হোস্টেলে থাকেন, সেই পরিসংখ্যান নেই এই ফেডারেশনের কাছে। বাহরানে সুলতান বলেন, ‘হোস্টেলে থাকা মেয়েদের নানা সমস্যার কথা শুনেছি। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। অভিযোগ না করলে আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না।’
মেয়েদের হোস্টেল পরিচালনার জন্য আলাদা কোনো নীতিমালা নেই। ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন এবং সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী হোস্টেলের নিবাসীদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়ার কথা। তবে তা মানা হচ্ছে না। ভাড়ার ব্যাপারে ফার্মগেটের নিবেদিকা হোস্টেলের একটি শাখার ব্যবস্থাপক সেকেন্দার আলী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও কোচিং মৌসুমে ছাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি হলো, তিন মাস পরে সিট খালিও থাকতে পারে। যোগ করলেন, ‘আমরা তো আর অন্যদের মতো ছয় মাসের চুক্তি করছি না। চুক্তি করলে তো ছয় মাসেরই ভাড়া দিতে হয়। সেই হিসাবে আমরা তো ভাড়া কমই নিচ্ছি।’
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর সারা দেশে মোট সাতটি (ঢাকায় তিনটি) কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল পরিচালনা করছে। ঢাকার বাইরে পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জাতীয় মহিলা সংস্থা রাজধানীতে কর্মজীবী নারীদের জন্য একটি হোস্টেল পরিচালনা করছে। এসব হোস্টেলে সিট না পাওয়া একাধিক নারী জানালেন, সরকারি হোস্টেলে সিট পেতে হলে সরকারের ওপর মহলের তদবির লাগে। এ ছাড়া মাসের পর মাস কেউ অপেক্ষা করতে পারলে, অর্থাৎ সবুরে মেওয়া ফললে ফলতেও পারে। কিন্তু অপেক্ষা করার তো সময় নেই।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চশিক্ষা এবং কর্মে নারীদের এগিয়ে আনার জন্য সরকারের নীতি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব নেই। কিন্তু তার বাস্তবায়ন সেভাবে হচ্ছে না। ব্যক্তিগত উদ্যোক্তা বা বেসরকারি খাত নারীদের আবাসনসংকট নিরসনের চেষ্টা করছে। তাদেরও একটি নিয়মনীতির আওতায় আনা প্রয়োজন।