ফাতিমা খান
বান্ধবী,
কেমন আছ? আমার চিঠি দেখে খুব অবাক হচ্ছো, তাই না? আমি কিন্তু একদম চিঠি লিখতে পারিনা। সেই যে স্কুল জীবনে শিখেছিলাম, ও-ই শেষ।
কেমন কাটছে তোমার দিন সুদূর আমেরিকায়? তুমি চলে যাওয়ার পর তো আর তোমার সাথে মন খুলে কথা বলা হয় না! আমিও চলে আসলাম এই আরবে। এখানে আসার পর মনে হল যুগ শেষে আমি আবার আমার ঘরে ফিরে এসেছি! কে যেন আমাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল, মেয়াদ পুরা হলে আমি যেন মুক্তির উৎসবে মেতেছি !! এখানে বদলে গিয়েছে অনেক কিছু… শুধু বদলায়নি আমার প্রিয়জনেরা! এখানকার আলো, বাতাস, প্রকৃতি বহুদিন থেকে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল, আমিও ছুটে এসেছি, কিন্তু অ-নে-ক দিন পর….। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়েছি কিছুদিন।
সময়ে অসময়ে তোমার কথা খুব বেশী মনে পড়ে। আমাদের প্রজাপতি রঙ্গিন দিনগুলো তো আর ফিরে আসবে না….. বেলা শেষে রঙ ধুয়ে যাওয়া সাদা-কালো ছবিগুলো হৃদয়পটে এখনও ঝলমল করে। আমি স্মৃতির আ্যলবামটা খুলে বসি! কোথা থেকে যেন এক দমকা বাতাস আমাকে জানিয়ে দেয় তার দুরন্ত অস্তিত্বের কথা। আমি পেছন ফিরে তাকাই। আরবের লু হাওয়া মাঝে মাঝে আমাকে খুব বিষণ্ণ করে দেয়। পরিষ্কার আকাশটা হঠাৎ হলদেটে হয়ে গেলে মনটা খারাপ হয়ে যায়! একাকী বসে চোখ বুঁজে কত কি যে ভাবি……..! তোমার কি সেই পুরানো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে? আমার কিন্তু স্মৃতি রোমন্থন করতে ভাল লাগে। গিফট বক্সের মোড়কটা একটানে ছিঁড়ে না ফেলে আস্তে আস্তে খুলতে যেমন আনন্দ, ঠিক তেমন স্মৃতির পাতাগুলো ও ধীরে ধীরে উল্টে দেখতেই বেশী ভাল লাগে। তুমি চলে যাওয়ার পর আমার পৃথিবীর ছোট্ট জানালাটা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল। এই জানালা দিয়েই তো দুজন বিশাল আকাশটাকে দেখতাম, কত গল্প করতাম , কথার মালা গাঁথতাম!!
আমাদের দিনগুলো কিন্তু খারাপ কাটেনি। তৃপ্তি ছিল, তুষ্টি ছিল, ছিল ভাবনাহীন এক জীবন। কে জানে, এখন থেকে কয়েক বছর পর হয়তো মনে হবে আজকের দিনগুলোর কথা… আর মনে মনে বলব… ভালই তো ছিলাম! এই হল মানুষের মন………! আমরা অতীতের মধ্যে ডুবে থাকতে পছন্দ করি, একরকম বলতে পারো ‘দুঃখ বিলাসিতা’ করি! ‘আজ’কের মাঝে আমরা সুখ খুঁজি না। এই ‘আজ’ যখন ‘কাল’ হয়ে যায়, তখন একে আমরা স্মৃতির জাদুঘরে বন্দী করে সময়ে-অসময়ে স্মরণ করি। দূর হয়ে যাওয়া অতীতের অনেক স্মৃতি বারবার আমাদের পিছু ডাকে। ছোটবেলার দিনগুলি কখনও কি কেউ ভুলেছে বল? আমার গম্ভীর আব্বা যখন সেই বিশাল বৃক্ষশূণ্য মাঠ, তার একপাশে স্ব-গর্বে দাঁড়িয়ে থাকা কেওড়া গাছ, পাশে কপোতাক্ষ নদের বুকে পাল তোলা নৌকা আর ভাটিয়ালী গানের গল্প করেন, তখন আমি অবাক হয়ে শুনি! মানুষের জীবন কত ছোট্ট , কিন্তু কত দীঘল তার স্মৃতিচারণ! জ়ীবন যেখানে শেষ সেখানে নাকি স্মরণের সূচনা। জীবনসায়াহ্নে এসে মানুষ তার ছেলেবেলায় ফিরে যায়, বারবার স্মরণ করে অনাবিল সুখের দিনগুলোকে!
এখানে আসার পর আমার সারাদিন কাটে বাবুকে নিয়ে আর ঘর-কন্নার কাজ করে। বহুদিন পর গিন্নীপনা করতে একেবারে খারাপ লাগছে না। খাঁটি বাঙ্গালী বধূর পাট বলতে পারো এদেশে এসেই শুরু। বাবুকে স্কুলে দিয়ে এখন আবার নতুন করে আরেকটু ব্যস্ত হয়েছি। মাঝে মাঝে relax হতে বাবার বাড়ি , মার্কেট বা পার্কে ঘুরে আসি। তোমার ভাইয়ার দিনের বেশীটুকু সময় কাটে রোগীদের সাথে। রোগ আর রোগীদের মাঝে যে কি অনাবিল আনন্দ, তা ওকে না দেখলে বুঝবে না।
বাবুকে নিয়ে যখন স্কুলে যাই, তখন এখানকার প্রখর রোদের ঝাঁঝালো আঁচটুকু খুব বেশী টের পাই। এখানে সারা বছর রোদের তীব্রতা অনেক বেশী, সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা নিমগাছের ছায়াগুলোও এর কাছে রীতিমত হার মানে। গাছগুলোর অসহায় চাহনীর দিকে তাকিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এত প্রখর রৌদ্র থেকে অনেকদিন দূরে ছিলাম। এখানে এক পশলা বৃষ্টির জন্য মসজিদ গুলোতে নামায হয়… তারপর ও রোদের তেজ কমে না। মনে পড়ে, বৃষ্টির দিনে তোমার সাথে কলেজে যাওয়ার কথা ! বৃষ্টির স্রোতে ধুয়ে যাওয়া পরিষ্কার পিচঢালা রাস্তায় দুজন গল্প করতে করতে বাসায় ফিরতাম। আমাদের গল্প যেন আর ফুরাতো না। এভাবেই তো শেষ হল চারটি বছর! তোমার কি মনে আছে …….বাহারী হ্যাট মাথায় মাস্তানা স্যারের চিকন দুইটা বেণী দুলিয়ে চমৎকার সেই পড়ানোর স্টাইল, জাকির স্যার এর Osazone test, বনিক স্যারের দুর্বোধ্য ভাষার Pharmacology পড়ানো, এন আই খান স্যারের Lub-Dub bhroosh (heart sound) , Oral pathology আর জোয়ারদার স্যারের বিভীষিকা… বাপরে ! এখনও ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখি!! একেকবার ফাইনাল পরীক্ষার সময় আমাদের কি অবস্থা হতো তোমার মনে পড়ে? মনে হত আমরা Bermuda Triangle পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি !!!! সব ঝঞ্জাই তো আমরা একসাথে পাড়ী দিলাম হাতে হাত ধরে, ওই বৃষ্টির পানি উপচে পড়া রাস্তাগুলো পার হওয়ার মত ! মাঝে মাঝে মনে হয়, তুমি না থাকলে আমার কি হত কে জানে। এখন বই এর পাতাগুলো উল্টানোর সময় তোমাকে খুব বেশি মিস করি! প্রতিটা পাতার আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু সাদা-কালো গল্প, আমি তাতে ইচ্ছেমত রঙ মিশাই, তারপর মনের চোখ মেলে তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ!
তোমার কি খবর বল? আমি শুধু নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। আমার বকবক করার অভ্যাসটা এখনও গেল না। তুমি কাছে থাকলে কান দুটোকে নির্ঘাত ঝালাপালা করে দিতাম। তোমার ছোট্ট দুই গোলাপপরী কেমন আছে? ওদের ছবি দেখলে মনটা ভরে যায়। ওরা কি জানে যে ওদের একটা খালামণি আছে যে ওদেরকে গালের সাথে মিশিয়ে আদর করতে চায়? আরেকটু বড় হলে না হয় বলে দিও। এখন আমার হয়ে তুমি ওদের একটু আদর করে দিও ।
আমার এলোমেলো চিঠি পড়ে হেসো না কিন্তু! গুছিয়ে লিখতে পারি না যে, কি করবো? মন যা বলতে চায়, লিখে ফেললাম। তোমার সাথে আবার ফরমালিটি কিসের? কিন্তু নির্ঘাৎ আমার স্কুলের ব্যাকারণ টিচার এ চিঠি দেখলে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতেন।
আজ আসি।
বুকভরা শুভেচ্ছা নিও, আর আরবের তীব্র উত্তাপের সহনীয় মিষ্ট উষ্ণতাটুকু তোমাকে দিলাম। আল্লাহ তোমাদের সবাইকে ভালো রাখুন !!
৫ই মে, ২০১০।