banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 452 বার পঠিত

 

চাকরি ক্ষেত্রে বিষয় বৈষম্য কেন?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন অনেক বিষয়ে পড়ানো হচ্ছে যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য মোটেই যুগোপযোগী নয়। যে দেশে চাকরির বিজ্ঞাপন মানেই বিবিএ-এমবিএ চাওয়া, সে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাপর বিষয়গুলোর মূল্য কি? শেখার জন্য আমরা বা আমাদের সমাজের কয়জন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই? সবাই যাই সার্টিফিকেট অর্জন করে ভাল চাকরি করার স্বপ্ন নিয়ে। আর চাকরি মানেই যেখানে বিবিএ-এমবিএ এবং নামে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয় সেখানে আরবি, ফার্সি, উর্দু কিংবা ওরকম আরো বিষয়গুলিতে পড়ে কতটা কাজে আসবে তা আমাদের জানা নেই। বরং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওই সব বিষয়ে ভাল রেজাল্ট করার পরও আমাদের ভাই-বোনেরা হতাশ হচ্ছে চাকরির বিজ্ঞাপনগুলো দেখে।

আমরা কোনো বিষয়কেই ছোট চোখে দেখি না বা কাউকে কারো চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই না বলে যারা বড় বড় কথা বলে তারাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উঁচু স্তরে বসে বিজ্ঞাপন সাজায় বিশেষ কিছু বিষয় ছাড়া যেখানে অন্যরা আবেদনই করতে পারে না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে—বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ওই সব বিষয় পড়িয়ে লাভ কি? বন্ধ করে দেওয়াই কি যুক্তিযুক্ত নয়? চাকরি পাওয়ার প্রাথমিক শর্তই যদি হয় বিবিএ-এমবিএ—তাহলে গোড়া থেকেই কেন আমরা সেসব বিষয় নিয়ে পড়ছি না, পড়াচ্ছি না। যে সব বিষয়ের আপাত দৃষ্টিতে কর্মজীবনে না কোনো চাহিদা আছে, না কোনো মূল্য আছে, সেসব বিষয়ে ভর্তি হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতাশাই শুধু বাড়বে। আমরা মনে করি না যে, শুধু বিশেষ কিছু বিষয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাই ওই সব চাকরি পাওয়ার যোগ্য আর বাকিরা লবডঙ্কা। চাকরির বাজারে কে কার থেকে এগিয়ে সেটা বুঝতে হলে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে সব বিষয়ধারীকে আবেদনের সুযোগ দিয়ে দেখুন। কে কার থেকে ভাল তা তখনই বুঝা যাবে। যোগ্যতার বিচার আপনারা যখন সার্টিফিকেট দিয়ে করেন তখন বাকি বিষয়ধারীদের আর কিইবা করার থাকে।

যারা ২০০৪ সালে এইচএসসি পাস করেছিল তারা এখন অন্যদের তুলনায় আরো ভীষণ রকম বিপদে আছে। সরকার নির্ধারণ করেছিল গ্রেড পয়েন্ট ৫-এর মধ্যে ৩ পেলেই প্রথম শ্রেণি ধরা হবে। সেই দিক বিবেচনা করেই সব চলছিল। ইদানীং দেখা যাচ্ছে- বিজ্ঞাপনগুলোতে গ্রেড পয়েন্ট ৫-এর মধ্যে ৪ থেকে ৪.৫ চাওয়া হচ্ছে। ২০০৪ সালে বা তার আগে পাস করা ছাত্র-ছাত্রীদের কতজন ওরকম গ্রেড পয়েন্ট নিয়ে পাস করেছিল? তাদের বয়স শেষের পথে এবং তাদের মধ্যে অনেকেই বেকার। যাওবা স্বপ্ন ছিল, এখন গ্রেড পয়েন্টের খড়গের নিচে তারা মরিমরি করছে।

চাকরির বিজ্ঞাপনগুলোতে হাতে গোনা কয়েকটা বিষয় ছাড়া বাকি বিষয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা আবেদন করার সুযোগটুকুও পাচ্ছে না। এটা সম্ভবত বেকারত্বকে মাথায় পেতে নেওয়া অগণিত ছাত্র-ছাত্রী ছাড়া এ দেশের কারো চোখে পড়ে না, কারো মাথায় ঢোকে না। হাতে গোনা বিষয়গুলো ছাড়া বাকিরা যদি আবেদন করার সুযোগই না পাবে তবে বন্ধ করে দিন ওই সব বিষয় যার কোনো বাজার মূল্য নেই। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যার একবার বলেছিলেন- এ দেশে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে দুটো বিষয়ে পড়তে সুযোগ দেওয়া উচিত। একটা হলো—বিবিএ-এমবিএ যা দিয়ে সে চাকরি করে খাবে, আরেকটা হলো—সে অন্তর থেকে যে বিষয়ে পড়তে ইচ্ছা করে সেটা।

বিসিএস এবং সরকারি কিছু কিছু চাকরি ছাড়া কর্ম জীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। সেগুলো বাদেও পণ্য বাজারজাত করে এমন সব কোম্পানিতে মার্কেটিং-এর চাকরির ক্ষেত্রেও বাকি সব বিষয়কে মূল্যায়নও করা হয় না। গুঁড়ো দুধ বিক্রি করুন আর সয়াবিন তেল বিক্রি করুন- সব ক্ষেত্রেই হাতে গোনা কয়েকটি বিষয় ছাড়া বাকিরা যেন যোগ্যই নয়। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন জেনে শুনে ওসব বিষয়ে ভর্তি করিয়ে পড়ানো হচ্ছে? এটাকি বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানে না? জানার পরও কেন ওসব বিষয় চালু রয়েছে?

হয় চাকরি ক্ষেত্রে এই সব বিষয় বৈষম্য দূর করুন নয়তো চাকরির বাজারে হাতে গোনা যে বিষয়গুলো সবাই মূল্যায়ন করছে সেগুলোর বাইরের সব বিষয় বন্ধ করে দিন। কথায় বলে দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল। যে বিষয়ে পড়ে কর্ম জীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হয় সেই সব বিষয়ে পড়ার চেয়ে না পড়াই কি ভাল নয়?

ঢালাওভাবে এ প্লাসের বন্যা শুরু হওয়ার আগে যারা এইসএসসি পাস করেছিল তাদের কথা বিবেচনা করে সর্বক্ষেত্রে গ্রেড পয়েন্ট ৩ প্রাপ্তদের আবেদন করার সুযোগ দিতে হবে। যে কোনো চাকরির ক্ষেত্রে (ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ক্ষেত্র বিশেষ বাদে) প্রাথমিক আবেদনের ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ের বেড়াজাল রাখা চলবে না। ডিজিটাল বাংলাদেশে ওগুলো এক একটা এনালগ সিস্টেম ছাড়া আর কিছু নয়। প্রাথমিক আবেদনের সুযোগ সবারই থাকা উচিত। তারপর ধাপে ধাপে কেউ মেধার বলে টিকে গেলে সে যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। চাই সে আরবিতেই পড়ুক আর সংস্কৃতিতেই পড়ুক। আর না টিকলে সে বিবিএ-এমবিএ হলেও বাতিল বলে বিবেচিত হোক এটাই সবার কাম্য।

মূলত আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষার বড়ই অভাব। কারিগরি শিক্ষাই বলি আর অন্যান্য বিষয় বলি- কোনোটাই মূলত এদেশের অধিকাংশ কাজের সঙ্গে খাপ খায় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছার পর এ দেশ যেদিন উন্নত দেশে পরিণত হবে সেদিন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইচ্ছা মতো যে কোনো বিষয় নিয়ে পড়লেও কোনো সমস্যা থাকবে না। কারণ তখন কর্মসংস্থানের কোনো অভাব থাকবে না। তবে বর্তমান পরিস্থিতির কথা চিন্তা করলে নীতিনির্ধারকদের আরো কড়া হতে হবে। চাকরিদাতারা কেন অন্য সব বিষয়কে আবেদনের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করছে তার জবাব চাইতে হবে। সেই সঙ্গে সরকার নির্ধারিত গ্রেড পয়েন্ট তিনের বদলে কেন ৪ বা ৪.৫ চাওয়া হচ্ছে, তাও খতিয়ে দেখতে হবে। পাঁচটা বিষয়কে প্রধান্য দিয়ে বাকি ত্রিশটা বিষয়কে পায়ে মাড়িয়ে গেলে দেশে একদিন বেকারত্ব এতো বেড়ে যাবে যে জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ তখন বেকার হয়ে বসে থাকবে। এদেশের আকাশ সেদিন বেকারের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠবে। সে ভার সইবার মতো শক্তি তো আমাদের নেই।

জাজাফী
www.zazafee.com
লেখক :শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সংগৃহীত

Facebook Comments