আফরোজা হাসান
চাইল্ড অ্যাবিউজ:
পৃথিবীর সব বাবা-মা’রাই সন্তানের ভালো চান। সন্তান যাতে ভালো হয় তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু শিশুদেরকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।
শিশুদের বৈচিত্র্যতার চেয়েও বেশি দেখেছি বাবা-মাদের বৈচিত্র্যময় আদর-সোহাগ-ভালোবাসা এবং শাসন-শোষণ। জেনে বা না জেনে কিংবা বুঝে বা না বুঝে বাবা-মারা বাচ্চাদের উপর নানা ধরণের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন।
শারীরিক আঘাত চোখে দেখা যায় তাই পরবর্তীতে বাবা-মা তাতে মলম লাগাতে পারেন বা চেষ্টা করেন।
কিন্তু মানসিক আঘাত………!!!
এই আঘাতের কারণেই হয়তো শিশুদের মানসিকতার সঠিক বিকাশ বাধাঁপ্রাপ্ত হয়। কারণ বিভিন্ন ইন্দ্রীয়ের সাহায্যে শিশুরা বিভিন্ন বস্তুগত গুণাবলী ও ঘটনা সম্পর্কে ধারণা বা উপলব্ধি করতে শেখে।
আর এর উপর নির্ভর করেই শিশুদের মধ্যে জন্ম নেয় স্মৃতিশক্তি, কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা, বিচারবুদ্ধি ইত্যাদি।
আমার পরিচিত একটি বাচ্চা আছে।
১.বাচ্চাটা কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারেনা,
২.স্থির হয়ে বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসতে পারে না,
৩.কোন কিছু করতে বললেও ঠিকমতো করতে পারেনা,
৪.একটুতেই রাগ করে-কান্না করে, ৫.বেখেয়ালি তাই খুব ভুল করে বা ভুলে যায়।
বাচ্চাটির বাবা-মাকে যদি পরামর্শ দেয়া হয় যে, ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান তারা দুজনই ভীষণ বিরক্ত হন বা রাগ করেন। মোটকথা তারা মানতেই রাজী না যে তাদের বাচ্চাটি এডিডি বা এটেনশন ডেফিসিট ডিজঅর্ডারের শিকার। কেউ বোঝাতে গেলে উল্টো তাদের সাথে মনোমালিন্য হয়। অথচ সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসার কোন কমতি নেই। বাচ্চা যা চাইছে বলার সাথে সাথে তা সামনে এনে হাজির করেন। কিন্তু মানুষ বলবে যে তাদের বাচ্চাটা স্বাভাবিক না, সে ভয়তে বাচ্চাকে ডাক্তারের কাছে নিতে চায় না বা নিজেরাও মানতে চায়না।
প্রতিবেশী একজনকে দেখেছি বাচ্চা কিছু করতে না চাইলে, নানাভাবে ভয় দেখিয়ে সে কাজটি করতে বাধ্য করে। কেউ আছেন সারাক্ষণ টিভি চ্যানেল আর ফোনালাপ নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকেন যে, তখন বাচ্চা কথা বলতে চাইলে ধমক দিয়ে আরেক দিকে পাঠিয়ে দেন।
একজন মাকে দেখেছি বাংলাদেশ থেকে জালিবেত নিয়ে এসেছেন তার পাঁচ বছর বয়সি মেয়েকে শায়েস্তা করার জন্য। এক মা বুকফাটা কান্নার সাথে জানিয়েছিলেন, সাত বছর বয়সি ছেলেটাকে তাঁর স্বামী সামান্য কারণেই মাথায় তুলে সোফা বা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলেন, কখনো লাথি দেন আর বাকিটা নাহয় নাই বললাম।
যে কোন ধরণের আচার-ব্যবহার-কাজ যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বা ভালো থাকায় বাঁধা দেয়, তাকেই এককথায় চাইল্ড অ্যাবিউজ বলে।
চাইল্ড অ্যাবিউজকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে-
♠ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ বা যে কোন ধরণের নিয়ন্ত্রণহীন শারীরিক আঘাত।
♠সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ বা শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে যে কোন রকমের যৌন সংসর্গ।
♠বিহেবিয়ার অ্যাবিউজ বা শিশুর প্রতি অবহেলা-অমনোযোগিতা।
♠ইমোশনাল অ্যাবিউজ বা নানাভাবে শিশুকে বাধ্য করা।
এই প্রত্যেকটি কারণের দ্বারাই শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে এই প্রত্যেকটি কারণ নিয়েই আলোচনা করবো।
চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ
চাইল্ড অ্যাবিউজ নিয়ে কথা বলছিলাম প্রতিবেশী কয়েকজন ভাবীর সাথে। সবাই চলে যাবার কিছুক্ষণ পর এক ভাবী ফিরে এলেন আবার। চেহারা দেখেই বুঝতে পারলাম কিছু বলতে চান। বেশ সময় নিলেন উনি নিজেকে গুছাতে তারপর বললেন, ভাবী আমি যখন ছোট ছিলাম আমাদের বাসায় আমার দূর সম্পর্কের এক মামা থাকতেন। উনি আমাকে খুব আদর করতেন, জড়িয়ে ধরতেন……….!! এসব কি তাহলে অ্যাবিউজ ছিল? কিন্তু আমি তো তখন অনেক ছোট ছিলাম। মাত্র আট বছর বয়স ছিল আমার। বেশির ভাগ সময় আড়ালে করলেও, মাঝে মাঝে তো আব্বু-আম্মুর সামনেও আমাকে আদর করেছে মামা। উনারা তো কখনো কিছু বলেননি। বলেন না ভাবী আমি কি অ্যাবিউজের স্বীকার তাহলে? সংসার জীবনে খুব সুখী এই মেয়েটিকে সে যে অ্যাবিউজের স্বীকার ছিল, বুঝিয়ে বলতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছিলো। কিন্তু এখনো মেয়েটা সেসব ভেবে নীরবে কান্না করে।
ক্লাস টেনে পড়তাম তখনকার ঘটনা। আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবীটা ছিল ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে আমুদে স্বভাবের। হঠাৎ করে একদিন ওকে ভীষণ চুপচাপ দেখে কি হয়েছে জানতে চাইলাম। অনেক করে জিজ্ঞেস করার পর বললো, দুই সপ্তাহ ধরে আমার আব্বুর এক বন্ধু আমাকে টিউশন দিচ্ছে। প্রথম থেকেই উনি যেন একটু কেমন। প্রথমে ড্রইংরুমে বসে পড়তাম কিন্তু উনি শুধু বেডরুমে বসে পড়লে পড়ায় মনোযোগ বেশি এমন নানা কথা আম্মুকে বললে, পড়ার সুবিধার কথা চিন্তা করে বেডরুমে পড়ার পারমিশন দিয়ে দিলেন আম্মু। তারপর থেকে উনি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নানা ধরণের নোংরা জোকস বলা শুরু করলেন। আর গতকাল আমাকে বললেন যে, তুমি এতো ঢেকেঢুকে বসো কেন? আরো একটু খোলামেলা হয়ে বসবে, এতে দেখতে সুবিধা হয়……..!! আমি এখনই কিছু না করলে লোকটা আরো সাহস পাবে। কিন্তু লজ্জার কারণে আব্বু-আম্মুকে বলতে পারছি না এসব কথা। পরে আমরা কয়েক বান্ধবী মিলে ওর আম্মুকে বলেছিলাম।
এমন অসংখ্য ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে আমাদের চারপাশে। বাবা-মার চোখের সামনে তাদের আদরের সন্তানটি অ্যাবিউজের স্বীকার হচ্ছে কিন্তু তারা বাঁধা দেয়া তো দূরে থাক টেরই পাচ্ছে না। বুক দিয়ে যাদের কাছ থেকে আগলে রাখার কথা সন্তানকে, অজ্ঞতার কারণে নিজেরাই ঠেলে দিচ্ছে তাদের কাছে। আর এই ধরণের ঘটনাগুলো বেশির ভাগই ঘটে ঘরের একান্ত কাছের আত্মীয়-স্বজনদের দ্বারা। যারা আদরের ছলে এমন সব বিকৃত কাজ করে, শিশুরা অস্বস্তিবোধ করলেও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না যে এটা আদর নাকি অন্য কিছু। যার ফলে তারা কারো কাছে বিষয়টি জানায় না বা জানাতে যে হবে সেটাও বুঝতে পারে না।
ঘরের মানুষ ছাড়াও যারা শিশুদের কাছে আসার সুযোগ পায়, যেমন বাসার কাজের মানুষ, গৃহশিক্ষক, আশেপাশের বাড়ি বা ফ্ল্যাটের কেউ, স্কুলের কেউ তাদের সবার ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
শিশু ছেলে হোক বা মেয়ে উভয়ই এই ধরণের অ্যাবিউজের স্বীকার হতে পারে।
আর এসব ঘটনা থেকে তাদের মধ্যে তৈরি হতে পারে নানা ধরণের ছোট-বড় মানসিক সমস্যা, হীনমন্যতা, ব্যক্তিত্বহীনতা, ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রভৃতি।
কেউ কেউ মারাত্মক কিংবা অপূরণীয় শারীরিক ক্ষতির স্বীকার হয় এর ফলে।
শিশুরা যাতে এই ধরণের জঘন্য হয়রানির স্বীকার হতে না পারে, সেজন্য সবার প্রথমে বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে।
কে কি মনে করবে ইত্যাদি চিন্তা করে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা লজ্জায় না ভুগে ঘরে অবস্থানরত অন্যান্য সদস্যদের সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে শিশুদের কতটুকু আদর করা যাবে।
আর শিশুদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে কোন ধরণের আদর গুলো পচা, শরীরের কোন কোন অংশে কাউকে ছুঁতে দেয়া যাবে না।
এবং বাবা-মাকে অবশ্যই সন্তানদের সাথে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে যাতে তারা তাদের কোন কথা বাবা-মাকে বলতে দ্বিধা না করে। বাচ্চারা যদি কারো সাথে বাইরে যায় ফিরে আসার পর প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে বাইরে কি হয়েছে, কি দেখেছে, কি করেছে ইত্যাদি।
তার মানে এই নয় যে, আমরা প্রতিটা সম্পর্ককেই সন্দেহের চোখে দেখবো। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, বিভিন্ন কেস স্টাডি থেকে পাওয়া যায় এই ধরণের বিকৃত মানসিকতার মানুষগুলো চাচা-মামা-খালু-দুলাভাই-কাজিন-এমনকি দাদা-নানা….. পর্যন্ত হতে পারে।
সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য যদি নিজেকেও সতর্কতার চোখে দেখতে হয়, আমার মনেহয় সেটাই করা উচিত। কে কি মনে করলো সেই চিন্তায় যেন আমরা আমাদের সন্তানদেরকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে না দেই।
সাইকোলজি(পিএইচডি)