খুব ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম ব্যারিস্টার হওয়ার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে চান্স না পেয়ে ভেঙে যায় স্বপ্ন। পরবর্তীতে ভর্তি হই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। এভাবেই তার জীবনের কথা বলছিলেন চাঁদপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার। ১৯৯১ সালে ভর্তি হন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে। শামসুন্নাহার বলেন, প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ লাগতো কাঙ্ক্ষিত সাব্জেক্টে পড়তে না পেরে। কিন্তু পরবর্তীতে ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের ভালবাসায় আর সহপাঠীদের সহযোগিতায় ভালো লাগতে শুরু করে সবকিছু। রোকেয়া হলে থাকাকালীন যোগ দেন বিএনসিসিতে । বিএনসিসি’র বিমান শাখার ক্যাডেট ছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে বিএনসিসি’র পক্ষ থেকে যশোরে যান। সেখানে বিমানবহিনীর কার্যক্রম দেখে মুগ্ধ হন। সেখানকার পাইলটদের ইউনিফর্ম, নিয়ম-শৃঙ্খলা, জীবন প্রণালি মুগ্ধ করে তাকে। আর তখনই মনে মনে স্বপ্ন দেখতে থাকেন এমন একটা চাকরির যেখানে ইউনিফর্ম পরা যাবে। নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে।
মূলত ইউনিফর্মটাই আমাকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল কিছুটা হেসে বললেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। আর তাই দেরি না করে তখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন বিসিএস’র। ১৯৯৬ সালে অনার্স পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পরই অংশগ্রহণ করেছিলেন ২০তম বিসিএস পরীক্ষায়। নিষ্ঠা আর কঠোর সাধনায় হয়েছেন সফল। প্রথম পছন্দই ছিল পুলিশ। এখনও বিসিএস’র ফল প্রকাশের দিনটির কথা মনে হলে আনন্দিত হন এই পুলিশ সুপার। ফল প্রকাশের সময় তিনি ছিলেন ৮ মাসের গর্ভবতী। আর তাই ফল প্রকাশের পর যখন ভবিষ্যতে শক্ত, মজবুত অবস্থানের হাতছানি পান তখনই ভেসে যান আনন্দে।
চার ভাইবোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও এমফিল সম্পন্ন করার পর স্কলারশিপ নিয়ে চলে যান যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তার ভাইবোনও তার মত স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তারা ২ বোন ও ২ ভাই। সবার বড় তিনি। মা-বাবার স্বপ্নও তাকে নিয়ে ছিল তাই আকাশ ছোঁয়া। মেজো ভাই ডাক্তার। সেজো ভাই হাইকোর্টের আইনজীবী। সবার ছোট বোন স্কুলের শিক্ষিকা। দুই সন্তানের জননী এই সফল নারী। বড় সন্তানের বয়স ১৫। ছোট সন্তানের ৪। সুযোগ পেলেই গানের চর্চা করেন। নজরুলগীতি তার সবচেয়ে পছন্দের। বিটিভি’র তালিকাভুক্ত শিল্পী, এই এসপি অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। মুগ্ধ করেন তার সুরের মায়ায় দর্শকদের। নজরুলের খেলিছ এ বিশ্বলয়ে বিরাটও শিশু গানটি তার পছন্দের।
২০০১ সালে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের পর পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা মেট্রপলিটন পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশসহ বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের শাখা অফিস ইতালিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ২০০৯ ও ২০১০ সালে পূর্ব-তিমুরে জাতিসংঘ মিশনের জাতীয় পুলিশের মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব পালন করেন। জাতিসংঘে উচ্চপদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন সাতবার জাতিসংঘ শান্তি পদক। তাছাড়া পুলিশে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য পেয়েছেন দুইবার আইজি ব্যাজ।
শামসুন্নাহার ২০১৫ সালের ১২ই জুন চাঁদপুরে পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন। এর পরপরই তিনি সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি কমিউনিটি পর্যায়ে পুলিশের কার্যক্রমকে আরো বিস্তৃত করেছেন। যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনার জন্য কাউন্সিলিং করে। সুযোগ পেলে চলে যান নিজেই। তিনি প্রমাণ করতে চান পুলিশ জনগণের বন্ধু। আর কাজও করে যাচ্ছেন সেই লক্ষ্যে। তার অফিসের একপাশেই গড়ে তুলেছেন নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সেল। যেখানে গড়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন নারী আসেন তাদের অভিযোগ নিয়ে। এর ফলে চাঁদপুরে অপরাধপ্রবণতা অনেক কমেছে। তার অরেকটি বড় পরিচয় পুলিশ সপ্তাহ-২০১৬ এ প্যারেডের নেতৃত্ব দেন তিনি। পুলিশ সপ্তাহের এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মহানগর পুলিশ, রেঞ্জ পুলিশ, আর্মড পুলিশ, ও র্যাবসহ ১৩ টি দলের সহস্রাধিক সদস্যের প্যারেডে নেতৃত্ব দেন এই গর্বিত নারী পুলিশ।
দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোনো নারী কর্মকর্তা পুলিশ সপ্তাহের প্যারেডে নেতৃত্ব দেন। আর এর মাধ্যমে তিনি গড়েন এক নতুন ইতিহাস। পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার বলেন, লোকমুখে শুনতে পেতাম পুলিশের দায়িত্ব শুধু ছেলেরাই পালন করতে পারে। মেয়েদের পক্ষে এই গুরুদায়িত্ব পালন করা অসম্ভব। কিন্তু কর্মজীবনে প্রবেশের পর দেখেছি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ কাজে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। নেই কোনো অসুবিধা। বরং রয়েছে দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করতে পারার এক অপরিসীম পরিতৃপ্তি। প্যারেডে নেতৃত্ব দেয়ার বিষয়টি নিয়ে শামসুন্নাহার মানবজমিনকে বলেন, প্যারেডে নেতৃত্ব দেয়া আমার স্বপ্ন ছিল। ২০০১ সাল হতে পুলিশ একাডেমি সারদার ক্যাম্প থেকে প্যারেড করছি। প্যারেড একটি দায়িত্বশীল ও সূক্ষ কাজ। এজন্য প্রয়োজন পরিশ্রম ও নিষ্ঠা। একটি বাহিনীর প্যারেড কমান্ডার হওয়া সবার জন্যই গৌরবের। প্যারেডে কমান্ডার হওয়ার গৌরব অর্জন করায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত। ২০০৮ সালে তিনি পুলিশ সপ্তাহের প্যারেডের উপ-অধিনায়ক ছিলেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকায় সেদিন কমান্ডার হওয়ার সুযোগ ছিল না। আর তাই অপেক্ষায় ছিলেন এই দিনটির। তার নেতৃত্ব ও দৃঢ় পদক্ষেপ স্বয়ং নজর কাড়ে প্রধানমন্ত্রীর।
জীবনের সকল ক্ষেত্রে সফল এই নারী মানবজমিন-এর মাধ্যমে বিশ্ব নারী দিবসে সকল নারীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, আমরা মেয়েরা রক্ত মাংসের পিণ্ড নই। আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরা মানুষ। আমরা সবকিছু করতে পারি। নিজেদেরকে অবহেলিত ভাবার কোনো অবকাশ আমাদের নেই। আমরা নিজেদের খাদ্যের সংস্থান করতে পারি। করতে পারি আমাদের মা-বাবাদের জন্য, সন্তানদের জন্য । প্রয়োজনে আমরা আমাদের স্বামীদেরও খাদ্যের সংস্থান করতে পারি। আমরা ঘরে-বাইরে সব জায়গায় সমানভাবে কাজ করতে পারি। অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কন্যা শিশুদেরকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। একটি ছেলেকে আপনারা যেভাবে সবকিছু দিয়ে সাপোর্ট দেন। মেয়েদের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই হতে হবে। নারীদের তিনি যার যার অবস্থান থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি মনে করেন নারী-পুরুষের বৈষম্য যদি একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে মূলোৎপাটন করা যায় তাহলেই একটি সুখি ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।
Facebook Comments