banner

মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 195 বার পঠিত

 

ঘুরে দাঁড়িয়েছেন হনুফা

‘এমন সময় গ্যাছে, তিন-চাইর দিন ভাতের পাতিল পাহায় (চুলায়) বহাইতে পারি নাই। মাইনষের তোন চাইয়াচিন্তা পোলাপানরে খাওয়াইছি। মাছ-মুকরা (মুরগি) খাই নাই বচ্ছরের পর বচ্ছর। ঘর আছিল না। বিষ্টিতে ভিজজি, শীতে কোঁকড়া দিয়া রইছি। কী যে কষ্ট করছি হেই সময়।’
এভাবেই নিজের পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণা করেন ৫৫ বছর বয়সী হনুফা বিবি। তিনি মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। আবার অনেক সময় কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতেও কাজ করেন। একসময় দুবেলা খাবার জোটাতে না পারলেও নিজ প্রচেষ্টায় হনুফা বিবি তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন। এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না। এমনকি স্থায়ী একটি মাথা গোঁজার ঠাঁইও তৈরি করেছেন।
১২ বছর বয়সে আদেল খলিফার দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে শ্বশুরবাড়ি আসেন হনুফা বিবি। হনুফার শ্বশুরবাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বোরাদী গরঙ্গল গ্রামে। বাবার বাড়ি পাশের গ্রাম কলাবাড়িয়ায়। শৈশব পেরোতেই শ্বশুরবাড়ি। আর শ্বশুরবাড়ি আসতে না-আসতেই হনুফাকে কাঁধে তুলে নিতে হয় স্বামীর আগের পক্ষের সন্তানের দায়িত্ব, সংসারের হাল। গত ৯ জুলাই বোরাদী গরঙ্গলের এক বাসায় কাজ করার ফাঁকে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
শুরু থেকেই সংসারে টানাপোড়েন। স্বামী কিছুদিন পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। সে কারণে ঘরে চুলাও জ্বলে অনিয়মিত। ছেলেমেয়ে নিয়ে আধপেটা খেয়ে, কখনো না খেয়ে দিন কাটাতে হয়। এর মধ্যেই ধরা পড়ে স্বামীর ব্লাড ক্যানসার। হনুফা বলেন, ‘হ্যার ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে। ডাক্তার দেহাইতে যাইয়া জাগা-জমিন হগল খুয়াইছি। হে ভালো অইল না। মইর্যাে গেল।’
স্বামীর মৃত্যুর সময় হনুফার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। মেয়ে বিবাহযোগ্য। নিজের ছেলে রোগা। কোনো কাজ করতে পারে না। স্বামীর আগের পক্ষের ছেলে খোঁজ নেয় না। এদিকে স্বামীর চিকিৎসায় বাড়ি, সম্পত্তি সব বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এ অবস্থায় ছেলেমেয়ে নিয়ে কী করবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েন।
মাঝেমধ্যে অন্যের ফরমাশে কাঁথা সেলাই করলেও ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হবে—কখনো ভাবেননি হনুফা বিবি। কিন্তু বেঁচে থাকার তাগিদে ঘরের বাইরে পা রাখতে হয় তাঁকে। বলেন, ‘তহন পরথম নগরে (হিন্দুপাড়া) আহি। মাইনষের বাড়ি কাম করা শুরু করি। যে যহন বোলায়, হ্যার কামই করি। এরম কাম কইর্যাুই পোলা-মাইয়ার মুহে খাওন দেই। আস্তে আস্তে বাঁচনের স্বপন দেহি।’
বছরের ৩৬৫ দিনই হনুফা বিবি কাজ করেন। বাদ যায় না ঈদের দিনও। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, তীব্র শীতেও তাঁকে কাজ করতে হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন। পারিশ্রমিক তিনবেলা খাবার, সঙ্গে দুই শ টাকা। রাতের খাবারটা বাড়িতে নিয়ে যান। তবে অনেকেই পারিশ্রমিকের চেয়ে বেশি টাকা দেন বলে জানান তিনি।
বাইরে পা দিয়ে হনুফা বিবি কেবল খাবারের ব্যবস্থাই করেননি, ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবতে শুরু করেন তিনি। খেয়ে না-খেয়েই করতে থাকেন সঞ্চয়। টাকা জমিয়ে ছোট হলেও একটি টিনের ঘর তোলেন; যেখানে ছেলে-ছেলেবউ-নাতি নিয়ে বসবাস করছেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
মানুষের বাসায় কাজ করতে গিয়েই পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝতে পারেন হনুফা। তিনি বলেন, ‘কাম করতে যাইয়াই বুজি লেহাপড়ার কদর। কষ্ট কইর্যারও পোলা-মাইয়ারে লেহাপড়া করাইলে আয়ের এট্টা উপায় হইত। মাইনষের বাড়ি কাম করা লাগদো না।’ তাই নাতিদের পড়াশোনায় জোর দেন তিনি। তাঁর ছেলের ঘরের এক নাতি প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। আরেক নাতি পঞ্চম শ্রেণিতে, যার রোল নম্বর ১। নাতিদের লেখাপড়ার সব দায়িত্ব হনুফা বিবিই বহন করেন।
হনুফাকে ছাড়া এলাকার কোনো বিয়েবাড়ির কাজই হয় না। এতে তাঁর পারিশ্রমিকের সঙ্গে পাঁচ শ টাকা ও একটি শাড়ি বকশিশ হিসেবে নির্ধারিত। কেউ কেউ আবার বেশিও দেন। হনুফা বলেন, ‘হগলে আমারে ভালো পায়। কাম কইর্যাে যা পাওনের, হ্যার থিকা বেশি দেয়। না অইলে বাঁচতে পারতাম না।’
হনুফা বিবি কোনো রকমে নিজের নাম লিখতে পারলেও জীবনের বাস্তবতা ভালো বোঝেন। শেষ জীবনে কাজ করতে পারবেন না। বন্ধ হয়ে যাবে রোজগার। তবে এ সময় কারও কাছে বোঝা হতে চান না তিনি। এ জন্য ব্যাংকে ৬০ হাজার টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করেছেন। তিনি বলেন, ‘যহন বুড়া অইয়া যামু, এই টাহায় চলমু। কারও কাছে হাত পাতমু না।’

Facebook Comments