আফরোজা হাসান
দুপুর থেকে ছেলের কর্মকাণ্ড দেখে খুবই মজা পাচ্ছিলো তাইয়্যেবাহ। বছর খানেক আগে আরিশকে একটি পিগি ব্যাংক কিনে দিয়েছিল। দুপুরে সেটা ভাঙার পর হিসাব করে দেখা গিয়েছে সব মিলিয়ে আরিশের জমানো টাকার পরিমাণ চারশো ইউরো। জমানো টাকার পরিমাণ চারশো ইউরো দেখে যতটা আনন্দিত হয়েছে আরিশ তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি আনন্দিত হয়েছে এই তথ্য জানার পর যে, চারশো ইউরো মানে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। এরপর থেকে টাকা দিয়ে কি করবে সেই পরিকল্পনা করছে আরিশ। একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হতে না হতেই সেটা বাদ দিয়ে নতুন আরেকটি পরিকল্পনার জন্য চিন্তাভাবনা শুরু করে দিচ্ছে। তাইয়্যেবাহ চুপচাপ ছেলের কান্ড দেখে আনন্দ নিচ্ছিলো। নিজ থেকে কোন পরামর্শ দেবার চেষ্টা করেনি। জানা আছে শেষমেশ তার কাছেই আসবে আরিশ ঘুরে ফিরে। এবং তাইয়্যেবাহর জানাকে সত্য প্রমাণিত করে বিকেলবেলা আরিশ হাজির হলো তার জমানো অর্থ সম্পদ সহ। খানিকটা চিন্তিত কন্ঠে বলল, আম্মু আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না আমার টাকা দিয়ে কি করবো। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?
তাইয়্যেবাহ হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ অবশ্যই সাহায্য করবো বাবা। কিন্তু তারআগে বলো তোমার কি কি করতে ইচ্ছে করছে তোমার টাকা দিয়ে।
গড়গড় করে নিজের পছন্দের একগাদা গেমসের নাম বললো আরিশ। যেগুলো কিনতে ইচ্ছে করছে। এছাড়া আগামী রামাদানের ঈদ উপলক্ষ্যে বাবা তাকে যে গেমসটা কিনে দেবার কথা বলেছেন সেটাও এখনই কিনে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ঈদের সময় বাবার কাছ থেকে অন্যকিছু নেবে। নতুন যে হালাল খাবারের বুফে রেস্টুরেন্টটা হয়েছে তাদের বাসায় কাছে সেখানে বাবা, আম্মু, ভাইবোন আর খুব প্রিয় দুজন বন্ধুকে নিয়ে খেতে যেতেও ইচ্ছে করছে। নানাভাই, নানুমণি, দাদাভাই, দাদুমণিকে তাদের পছন্দের কোন উপহার দিতে ইচ্ছে করছে। এমন আরো অনেক কিছু করার ইচ্ছের কথা জানালো আরিশ।
ছেলের পরিকল্পনা শুনে তাইয়্যেবাহ হাসি মুখে বলল, তোমার টাকা তুমি অবশ্যই নিজের মতো খরচ করতে পারো। আম্মুর এতে কোনই আপত্তি নেই। কিন্তু তোমার নিশ্চয়ই মনেআছে বেশ কয়েকদিন আগে আম্মু তোমাকে বলেছিলাম, কোন কাজ করার সময় আমাদের সম্মুখে যখন অনেকগুলো অপশন খোলা থাকে। তখন আমাদের চেষ্টা করা উচিত সবচেয়ে উত্তম কাজটি করার।
হ্যা, আম্মু আমার মনেআছে তো তোমার কথা। সেজন্যই তো আমি তোমার কাছে এসেছি। তুমি বলে দাও কি করবো আমি।
তুমি কি ভেবে দেখেছো তোমার টাকা দিয়ে সবচেয়ে উত্তম কি কাজ করা যায়?
বুঝতে পারছি না। তুমি বলে দাও।
তোমার মনেআছে আরিশ গতবার যখন আমরা দেশে গিয়েছিলাম তখন আমার এক খালামণির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম তোমাকে? ঐ যে যার দুই ছেলের সাথে তুমি অনেক খেলা করেছিলে।
মনে নেই আবার। উফফ, ওরা আমাকে অনেক বিরক্ত করেছে। বিশেষ করে ছোট ছেলেটা।
তাইয়্যেবাহ হেসে বলল, বিরক্ত করেছে ঠিক। কিন্তু তোমার সাথে খেলাও তো করেছে। তা না হলে তোমাকে তো একাই খেলা করতে হতো। তাই না?
হ্যা তাও ঠিক।
কিছুদিন আগে কি হয়েছে শুনবে?
কি হয়েছে আম্মু?
আমার সেই খালামণির হাজবেন্ড মারা গিয়েছেন। খালামণি এখন খুবই বিপদে আছেন উনার দুই ছেলে নিয়ে। ওদের লালন-পালন, পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদিতে অনেক খরচ। খালামণির এখন এতটা খরচ বহন করার সামর্থ্য নেই। ওদের দুজনের স্কুলে যাওয়াটাই এখন অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরিশের হাস্যেজ্জ্বল চেহারায় ধীরে ধীরে আঁধার ছেয়ে গেলো। মন খারাপ করা কন্ঠে বলল, ওদেরকে সাহায্য করার কেউ নেই? তুমি আর বাবা সাহায্য করছো না কেন?
তাইয়্যেবাহ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমি আর তোমার বাবা মিলে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। তুমি যদি চাও তাহলে তুমিও আমাদের সাথে যোগ দিতে পারো। তুমিও ওদেরকে সাহায্য করতে পারো।
আমি? আমি কিভাবে সাহায্য করবো আম্মু?
তোমার মনে নেই সেদিন আমরা দান-সাদাকাহর উপরে হাদীস পড়েছিলাম?
হ্যা আম্মু আমার মনে আছে তো। রাসূল (সঃ) বলেছেন, ”যে ব্যক্তি কোন অভাব গ্রস্তের অভাব দূর করবে, আল্লাহ তার দু’নিয়া ও আখিরাতের সকল বিষয় সহজ করে দিবেন।” এরপর থেকে আমাদের স্কুলের পাশে মেট্রো স্টেশনের কাছে গরীব যারাই সাহায্যের জন্য বসে থাকে আমি তাদেরকে দেখতে পেলেই সাহায্য করি। গত সপ্তাহে তুমি যে আমাকে অনেক বেশি করে কুকিস দিয়েছিলে ফ্রেন্ডদের সাথে নিয়ে খাওয়ার জন্য। আমি ফ্রেন্ডদের না দিয়ে ওখানে যে দুজন গরীব মানুষ ছিলেন তাদেরকে দিয়েছি। অনেক খুশি হয়েছিল।
তাইয়্যেবাহ ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল, আলহামদুলিল্লাহ।সবসময় এমন চেষ্টা করবে অভাবী মানুষদেরকে সাহায্য করার। জানো রাসূল (সঃ) আরো কি বলেছেন? বলেছেন, “সালাত (আল্লাহর) নৈকট্য দানকারী, সিয়াম ঢাল স্বরূপ এবং দান-ছাদকা গুনাহ মিটিয়ে ফেলে যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে ফেলে।” রাসূল (সঃ) আরো বলেছেন, “খেজুরের একটি অংশ দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা কর।” আর সবচেয়ে আনন্দের কি জানো?
কি আম্মু?
রাসূল (সঃ) বলেছেন, “মিসকিনকে দান করলে তা শুধু একটি দান হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু গরীব নিকটাত্মীয়কে দান করলে তাতে দ্বিগুণ ছওয়াব হয়। একটি সাদাকাহ’র; অন্যটি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার।” মানে হচ্ছে, তুমি যদি কোন গভীর দুঃখীকে দান করো তাহলে তোমার যে সওয়াব হবে, তুমি যদি আত্মীয়দের কাউকে দান করো তার দ্বিগুণ সওয়াব হবে।
একটুক্ষণ চিন্তা করে আরিশ বলল, তারমানে আমি যদি উসমান আর উসামাকে সাহায্য করি তাহলে মেট্রো স্টেশনে যারা থাকেন তাদেরকে সাহায্য করার চেয়ে দ্বিগুণ সওয়াব হবে?
ইনশাআল্লাহ অবশ্যই দ্বিগুণ সওয়াব হবে তোমার।
তাহলে আমি এখন থেকে উসমান আর উসামাকেই সাহায্য করবো। কিন্তু ওদেরকে আমি কিভাবে সাহায্য করবো আম্মু? ওরা তো বাংলাদেশে থাকে।
তুমি যদি সত্যিই ওদেরকে সাহায্য করতে চাও তাহলে এখান থেকেও করতে পারবে।
আমি সত্যিই ওদেরকে সাহায্য করতে চাই আম্মু।
তাহলে তুমি তোমার জমানো টাকা থেকে কিছু টাকা উসমান আর উসামার জন্য পাঠাতে পারো। জানো পঁয়ত্রিশ হাজার টাকায় ওদের দুজনের প্রায় এক বছরের পড়াশোনার খরচ চলে যাবে। তবে তোমাকে সব টাকা দিতে হবে না। তুমি চাইলে যে কোন একজনকে সাহায্য করতে পারো।
না না আম্মু আমি দুজনকে ই সাহায্য করতে চাই। তাহলে আমার অনেক বেশি সওয়াব হবে। কিন্তু ওদেরকে টাকা কিভাবে দেবো?
তাইয়্যেবাহ হেসে বলল, এখান থেকে টাকা পাঠিয়ে দেয়া যাবে বাংলাদেশে। তোমার বাবাকে দিলেই উনি পাঠিয়ে দেবেন।
তাহলে এক্ষুণি আমি বাবাকে আমার জমানো সব টাকা দিয়ে আসছি। বলতে বলতেই উঠে ছুট লাগালো আরিশ। তাইয়্যেবাহও আলহামদুলিল্লাহ বলে রব্বের কৃতজ্ঞতা আদায় করতে করতে ছেলের পিছু নিলো।