অপরাজিতাবিডি ডটকম: গর্ভাবস্থা একটি চরম উত্তেজনা ও উত্কণ্ঠার সময়কাল। বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের কথা শোনা এবং ডাক্তারের উপদেশ মেনে চলাও আর একটি কাজ। অনেক গর্ভবতী এই সময়ে দাঁত ও মাড়ি নিয়ে বেশ চিন্তিত থাকেন। দাঁতের যত্নে কয়েকটি বিষয় এখানে আলোকপাত করা হলো যা গর্ভাবস্থায় গর্ভবতীর দাঁত ও মাড়ি সুস্থ রাখতে সাহায্য করতে পারেঃ-
মাড়ির যত্ন
অনেক গর্ভবতী হয়ত লক্ষ্য করেছেন দাঁত ব্রাশের সময় মাড়ি থেকে রক্ত বের হয়। এটা অস্বাভাবিক কোনো কিছু নয়। গর্ভাবস্থায় দেহ হরমোনের পরিবর্তন হয় এবং তার প্রতিক্রিয়া মাড়িতেও দেখা দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় দুই মাস থেকে আট মাস পর্যন্ত এটি বেশী লক্ষণীয়। তাছাড়া উপদাহে বা উত্তেজন (Irritaion) কোনো কিছুতে মাড়ি খুব বেশী সংবেদী হয় এবং খুব সহজেই রক্তপাত হয়। তাই দেখা যায় গর্ভবতীর মাড়ির প্রদাহ বা (Gingivitis) এই অবস্থাকে বলা হয় গর্ভাবস্থার মাড়ির প্রদাহ। এই অসুবিধা মোকাবিলা করার জন্য সর্বাগ্রে যা করণীয় তা হলো গর্ভাবস্থার শুরু থেকে নিয়মিত দাঁত ব্রাশ বা পরিষ্কার করাকে নিশ্চিত করা যাতে ডেন্টাল প্লাক সৃষ্টি না হয়। এ ক্ষেত্রে দন্ত চিকিত্সকের পরামর্শ নিয়ে গর্ভাবস্থার পুর্বেই দাঁত স্কেলিং করা এবং সঠিক ব্রাশ চালনা পদ্ধতি জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
গর্ভাবস্থায় দাঁত ও মাড়ি পরীক্ষা
গর্ভাবস্থায় যেমন নিয়মিত একজন স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন তেমনি একজন দন্ত চিকিত্সকের কাছ থেকেও দাঁত ও মুখ পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
দাঁত কি ক্যালসিয়াম হারাচ্ছে
গর্ভবতী দাঁতের ক্যালসিয়াম কখনোই গর্ভের শিশুর দাঁতে চলে যায় না। বরং এটা নির্ভর করবে গর্ভবতী ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করছেন কিনা। তাই এই সময়ে গর্ভবতীকে প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাকসব্জি (সালাদ বানিয়ে) ও ফলমূল খাওয়া প্রয়োজন, যেমন- লাল শাক, পালং শাক, পুই শাক, গাজর, টমেটো, ঝিঙ্গা, পটল, আলু, লেটুস পাতা, কপি, সীম, বরবটি, লেবু শশা, আপেল, কমলা, জাম্মুরা, কলা পেয়ারা, আমলকি ইত্যাদি।
শর্করা জাতীয় খাদ্য
আহারের মধ্যবর্তী সময়গুলোতে শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণ বন্ধ রাখা প্রয়োজন। এতে যেমন দেহের বাড়তি ওজন কমানো সম্ভব তেমনি দাঁতের ক্ষয়রোগ রোধ করা সহজ। তবে প্রয়োজনীয় পরিমাণ শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণ একান্ত পয়োজন।
প্রসুতি মা ও শিশুর যত্ন
আমাদের দেশে মায়েদের মধ্যে শিশুকে ফিডার দিয়ে চিনি বা মিশ্রি মিশ্রিত দুধ খাওয়ানোর একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এর ভয়াবহ পরিনাম হচ্ছে এই ফিডারের কৃত্রিম দুধ শিশুর অভ্যাসে পরিণত হয় এবং পরবর্তীতে এই অভ্যাস ছাড়ানো খুব কষ্টকর হয়। বিজ্ঞানের দীর্ঘ গবেষণা কাজ প্রমাণ করেছে যে, শিশু জন্ম গ্রহণের পর থেকে তাঁর আহার্য হিসেবে মায়ের বুকের দুধের কোনো বিকল্প নেই। মায়ের বুকের দুধে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে যা শিশুকে বেড়ে উঠতে, রোগ প্রতিরোধ শক্তি জোগাতে ও মজবুত দাঁত গড়তে সর্বোপরী সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে যথেষ্ট এই ভিটামিনের অভাবে দাঁত ডেন্টাল ক্যারিজ রোগে বেশী আক্তান্ত হবে। তাই জন্মের পর থেকে শিশুকে অবশ্যই বুকের দুধ দিয়ে উত্সাহিত করা প্রয়োজন। এছাড়া শিশুর মুখে চিনি মিশ্রিত দুধের ফিডার রেখে ঘুম পাড়ানোর অভ্যাস দাঁতের জন্য ক্ষতিকর। এতে শিশুর ৬ মাস সময় উদ্গত দুধ দাঁতেও ক্যারিজ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রাতে দুধ খাওয়ানো শেষ হলে পাতলা ফ্লানেলের কাপড় অথবা তুলা দিয়ে দাঁতের উপর থেকে দুধের আবরণ পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
দাঁত উদগম কালে সাবধানতা
৬ মাস বয়সে দাঁতের উদগম শুরু হওয়ার আগেই শিশু খুব চঞ্চল ও অস্থির হয়ে উঠে। এই সময়ে শিশু যা কিছু সামনে পায় সেটাই কামড়াতে চায়। তাই এই সময় শিশুরর হাতের কাছে বিষাক্ত বা ধারালো কোনো দ্রব্য অথবা ওষুধ পত্র রাখা উচিত নয়। মায়েদের লক্ষ্য রাখা
প্রয়োজন এ সমস্ত জিনিষ শিশুর নাগালের বাইরে আছে।
দাঁত ব্রাশ
মা সকালে ও রাতে শিশুর সামনেই দাঁত ব্রাশ করবেন। মনে রাখা প্রয়োজন শিশু খুব বেশী অনুকরণ প্রিয়। সে যা দেখবে তাই করতে চাইবে। তাই শিশুর হাতে ছয় মাস বয়সে অর্থাত্ দাঁত উঠার শুরু থেকেই একটা ব্রাশ দেওয়া ভালো। শিশু তখন বড়দের দেখে তা অনুকরণ করতে চাইবে এবং পরবর্তীতে তা অভ্যাসে পরিণত হবে। এর পর থেকে শিশুকে হাতে ধরিয়ে সঠিক পদ্ধতিতে ব্রাশ চালনা শিক্ষা দিতে হবে। প্রসবের পর মা নবজাতক শিশুকে নিয়ে একটু বেশী ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন এবং এই সময়ে দাঁতের পরিচর্যা ও নিয়মিত করতে পারেন না। মাকে ভুললে চলবে না যে নিয়মিত সকালে ও রাতে দাঁত পরিস্কার না করলে মাড়ির সংক্রমণ এবং মাড়ি থেকে রক্ত পড়া আবার শুরু হতে পারে। তাই মাকে এই সময়ে সন্তান পরিচর্যার সাথে সাথে নিজের পরিচর্যা করা প্রয়োজন।
ফ্লুরাইড
ফ্লুরাইড বাড়ন্ত শিশুর দাঁতের ক্ষয় রোগ প্রতিরোধে খুবই কার্যকর, তাই শিশুর ৬ মাস বয়সের পর থেকে দুধ দাঁতকে রোগ মুক্ত রাখবার জন্য ফ্লুরাইড মিশ্রিত টুথপেষ্ট দেয়া প্রয়োজন। লক্ষ্য রাখতে হবে শিশু যেন ফ্লুরাইড মিশ্রিত টুথপেষ্ট বেশী না খেয়ে ফেলে।
শিশুর দাঁত
শিশুর দুধ দাঁত কখনো কখনো ১১ বত্সর বয়স পর্যন্ত মুখে অবস্থান করে। সুতরাং লক্ষ্য রাখতে হবে শিশুর দুধ দাঁতগুলো ঠিকমত রক্ষিত আছে কিনা যাতে পরবর্তী স্থায়ী দাঁতগুলো সঠিকভাবে তাদের স্থানে আসতে পারে। কারণ দুধ দাঁতের শিকড়ে প্রদাহ অনেকদিন স্থায়ী থাকলে স্থায়ী দাঁতের ক্ষতি হতে পারে। যদি দুধ দাঁত অন্য পথ বেছে নেয় তবে দন্ত চিকিত্সকের পরামর্শ নেয়া ভালো, এই দুধ দাঁত পড়া ও স্থায়ী দাঁত উঠার সময়ে শিশুর দিকে নজর রাখা প্রয়োজন নতুবা পরবর্তীতে স্থায়ী দাঁত গুলো আঁকাবাঁকা বা অসমানভাবে বেড়ে উঠতে পারে।
গর্ভবতী মায়ের দায়িত্ব
একজন গর্ভবতী মা যেমন ভবিষত্ শিশুর ভূমিষ্ট হওয়ার পর নিয়মিত একজন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেন তেমনি ভালো, সুস্থ্য, সুন্দর দাঁত ও মাড়ির জন্য একজন দন্ত চিকিত্সকের পরামর্শও যদি মেনে চলেন তবেই হবে পূর্ণাঙ্গ সার্থকতা। এই সমস্ত কথা বিবেচনা করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯৪ সালের জন্য স্লোগান ছিল (ORAL HEALTH FOR HEALTHY LIFE) অর্থাত্ মুখ এবং দাঁতের যত্ন নিন সুস্থ থাকুন এবং আমরা যদি মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সত্যিকার অর্থে নিশ্চিত করতে চাই তবে বছরের একটি দিবসে নয় প্রতিদিনের কাজকর্মের সাথে দাঁত ও মুখের যত্নের অভ্যাসকে প্রতিদিন প্রতিবার আহারের সাথে সংম্পৃক্ত করতে হবে এবং মাকে যেমন নিজের যত্নের অনুশীলন করতে হবে তেমনি শিশুকেও সামনে রেখে শিক্ষা দিতে হবে যে শিক্ষা থাকবে তার আজীবন সাথী হয়ে।
অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী
সিনিয়র কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধান
ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টিষ্ট্রি, বারডেম হাসপাতাল ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ
অপরাজিতাবিডি ডটকম/ইত্তেফাক/আরএ/এ/২৬ জুলাই ২০১৪ই.