ডা. সাকলাইন রাসেল
মন খারাপ?
কি করেন আপনি মন খারাপ হলে?
-গান শোনেন?
-লেখালেখী করেন?
-বেড়াতে যান?
-সিনেমা দেখেন?
-ঘুরতে যান?
-আড্ডা দেন?
নাকি বিড়িতে টান দেন? নাকি এর চেয়েও বড় কিছু?
নাকি ঘুমের ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়েন..কমপক্ষে ৮ ঘন্টা.. একেবারে অর্ধমৃত ঘুম!
আমার পরিচিত কয়েকজন মানুষ আছে..মন খারাপ হলে তারা সাজুগুজু করেন..লম্বা সময় শাওয়ার নেন..আই মিন গোসল করেন..শপিং এ যান…এবং সত্যি সত্যি তাদের মন ভাল হয়ে যায়!
অবশ্য এই মানুষগুলোর সবাই নারী প্রজাতির!
আমার স্বভাব একটু ভিন্ন..অল্প স্বল্প মন খারাপে কিছুই হয়না..বেশি হলে মা কে খুঁজি!
সত্যি বলছি.. মা কে খুঁজি!
যেখানে যে অবস্থায় আছি..সেখান থেকে দৌড়ে যাই মা’র কাছে…পথে হাঁটতে গেলে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে মানুষ কি করে?উর্ধশ্বাসে দৌড় দেয়..আমিও তেমন হাসফাস করতে থাকি..কত দ্রুত মায়ের কাছে পৌছানো যায়!
আজও গেলাম..
মা ব্যস্ত মেহমানদারীতে.. ফাঁকে তার পাশে বসলাম..মা খাটে বসে..পা ঝুলছে ফ্লোরে..আমি ফ্লোরে বসে খাটে ঠেস দিয়ে!
একটু নীরবতা..কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলাম..বের হল না! বড় হওয়ার এই একটা সমস্যা..কথার পাহাড় জমে বুকে..অথচ গলায় এসে আটকা পড়ে..ঢাকার জ্যামের মত..যার শুরু আছে শেষ নেই!
ছোটবেলায় এমন ছিলাম না..মন খারাপ হলেই সোজা মায়ের গলা ধরে ভ্যা ভ্যা..এখন পারিনা..না পারাই নিয়ম..অথচ বড়রাও কাঁদে..ছোটদের সাথে এ কান্নার পার্থক্য আছে..এ কান্না শব্দহীন..অশ্রু অদৃশ্যমান!
তবে মা তো..প্রকাশ করা লাগেনা..ক্যামনে জানি বুঝে ফেলেন..সেই ছোটবেলার মত আজো!
-কী রে..মুখ শুকনা ক্যান? দুপুরে কি খেয়েছিস?
তিনি আসলে মনের খবর নিতে সাহস পাচ্ছিলেন না..বড়দের মনের খবর নিতে নাই..ইগোতে লাগে!
মনে হচ্ছিল..গলাটা ধরে সেই ছোট বেলার কেঁদে উঠি..আম্মু, কিছু ভাল লাগছেনা!
প্রতিবারের মত আজও পারলাম না..মনের সব কষ্ট বড় শরীরের প্রাচীরে আটকা পড়ে গেল..সাগরের উত্তাল ঢেউ যেমন পাহাড়ের বুকে আঁচড়ে পড়ে..তেমনি!
আমার একটা হাত ঘাড়ে ছিল..মা সেদিকে তাকিয়ে বলল, কি রে, ঘাড় ব্যথা?
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম!
মা ঘাড় ম্যাসাজ করে দিচ্ছেন..
কীরে, তোর গা এত্তো গরম ক্যান?..চুলগুলো কি বড় হইছে?.মাথায় তেল দিস না?
স্বভাব সূলভ এসব প্রশ্ন মা করেই যাচ্ছেন..আশ্চর্য বিষয় হল, তিনি কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সুযোগ দিচ্ছেন না..কখনো দেনও না..হতে পারে এটা তার ভালোবাসা প্রকাশের অন্য এক মাধ্যম..যা কেবল বয়োবৃদ্ধ সন্তানের জন্য প্রযোজ্য!
মায়ের হাতের ছোঁয়ায় কষ্টগুলো যেন অশ্রু হয়ে গলে যাচ্ছিল..তবে চোখের কোণে পৌঁছাতে পারছিল না!..বুকের মাঝে বড় একটা বুদবুদ তৈরী করে হারিয়ে যাচ্ছিল!
মা উঠে দাঁড়াল..না, আগের মত স্বান্তনা দিল না..তবে মন ভাল করার দ্বিতীয় থেরাপি প্রয়োগ করল!
-চা খাবি?
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম!
চা টা অনেকক্ষণ ধরে খেলাম..হঠাৎ মা এসে বলল, কিরে এখনো শেষ হয়নি?
কারণ, চা যতই গরম হোক..আমি তা দ্রুতই শেষ করে ফেলি!
তাড়াতাড়ি করে চা শেষ করায় মনোযোগী হলাম..মা কাপে হাত দিয়ে অবাক হলেন,
কি রে..চা তো একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে!
কিছু বলার আগেই মা চায়ের কাপ নিয়ে সোজা রান্নাঘরে গেলেন!
মা কে আর বলাই হল না..ঐ চা ঠান্ডা হওয়ার পিছনে বাতাসের কোন ভূমিকা নাই..চোখের অনেক শীতল অশ্রু চায়ের কাপে এসে উষ্ণ হয়ে গেছে!
বোকা মা..
সব বুঝে.. কিন্তু বোঝে না..আমি এখন শুধুই তার সন্তান না..এই মানুষটাও কারো পিতা..অশ্রু লুকিয়ে তাকেও নিজ সন্তানকে আগলে রাখতে হয়..অনন্ত যাত্রার আগে ক্লান্তিহীন ভালোবাসা দিয়ে!