মো. ইকরাম
হোম কোয়ারেন্টিন অবস্থাতে কঠিন মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সবাই। এ চাপ বেড়ে যায় তখনই, যখন সব কাজ বন্ধ করে আগত বিপদের অপেক্ষা করতে থাকেন। যত কাজ মুক্ত থাকবেন, ততই মানসিক চাপ বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে শরীর বিপদের সঙ্গে যুদ্ধ করার শক্তি হারিয়ে ফেলবে।
এই সময়টাতে সবার জন্য দৈনন্দিন কাজের একটা গাইডলাইন এ লেখাতে দেওয়ার চেষ্টা করবো। আশা করি লেখাটি পড়া শেষ করলে আপনার এ মুহূর্তের একটি বড় সমস্যার সমাধান পেয়ে যাবেন। সমস্যাটি হচ্ছে, অনেকেই বলেন, সময় কাটে শুধু ঘুমে। ঘুম থেকে উঠে একবার ভাবি, কী কাজ করবো এখন? এটা ভেবে বের করার আগেই আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
এ লেখাটি পড়ার পর ভাবনা শেষ হয়ে যাবে। পুরো ২৪ ঘণ্টার একটা রুটিনও পেয়ে যাবেন পুরো লেখাটি পড়া শেষ করলে। এ দুর্যোগে আমাদের মূলত ৩টি চ্যালেঞ্জ। সেই ৩টা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাতে ৩টি কাজ রুটিনে থাকতে হবে।
চ্যালেঞ্জ-১: বিপদ থেকে মুক্তি পেতে সৃষ্টিকর্তার করুণা পাওয়া।
চ্যালেঞ্জ জয়ে কর্তব্য: নিজ ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করার চেষ্টা করা। (সকল ধর্মের লোকেরা তাদের নিয়মেই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করবেন)।
চ্যালেঞ্জ-২: করোনা আক্রান্ত না হওয়া।
চ্যালেঞ্জ জয়ে কর্তব্য: স্বাস্থ্য বিষয়ক গাইডলাইনগুলো অনুসরণ করা।
চ্যালেঞ্জ-৩ : সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দাতে নিজেকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল রাখা।
চ্যালেঞ্জ জয়ে কর্তব্য: দক্ষতা অর্জনে বিশেষ সময় দেওয়া।
এটুকু পড়েই উঠে গেলে অনেক কিছু মিস করবেন। কারণ এখন এই ৩টি মূল কাজগুলো কিভাবে করবেন, সেটির পরিপূর্ণ গাইডলাইন দিবো।
চ্যালেঞ্জ-১: বিপদ থেকে মুক্তি পেতে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা
(এখানে মুসলিমদের জন্য গাইডলাইন দেওয়া হলো, অন্য ধর্মের লোকেরা নিজেদের মত করে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করুন।) বিশ্বের সকল উন্নত রাষ্ট্র করোনাকে ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে। কোনভাবেই তারা মৃত্যুর সংখ্যা ঠেকাতে পারছে না। এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে আল্লাহর করুণা ছাড়া কোন উপায় নাই। তাই নিজের, পরিবারের, সমাজের ও দেশের মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে। আল্লাহর সাহায্য পেতে তার সন্তুষ্টি অর্জনে তার নির্দেশগুলো পালন করতে হবে।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে আমাদের কর্তব্যগুলোকে ৩টি ভাগে ভাগ করি-
১) আল্লাহর ইবাদত করা:
৫ ওয়াক্ত নামাজ, তাহাজ্জুদসহ অন্যান্য নফল ইবাদত, রোজা রাখা, কোরআন তেলাওয়াত করা।
২) দান করা:
দান মানুষের বিপদকে কমিয়ে দেয়। বর্তমান পরিস্থিতি দান করার সর্বোত্তম সময়। বাইরে লাইন ধরে দান করার পাশাপাশি, সবচেয়ে প্রথম দান পাওয়ার অধিকার নিজের গরীব আত্মীয়-স্বজন, গরীব প্রতিবেশী, বাসার কর্মচারী (বুয়া, দারোয়ান ইত্যাদি)। সেইসঙ্গে এই সময়ে বাজারে গেলে দাম কমানোর চেষ্টা না করে লস মনে হলেও সেই টাকা দিয়ে আসুন, রিকশাতে কিংবা কোন যানবাহনে চড়ে কোথাও যাওয়ার সময় দামাদামি না করে, উল্টো কিছু বাড়তি টাকা তাদের ধরিয়ে দিন। এটাতেও দান করার সওয়াব পাবেন।
৩) ইসলামিক জ্ঞান অর্জন:
ইসলামিক সঠিক জ্ঞান অর্জনের জন্য কোরআনে তাফসির পড়ার পাশাপাশি ইসলামিক সাহিত্য পড়ুন। এটাও আল্লাহর পছন্দনীয় অন্যতম কাজ। কুরআন হাদিসের বাইরেও ইসলামিক যেসব বই রয়েছে, সেগুলো বেশি বেশি পড়ে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা যাবে, সময়টা ভালই কাটবে। এগুলো অনলাইনে সার্চ দিলেও প্রচুর বইয়ের পিডিএফ হয়তো খুঁজে পেতে পারেন।
চ্যালেঞ্জ-২: করোনা আক্রান্ত না হওয়া
করোনাভাইরাস নিজের শরীরে কিংবা ঘরে কারও শরীরে কিংবা এক বিল্ডিং এমনকি এক এলাকাতে একবার ঢুকে পড়লে সেই ভাইরাস সবার জন্য বিপদ ডেকে আনার সম্ভাবনা থাকে। তাই করোনাভাইরাসকে এলাকার কাছে ধারেও আসতে না দেওয়ার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিতে বলছে সারা বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা। তাই আপনার ২৪ ঘণ্টার রুটিনের কাজের লিস্টে অন্যতম প্রধান কাজ করোনা প্রতিরোধের জন্য নিম্নে বর্ণিত কিছু রুটিন কর্মকাণ্ড।
নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখা:
মুখ, নাক এবং চোখ দিয়ে ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে। বাতাসের মাধ্যমে নয়। এই মুখ, নাক এবং চোখে হাতের সংস্পর্শের মাধ্যমে ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে। তাই হাত ১ ঘণ্টা পরপর সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে পরিষ্কার করতে হবে। বাইরে থেকে ঘরে এলে কোথাও না বসে কাপড়চোপড় ধুয়ে ফেলব বা একটা ঢাকনাওয়ালা বালতিতে ঢেকে রাখব এবং সময় মতো ধুয়ে নেব। কোনো কাপড় ধোয়া সম্ভব না হলে উজ্জ্বল রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে নেব। সম্ভব হলে ঘরে এসে হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করে নেব অথবা হাত-মুখ পরিষ্কার করব।
শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো:
সুযোগ মতো লবণযুক্ত গরম পানি দিয়ে গলা পরিষ্কার (গড়গড়) করব। ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ খাবার খাব। সবুজ শাকসবজি, সুষম খাবার, মাছ, মাংস, ডিম ভালো করে সিদ্ধ করে খাব (ডিমের পোঁচ খাওয়া যাবে না) যাতে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনোভাবেই ঠাণ্ডা কোনো খাবার খাওয়া যাবে না। কিছু সময় পরপর গরম কফি, চা, গরম পানি বা স্যুপ খেলে ভালো হয়। এগুলোর পাশাপাশি নিয়মিত শরীর চর্চা চালাতে হবে।
চ্যালেঞ্জ-৩: সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দাতে নিজেকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল রাখা
মহামারী করোনাভাইরাস নাড়া দিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিকে। গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে স্থবিরতা নেমে এসেছে, তাতে ৩৩০ কোটি কর্মক্ষম মানুষের আংশিক বা পুরোপুরি বেকার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। এই পরিস্থিতির কথা ভুলে গেলে হবে না।
সেই পরিস্থিতি সামলাতে প্রস্তুতি নিতে এখনকার এই ফ্রি সময়টাকেই কাজে লাগাতে হবে। না হলে করোনা থেকে বাঁচলেও চাকরি হারিয়ে আরেক বড় ধরনের বিপদের মুখোমুখি হতে হবে। সেই বিপদকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি হিসেবে এই অবসর সময়টাতে নিজের দক্ষতাকে অনেক গুন বাড়িয়ে নিতে হবে।
প্রশ্ন হতে পারে, আমার যোগ্যতা বা দক্ষতা না থাকলে কি আমার চাকরি হয়েছে? হুম, কথা সত্য। যোগ্যতার কারণেই আপনার চাকরি করতে পারছেন। কিন্তু কিছুদিন আগে প্রকাশিত বিবিসির একটা সংবাদের শিরোনাম শেয়ার করে আপনাকে সতর্ক করছি।
‘ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের পাইলট চাকরি হারিয়ে ডেলিভারি ভ্যানের ড্রাইভার হিসেবে চাকরি নিয়েছেন’। আপনার বর্তমান চাকরিটি কোন কারণে চলে গেলে অন্য কোন যোগ্যতা দিয়ে হলেও অন্য ক্যাটাগরিতে হলেও একটি চাকরি যোগাড় করার মত দক্ষতা এখনই অর্জন করে নিতে হবে। আবার এমন হতে পারে আপনার অনেকগুলো যোগ্যতা থাকার কারণে হয়তো প্রতিষ্ঠানের ৮০% এর চাকরি চলে গেলেও আপনার চাকরি যাতে অন্তত টিকে যায়।
আর যদি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, তাহলেও যাতে অন্য কোন চাকরি যোগাড় করতে আপনার হাতে যাতে অনেকগুলো অপশন থাকে। কীভাবে কাজে লাগাবেন, তার একটি সংক্ষিপ্ত গাইডলাইন দিচ্ছি এবার।
৬টি বিশেষ গাইডলাইন
১. স্কিল বাড়ানোর চেষ্টা করেন। মাল্টি স্কিল হওয়ার চেষ্টা করেন। আপনাকে দিয়ে ২-৩ ধরনের কাজ করানো গেলে আপনাকে কোম্পানি বাদ দেওয়ার চিন্তা কম করবে। কিংবা চাকরি চলে গেলেও আপনার অনেকগুলো স্কিলের কোন একটা নতুন চাকরি পেতে সহায়ক হবে।
২. কমিউনিকেশন দক্ষতা বর্তমান যুগে খুব বড় একটা যোগ্যতা। যে কোন চাকরিতে ভাল অবস্থানে যেতে ভাল পারফরমেন্স করতে হয়। আর ভাল পারফরমেন্সের জন্য প্রয়োজন কমিউনিকেশন দক্ষতা। কমিউনিকেশন দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন বই কিংবা গুগল সার্চ করে কিংবা ইউটিউব থেকে শিখতে পারেন।
৩. প্রযুক্তি বিষয়ক দক্ষতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে গুরুত্ব দিন। কারণ পরবর্তী বিশ্বে সকল কিছুই প্রযুক্তি নির্ভর চলার সম্ভাবনাই বেশি দেখছে সবাই। এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট অবশ্যই জানা থাকতে হবে। গ্রাফিক ডিজাইন, ভিডিও এডিটিংটাও শিখে রাখতে পারেন। এ দক্ষতাগুলো থাকলে আপনার প্রতিষ্ঠানে ভাল একটা ভ্যালু থাকবে। আবার চাইলে অনলাইনেও বহির্বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠানেরও কাজ করার সুযোগ পাবেন। এগুলো শিখার জন্য ইউটিউবে বাংলাতেই ভালো ভালো অনেক রিসোর্স খুঁজে পাবেন।
৪. উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করুন। নিজে উদ্যোক্তা হতে পারবেন। উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা না থাকলে আপনি যেখানে চাকরি করেন, সেই বিজনেসেও নিজের উদ্যোক্তা বিষয়ক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সেই বিজনেসের সাফল্য নিয়ে আসতে পারবেন।
৫. যেকোন বিজনেসে ইনকাম বাড়াতে প্রয়োজন মার্কেটিং এবং ব্রান্ডিং। ভাবুনতো একবার, আপনার মাধ্যমেই যদি কোন প্রতিষ্ঠান অনেক ক্লায়েন্ট পায় এবং ব্যবসাতে ইনকাম বৃদ্ধি পায়, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানে আপনার ভ্যালু কী পরিমাণ বাড়বে? তাই বিজনেস বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে ডিজিটাল মার্কেটিং বা ব্রান্ডিং সম্পর্কে এ ছুটিতে শিখে নিতে পারেন।
৬. ইংরেজিতে যাদের জ্ঞান কম আছে, তারা এই ফ্রি সময়টাতে ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়িয়ে নিতে পারেন। ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়াতে কয়েক বন্ধু মিলে চ্যাটিং গ্রুপ করে নিতে পারেন। সেই গ্রুপে ইংরেজিতে আড্ডা দিন। সময় কাটবে আড্ডা দিয়ে। সঙ্গে ইংরেজি ভয় দূর হবে, ইংরেজি জ্ঞানও বাড়বে।
আর কিছু লিখে বড় করবো না। সময় কাটানোর একটা গাইডলাইন তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কতটুকু কাজে লাগাবেন, সেটি আপনার বিষয়। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এ রুটিন অনুযায়ী প্রতিদিন সময় কাটালে সময়টা ভাল কাটবে, সেইসঙ্গে নিজের জন্য ভাল কিছু অর্জন করতে পারবেন। লেখাটি দৈনিক যুগান্তরের অনলাইন সংস্করণ থেকে সংগ্রহীত