banner

শুক্রবার, ০৬ Jun ২০২৫ ইং, ,

পোস্টটি 54 বার পঠিত

 

কুরবানির ইতিহাস ও গুরুত্ব

ইসলামে কুরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব ইবাদত, যার মাধ্যমে একজন মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজের প্রিয় বস্তু ত্যাগ করে। এটি কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয় বরং আত্মত্যাগ, আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের প্রকাশ। কুরবানি ঈদুল আজহার মূল ভিত্তি, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য ত্যাগের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার বার্তা নিয়ে আসে।

কুরবানির ইতিহাস
কোরবানির ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন ও তাৎপর্যপূর্ণ। পবিত্র কোরআনের সূরা মায়েদায় হজরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানির কাহিনি বর্ণিত হয়েছে:
“তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের কাহিনী যথাযথভাবে শুনাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানি করেছিল। তাদের একজনের কুরবানি কবুল হল এবং অন্যজনেরটা কবুল হল না। সে বলল- অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব।
অপরজন বলল -আল্লাহ শুধু মুত্তাকীদের কাছ থেকেই কবুল করেন।” (সূরা মায়েদা: ২৭)

পরবর্তী সময়ে কুরবানির চূড়ান্ত রূপ ও তাৎপর্য প্রকাশ পায় হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনে। আল্লাহ তাকে আদেশ করেন স্বপ্নে পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কুরবানি করতে।
“অতঃপর যখন সে (ইসমাইল) পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন সে বলল, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি। এখন তুমি চিন্তা করো, তোমার মত কী? সে বলল, হে পিতা! আপনি যা আদেশ পাচ্ছেন তাই করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের একজন পাবেন।” (সূরা ছাফফাত: ১০২)
“আর আমি তার পরিবর্তে একটি মহান কোরবানি দান করলাম।” (সূরা ছাফফাত: ১০৭)

কুরবানির শরয়ী গুরুত্ব
ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে কুরবানি একটি ওয়াজিব ইবাদত। ঈদুল আজহার দিনগুলোতে সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য এটি আদায় করা অপরিহার্য। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।” (মুসনাদে আহমাদ)

কোরআনে আল্লাহ বলেন,
“তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করো এবং কুরবানি করো।” (সূরা কাউসার: ২)
এই নির্দেশ থেকে বোঝা যায়, কুরবানি নিছক একটি সামাজিক উৎসব নয় বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত হিসেবে এটি আজও বহাল আছে। হাদিসে এসেছে, “এটি তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত।” (ইবনে মাজাহ)

কুরবানির ফজিলত
রাসুল (সা.) বলেন:
“আল্লাহর কাছে কুরবানির দিন মানবজাতির কোনো আমলই কুরবানির চেয়ে বেশি প্রিয় নয়। পশুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। তাই তোমরা খুশিমনে কুরবানি করো।” (তিরমিজি)

যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বর্ণনা করেন, সাহাবারা জিজ্ঞেস করেন, “হে আল্লাহর রাসুল! কুরবানি কী?” তিনি বলেন, “এটি তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত।” সাহাবারা আবার জিজ্ঞেস করেন, “এতে আমাদের কী পুরস্কার আছে?” তিনি বলেন, “প্রতিটি পশমের জন্য একটি করে নেকি।” (মিশকাত)

তাকওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক:
আল্লাহ বলেন,
“তাদের গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ: ৩৭)
আরও বলেন,
“বল, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু—সবকিছুই বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহর জন্য।” (সূরা আন’আম: ১৬২)

এই ইবাদতের মাধ্যমে একজন মুমিন তার আত্মাকে খাঁটি করে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের ভালোবাসার বস্তু ত্যাগ করে এবং জীবনের প্রতি মোহ কমিয়ে তাকওয়ার পথে অগ্রসর হয়। এটি কেবল পশু জবাই নয়, বরং আত্মিক পশুত্ব জবাইয়ের এক প্রকৃত ইবাদত।

কুরবানির সামাজিক প্রভাব
কোরবানির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর সামাজিক প্রভাব। কোরবানির গোশত তিন ভাগে ভাগ করে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও গরিবদের মধ্যে বণ্টন করার মাধ্যমে সমাজে সহানুভূতি, সাম্য ও ঐক্যের চর্চা হয়। ধনী ও গরিবের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত হয় এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
বর্তমানে কিছু মানুষ কুরবানিকে কেবল সামাজিক রেওয়াজ, স্ট্যাটাস দেখানো বা পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে দেখে। কিন্তু ইসলাম কুরবানিকে ত্যাগ, সহানুভূতি ও তাকওয়ার উৎসব হিসেবে নির্ধারণ করেছে। এর মাধ্যমে গরিবের মুখে হাসি ফোটে, ধনী-গরিবের মাঝে বন্ধন সৃষ্টি হয় এবং মুসলিম সমাজে সাম্যবোধ জাগ্রত হয়।

কুরবানির শর্ত ও মাসআলা
১. কুরবানি শুধুমাত্র ঈদের নামাজের পর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত করতে হবে।
২. যে ব্যক্তির কাছে কুরবানির তিনদিনে (১০-১২ জিলহজ) যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব।
৩. পশু হতে হবে নির্ধারিত বয়সের: গরু ও মহিষ দুই বছর, ছাগল ও ভেড়া এক বছর।
৪. কুরবানির পশু যেন দৃষ্টিগোচর ত্রুটিমুক্ত ও সুস্থ হয়।
৫. কুরবানি নিজ হাতে করা উত্তম, না পারলে উপস্থিত থেকে অন্যের মাধ্যমে করানো।
৬. কুরবানির গোশত গরিব, আত্মীয় ও নিজের মধ্যে বণ্টন করা সুন্নত।
৭. যে ব্যক্তি কুরবানির নিয়ত করবে সে যেন কুরবানির আগ মুহুর্ত পর্যন্ত নখ,চুল বা শরীরের পশম না কাটে

কুরবানি একটি বহুমাত্রিক ইবাদত, যার ভেতর আছে ইতিহাস, শিক্ষা, আত্মিক শুদ্ধি ও সামাজিক কল্যাণ। এটি পালন করতে হবে বিশুদ্ধ নিয়তে, শরিয়তের নির্দেশনা মেনে। বাহ্যিক আড়ম্বর নয়, বরং অন্তরের খাঁটি ইমান ও তাকওয়ার সঙ্গে কুরবানি করলে তবেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে।

আসুন, আমরা সবাই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যথাযথভাবে কুরবানি আদায় করি, তাকওয়ায় পরিপূর্ণ জীবন গঠন করি, এবং আমাদের পরিবার, সমাজ ও উম্মাহকে কুরবানির মাধ্যমে ঐক্য ও সহানুভূতির পথে পরিচালিত করি।

আরওয়াহ আনাম

Facebook Comments