কপালে লাল টিপ আর পরনের লাল শাড়ি ঠিকই ছিল। কিন্তু খুলে নেওয়া হয়েছে কানের দুল ও নাকফুল। বিয়ের পরদিন স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে বাবার বাড়িতে। অথচ তাঁরও দুচোখ ভরা স্বপ্ন ছিল। ছিল অনেক আশা। স্বামীর সংসারে সোনালি দিনের স্বপ্নের জাল বুনতে চেয়েছিলেন। গায়ের রং কালো বলে স্বামীর সংসার আর হলো না।
এত বঞ্চনার পরও থেমে থাকেননি গোলাপী। নিজের পায়ে দাঁড়াতে স্বাবলম্বী হতেই হবে? স্বামীর সংসার হয়নি তাতে কী হয়েছে? মা-বাবা, ভাইবোনকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। ছুটে চললেন কাজের সন্ধানে। সেলাই প্রশিক্ষণ নিলেন। একটি মেশিনও কিনলেন। বাড়িতেই শুরু করলেন মেয়েদের জামা বানানোর কাজ। বদলে যেতে শুরু হলো তাঁর জীবনচিত্র। এর পাশাপাশি রংপুরে অবস্থিত একটি পোশাক কারখানায় চাকরিও করছেন।
কালো হওয়ার ‘অপরাধে’ বিয়ের রাতেই স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পর দমে যাননি। নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করে অর্থ উপার্জন করছেন। পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করছেন এমন উদাহরণের ঘটনায় ২০১৫ সালের ‘নারী’ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কার পেয়ে গেলেন গোলাপী আক্তার।
রংপুর শহরের দক্ষিণ কামারপাড়ায় ভ্যানচালক আবদুল গনির বড় মেয়ে গোলাপী আক্তার। অভাব-অনটনের সংসারে বেশি দূর পড়াশোনা এগোয়নি। মাত্র পঞ্চম শ্রেণিতেই পড়ালেখার পাট চুকে যায় তাঁর। এরপর ২০০৯ সালে রংপুর শহরের আদর্শপাড়া এলাকার আলী হোসেন নামের এক ভ্যানচালক তরুণের সঙ্গে ১৪ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। এ সময় যৌতুক হিসেবে দেওয়া হয়েছিল ২০ হাজার টাকা। আর দেওয়া হয়েছিল নাকফুল ও কানের দুল। গোলাপী কি জানতেন, এক দিন পরই তাঁকে স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে আসতে হবে?
একে তো বাল্যবিবাহ, তার ওপর যৌতুক, এই বিয়ের পরিণাম যা হওয়ার তা-ই হলো। সেই দিনের ঘটনা বলতে গিয়ে গোলাপী জানালেন, বিয়ের রাতেই (বাসর রাত) এলাকায় চোরের উপদ্রব রয়েছে, এমন অজুহাতে শাশুড়িসহ বাড়ির অন্যরা তাঁর শরীর থেকে খুলে নেন নাকফুল ও কানের দুল। শরীরের রং কালো হওয়ার গঞ্জনা শুনতে হয়েছে রাতভর। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে রাতটা কাটলেও পরদিন সকালে ফিরে যেতে হয় বাবার সেই চিরচেনা বাড়িতেই। আর ফিরে যাওয়া হয় না স্বামীর সংসারে।
এরপর গোলাপী এখানে-ওখানে ঘুরে ফিরেছেন। কী করবেন তা ভেবে উঠতে পারছিলেন না। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আরডিআরএসের মানবাধিকার কর্মী বিলকিস বেগমের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁর মাধ্যমে ওই প্রতিষ্ঠানে আলোকিত ভুবনে এক বছরের সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিলেন গোলাপী। এরপর নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করলেন। এরই মধ্যে বিয়ের সম্পর্কটা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।
২০১০ সালে যোগ দেন রংপুর শহরে অবস্থিত একটি পোশাক কারখানায়। প্রতি মাসের বেতন আর নিজের সেলাই মেশিন দিয়ে আয়ও হয় বেশ। ব্যাংকেও টাকা জমিয়েছেন। মা-বাবা, দুই ভাই, এক বোনসহ শহরের কামারপাড়ায় ভাড়া বাসায় থেকে জীবন ভালোই কাটছে তাঁদের। এক ভাই অষ্টম ও বোন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। আরেক ভাই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বাবার ভ্যান চালান। মা বর্তমানে অসুস্থ। তেমন একটা চলাফেরা করতে পারেন না।
গোলাপী বলেন, ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা নারী অন্বেষণে ২০১৫ সালে রংপুর সদর উপজেলা, জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত হই। পরিবারের বড় মেয়ে হওয়ায় ইচ্ছে আছে অন্য সব ভাইবোনকে পড়ালেখা শিখিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার। আমার মতো অন্যদের জীবন যেন এ রকম না হয়।’ নিজেকেও প্রতিষ্ঠার অনেক দূরে নিয়ে যেতে চান। তাই মনেপ্রাণে চালিয়ে যাচ্ছেন জীবনযুদ্ধের লড়াই।
অসুস্থ মা সামেনা বেগম বলেন, ‘কত কষ্ট করি টাকাপয়সা জোগাড় করি মেয়েটাক বিয়া দিছি। তখন মোর জানা আছিল না ছোটকালে বেটির বিয়া দেওয়া যায় না। সেই সংসার দুই দিনও টিকিল না। কালো বলিয়া এমন দুর্দশা হইল। কিন্তু তারপরও মেয়েটা কাজকাম করিয়া সংসারের বোঝা বহন করিয়া যাইতাছে। বেটি হামার হারে নাই।’