ফারহানা বিনতে আমিন
বুক রিভিউ
উপন্যাসঃ কাবিলের বোন
কবি ও কথাসাহিত্যিকঃ আল মাহমুদ
প্রিয় কবি -কথাসাহিত্যিক আল মাহমুদের উপন্যাস পর্যালোচনা করার দুঃসাহস করছি না,পাঠক হৃদয়ের অভিব্যক্তি তুলে ধরতেই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।উপমহাদেশ, অর্ধেক মানবী,ডাহুকী,নিশিন্দা নারী,আগুনের মেয়েসহ অসাধারণ উপন্যাস লিখে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছেন কবি আল মাহমুদ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হয়েছে তার অনন্য উপন্যাস উপমহাদেশ ও কাবিলের বোন।কবির পরিচয় তো সর্বজনবিদিত, ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৬৩ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ “লোক-লোকান্তর” প্রকাশিত হয়, আজ অবধি বাংলা ভাষা সাহিত্যে নিরন্তর সাধনা অব্যাহত রয়েছে।সর্বশেষ ২০১৮ সালের বইমেলায় ” জীবন যখন বাঁক ঘোরে” উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।গত মাসে কবির তিরাশিতম জন্মবার্ষিকী ছিলো,দীর্ঘ এ জীবনে প্রিয় মানুষ সুস্হতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি,বাংলা সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করে বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষাকে সুউচ্চস্হানে নিয়ে যান।
কাবিলের বোন উপন্যাসটি কবির সবচে’ দীর্ঘ কলেবরের উপন্যাস,পাঁচটি পর্বে বিন্যস্ত।এ উপন্যাসটিকে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস বলা যায়,রাজনৈতিক উপন্যাস ও বলা যেতে পারে,যেখানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্হান,নাগরিক পরিচয়ের সংকট, গণঅভ্যুথান,মুক্তিযুদ্ধ, শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা,ছাত্র সমাজের নেতৃত্বের ভূমিকার বিমূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। পাঠক এ লেখাটি পড়ে আবিষ্ট হবেন,নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় আবিষ্কার করবেন, ১০ নং বনগ্রাম লেনের সেই আবাসটি স্বচোখে হৃদয়ে আঁকতে বাধ্য হবেন।কবি নিজেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন,কবির আত্মজৈবনিক লেখা-“বিচূর্ণ আয়নায় কবির মূখ” ও “যেভাবে বেড়ে উঠি” বইয়ের অনেক কথার প্রতিচ্ছবি তার উপন্যাসে খুঁজে পাওয়া যায়।কবির লেখায় নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা আয়নার মতোই প্রতিফলিত হয়েছে।কবি আল মাহমুদের এ লেখা আমরা বাংলাদেশের রূপই নতুন করে খুঁজে পাই।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সৈয়দ আহমদ কাবিল ও রোকসানা,কাবিলের চাচী রওনক জাহান,আন্দালিব -মোমেনা,রাজনৈতিক অঙ্গনে দাপুটে আঞ্জুমান-মেধাবী নিশার সকলকে ঘিরেই আখ্যানটির আবর্তন। পাঁচটি পর্বে আলোচনা করবো।
উনিশ শো ষাট সালের জানুয়ারীর এক শীতের সকালে সৈয়দ আহমদ কাবিল ফুলবাড়িয়া স্টেশনে নামল,যার হাতে ঘড়ি ও পায়ে নতুন পাম্প স্যু,যে একটা আশ্রয় খুঁজছিলো-এ দৃশ্য কল্পের সাথে কবির গ্রাম থেকে নতুন শহরে আসার সময়টা চোখে ভাসে।মা জাকিয়া বেগম সর্বস্ব দিয়ে ছেলেকে মেট্রিক পর্যন্ত পড়িয়েছেন,এবার ভাল কলেজে পড়তে ছোট দেবরের কাছে একটা চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছেন।এমনি এক সকালে কাবিল গিয়ে চাচা-চাচী আহমদ আলম- রওনক জাহান ও তাদের একমাত্র রোকসানাদের পরিবারে উপস্হিত হয়।
কাবিলের চাচা পরিবারের অসম্মতিতে এক মুজাহির মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন, এই নিয়ে ভুলবোঝাবুঝিতে দীর্ঘদিন পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।কাবিলের আসার মধ্য দিয়ে নতুন করে, আত্মীয়তার বাঁধন নতুন মোড় নেয়।চাচার ব্যবসা দেখাশোনার কাজে সাহায্য করে, আন্দালিব সেও মুহাজির,রোকসানার ফুফাত ভাই।স্বামী আহমদ কামালের মৃত্যুর পর জাকিয়া বানু পুরনো প্রতিজ্ঞা ভুলে, বাড়ির ছোট বউ হিসেবে রওনক জাহানের উপস্থিতি কামনা করেন।কাবিল ও রোকসানা তাদের পূর্বপুরুষের ভূমি আবাদে আবার মনতলা গ্রামে ছুটে যায়।
জাকিয়া বেগম রোকী আর কাবিলের পরস্পরের প্রতি দূর্বলতা আঁচ করেও নিশ্চুপ থাকেন।এমনি সম্পর্কের দোলাচালে এগোতে থাকে সামনের দিনগুলো।এর মধ্যে উপন্যাসের পটপরিবর্তনে বাঙালী, বিহারী -পাঞ্জাবীদের জাতিগত সংকট প্রকট হয়ে ওঠে।
মেধাবী শিক্ষার্থী কাবিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়,ছাত্র রাজনীত-বাঙালী জাতির জীবনের আশা-আকাক্ষা বুকে ধারন করে,পথ চলে।ডাকসুর লিডার সে,শেখ মুজিবের নেতৃত্বে মুখর রাজপথ।ছাত্ররা ছয়দফা নিয়ে ক্যাম্পাসে উত্তাল।এমনি উত্তাল পরিবেশে কাবিলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়।ছাত্রসংগঠনগুলোর মাঝে অনৈক্য,বামপন্থীদের আওয়ামী লীগের আন্দোলনে সর্বতোভাবে ঐক্যমত্যে আসতে চায় না।এমনি প্রেক্ষাপটে রওনক জাহান মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন,কাবিল যে বড় দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে তাতে,একটা ছোট্ট পরিবারের হাল ধরবার অবসর কই তার?ব্যবসায়ী রওনক জাহান শখ করে হীরার রিং কিনেছিলেন মেয়ের এনজেগমেন্টের জন্য,কিন্তু কাবিলের কই অবসর!এদিকে জাকিয়া বানু অসুস্হ হয়ে হঠাত মারা যান,তার দেখাশোনা করতো মোমেনা,যার সাথে শৈশব কাবিলের বিয়ে দেওয়ার কথা দিয়েছিলেন জাকিয়া বানু।মায়ের মৃত্যু দেহ দাফনে আসতে পুলিশী নজর এড়িয়ে কাবিল গ্রামে আসে।মায়ের মৃত্যুর পর আশ্রিত বোনের দায়িত্বভার তার কাঁধে চলে আসে।আন্দালিব মোমেনার নারীসুলভ সৌন্দর্য মুগ্ধ,হৃদয়ে টান অনুভব করে।রওনক জাহান এবার দু’জোড়া কন্যা পুত্রকে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান।কিন্তু,কাবিলের রাজনীতি -নেতৃত্বের ব্যস্ততায়, রোকসানা দ্বিধা-দ্বন্ধে বিয়েতে অমত করে বসে।আবার, দু’জনের চাওয়া -পাওয়ার বাধও দীর্ঘ ধৈর্য্যের বাধনে চ্যুত হতে চায়,কাছে পেয়েও দূরে, আলিঙ্গনে বেধেও না বাধার ছল।পাঠক আরো তীব্র ভাবে দুজনার পরিনয় ঘটবার অপেক্ষায়,আসলেই কি কাবিল-রোকী’র পরিনয় সম্ভব হয়েছিল কি,এখানেই উপন্যাসের এক বিষাদময় পরিনতি, যা উপন্যাসের শেষ পর্বে আসার আগে পাঠক আঁচ করতে পারবে কি?
হঠাত কাবিলের চাচা মারা যান,দাফন শেষ ফেরার পথে কাবিল গ্রেফতার হয়।
দেয়াল জুড়ে ছাত্রনেতা কাবিলের মুক্তির জন্য পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে যায়,আন্দোলনে মুখর হয় রাজপথ।পিতার মৃত্যু রোকসানাকে আরো বদলে দিয়েছে ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে ব্যবসার হাল ধরেছে,একদম পেশাদার বলা চলে।নিজের সামনে একটা আড়ালও তৈরি করে নিয়েছে সে।ছাত্রনেতা কাবিলের মাঝে প্রনয়িনী রোকীর পাচিল,রাজনীতি -দেশ, সমাজের জন্য ব্যক্তিস্বার্থত্যাগী কাবিল, চাচার পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে পারেনি।সেখানে রোকী তার মায়ের মতোই যোগ্যতা-দক্ষতা দিয়ে পারিবারিক ব্যবসা-বানিজ্য সামলে নিয়েছিলো,আন্দালিব যে কিনা নিঃস্বার্থভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলো।আন্দালিব কি একসময়ের ফুফা-ফুফির ওয়াদার কথা,রোকীকে পাওয়ার বাসনা কিংবা দূর্বলতা এখনো পোষণ করে।
হঠাত কাবিলের চাচা মারা যান,দাফন শেষ ফেরার পথে কাবিল গ্রেফতার হয়।
দেয়াল জুড়ে ছাত্রনেতা কাবিলের মুক্তির জন্য পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে যায়,আন্দোলনে মুখর হয় রাজপথ।পিতার মৃত্যু রোকসানাকে আরো বদলে দিয়েছে ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে ব্যবসার হাল ধরেছে,একদম পেশাদার বলা চলে।নিজের সামনে একটা আড়ালও তৈরি করে নিয়েছে সে।ছাত্রনেতা কাবিলের মাঝে প্রনয়িনী রোকীর পাচিল,রাজনীতি -দেশ, সমাজের জন্য ব্যক্তিস্বার্থত্যাগী কাবিল, চাচার পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে পারেনি।সেখানে রোকী তার মায়ের মতোই যোগ্যতা-দক্ষতা দিয়ে পারিবারিক ব্যবসা-বানিজ্য সামলে নিয়েছিলো,আন্দালিব যে কিনা নিঃস্বার্থভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলো।আন্দালিব কি একসময়ের ফুফা-ফুফির ওয়াদার কথা,রোকীকে পাওয়ার বাসনা কিংবা দূর্বলতা এখনো পোষণ করে!কিন্তু,রোকসানা তো চাচাত ভাই কাবিলের মধ্যে প্রাণের প্রাচুর্য খুঁজে নিয়েছিলো।হয়তো আন্দালিব নিজের নিয়তিকে মেনে নিয়েছে,নাকি সুন্দরী,যৌবনা তরুনী মোমেনাকে পাওয়ার মাঝে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছে।আর,মোমেনা কি শেশবে লালিত স্বপ্নকে কবর দিয়েছে,আশ্রয়হীন, অসহায়ত্বের কথা ভেবে,কিন্তু,সৃষ্টিকর্তা যে তাকে রহস্য,মায়াময়তা দান করেছেন,তা যেকোন পৌরষ হৃদয়ে আঘাত হানার ক্ষমতা রাখে।কিন্তু,হৃদয়ের সেই সুক্ষ্ম দূর্বলতায় কি আজো কাবিলকে পাওয়ার আশা রাখে সে,কাবিলও কি অবচেতন মনে তার সৌন্দর্য অনুধাবন করেনি,মোমেনাও হয়তো জানে, তার অসাধারণ কোন ক্ষমতা আছে,যা দিয়ে বিশ্ব জয় করতে পারবে।তবে,অভিভাবক হিসেবে কাবিল জেল থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্য়ন্ত সে আন্দালিবকে বিয়ে করতে রাজী হয় না,নারীত্বের পূর্নতার এ আশু সুযোগকে পায়ে ঠেলার অমিত সংযম কি তীব্র ভালোবাসা থেকেই জন্ম নিয়েছে।উপন্যাস পাঠক পারস্পারিক সম্পর্কের দ্বিধা-দ্বন্ধে জড়িয়ে পড়েছে, শ্বাশত নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কে নতুন রূপে অনুভব করবেন।এদিকে রওনক জাহান চান,কাবিল জেল থেকে ছাড়া পাবার পর এবার আর আংটি পড়াতে দেরী করবেন না,কিন্তু…
জেল ছাড়া পেয়ে, লিডারের সাথে ইলেকশনের সফরে প্রতিনিধি হিসেবে বেরিয়ে পড়তে হয়।এছাড়াও, নারী হৃদয়ের দ্বন্দ্ব -মোমেনা ও রোকীর মাঝে, যা পাঠককে উদ্বেল করে দেয়।পূর্ব পাকিস্তানের পরিবেশ দিন দিন উত্তপ্ত হতে থাকে অবাঙালীদের পরিচয় সংকট তৈরি হয়।