একটা কোম্পানি নতুন সিইও বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ করবে। বর্তমান দুই শীর্ষ কর্মকর্তার মধ্য থেকেই একজনকে সিইও করতে চাচ্ছে কোম্পানিটি। দুজনই স্মার্ট, অভিজ্ঞ ও সম্ভাবনাময়। কোম্পানিতে হঠাৎ বাজেট ঘাটতি দেখা দেওয়ায় একজন তাঁর বিশ্লেষণী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে খুঁজে বের করলেন কোথায় কোথায় খরচ কমানো যেতে পারে। আরেকজন হিসাব করে দেখালেন কী কী উপায়ে নতুন সুযোগ তৈরি এবং আয় বাড়ানো সম্ভব। এ অবস্থায় দুজনের কাকে সিইও বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দেবে কোম্পানিটি?
এমন পরিস্থিতিতেই ওই কোম্পানিটি পরামর্শক হিসেবে ডেকেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথের ‘টাক স্কুল অব বিজনেস’-এর কৌশল ও নেতৃত্ববিষয়ক অধ্যাপক সিডনি ফিনকেলস্টাইনকে। পেশাগত জীবনে সৃজনশীল হওয়ার গুরুত্ব বিষয়ে মতামত তুলে ধরতে গিয়ে ‘বিবিসি ক্যাপিটাল’-কে এ ঘটনা জানিয়েছেন তিনি। অধ্যাপক ও পরামর্শক ফিনকেলস্টাইনের এই লেখা থেকে জেনে নিতে পারেন সৃজনশীলতা কীভাবে পেশা জীবনে আপনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে আর সৃজনশীল হয়ে উঠতে একজন ব্যক্তি কী-ই বা করতে পারেন।
পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন ওই কোম্পানিটির সিইও বাছাই প্রক্রিয়ায় ফিনকেলস্টাইন কার পক্ষে মত দিয়েছিলেন? তাঁর মুখ থেকেই শুনি বাকি গল্পটাও। ‘দুই প্রার্থীর বিষয়ে কোম্পানিটির সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ছিল না। কিন্তু আমার বাজি অবশ্যই খরচ কমানোর জন্য কাটছাঁটের পরামর্শ দেওয়া বিশ্লেষক নেতার পক্ষে না গিয়ে নতুন সম্ভাবনা খুঁজে বের করতে চাওয়া সৃষ্টিশীল নেতার পক্ষেই ছিল।’
সৃজনশীল মানুষেরাই সৃজন করেন
যেসব কর্মীরা দুই ধরনের নেতার সঙ্গেই কাজ করেছেন তাঁরা সবাই-ই জানেন যে, কাটছাঁট করার চেয়ে নতুন কিছু গড়ে তোলার চেষ্টা করাটাই অনেক বেশি আনন্দের ও চ্যালেঞ্জের। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো টেকসই উন্নয়নের জন্য সৃজনশীলতাই একমাত্র পথ। কাটছাঁট করে সাময়িকভাবে মুনাফা বাড়িয়ে ব্যবসায়ের অংশীদারদের সন্তুষ্ট রাখা যেতে পারে কিন্তু এর চেয়ে বেশি এগোনোর সুযোগ নেই।
কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, তিনি বিশ্লেষণী ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন, সৃজনী ক্ষমতা নিয়ে নয়, তাই তাঁর পক্ষে ওই পথে পা বাড়ানোর সুযোগ নেই। অনেকেই এমন ভেবে থাকেন। কিন্তু সৃজনশীলতার চমত্কার গোপন রহস্যটি হলো, এটা শেখা যায়, এটা শিখতে হয়, এটা চর্চা করতে হয়। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই সম্ভাবনা আছে সমস্যা মোকাবিলায় নতুন সব চিন্তা হাজির করার, নতুন ভাবনা হাজির করার, বিশ্বটাকে ভিন্নভাবে দেখার। কিন্তু সাহস করে চেষ্টা শুরু না করলে সেটা বোঝা যাবে না।
সময় দিন, সময় কাজে লাগান
বিষয়টা এমন না যে, আপনি নিজেকে একটা ঘরে আটকে রাখলেন আর কোনো একদিন হঠাৎ অপার সৃজনী ক্ষমতা নিয়ে ঘর থেকে বের হলেন। একটা বিষয় সামনে এলে সেটার পেছনে সময় দিন। বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করুন। ভাবনা যেমন আপনাকে তাড়া করে বেড়াবে, তেমনি আপনিও ভাবনাকে তাড়া দিয়ে বেড়ান। ভাবতে থাকলে কোনো একসময় হঠাৎই সে আপনার কাছে ধরা দেবে। কেউ কেউ আছেন, সকালে আনমনে দাঁত মাজতে মাজতেই ভাবনার জগতের সোনা-রুপার কাঠিটা হাতে পেয়ে যান। কেউ কেউ হয়তো সেটা পান ঘুমোতে যাওয়ার সময় বিছানায় শুয়ে ভাবতে ভাবতেই।
এভাবে হঠাৎ আলোর দেখা পেয়ে গেলে কেউ কেউ কাগজ-কলম হাতে নিয়ে নোট করতে বসে যান সেগুলো টুকে রাখার জন্য। আবার কেউ কেউ মনে করেন, টোকাটুকির পেছনে ছুটতে গিয়ে তাঁদের ভাবনার ঘোরটাই টুটে যেতে পারে। তাই তাঁরা ভাবনাটাকে আপন মনে গড়াতে দেন আর ভাবনার আরও গভীরে ঢুকে যান, বিষয়টি আত্মস্থ করে ফেলেন। কাজের জগত্টাকে সৃজনশীল করতে হলে তা নিয়ে ভাবতে হবে, সময় দিতে হবে।
সহজ কিছু প্রশ্ন দিয়ে শুরু করুন
তাহলে কি আমরা সৃজনশীল হওয়ার ভাবনায় মজে থাকব আর অপেক্ষা করব, কবে সেই সোনার হরিণ ধরা দেবে! মোটেই না। আমাদের চেষ্টা করতে হবে। হাতের সামনে যে কাজ আসবে, তা নিয়েই শুরু করতে হবে। ওই কাজ সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নোত্তর দিয়েই শুরু করা যেতে পারে।
১. কাজটাকে কীভাবে ভিন্নভাবে করা যেতে পারে, ভিন্ন মাত্রা দেওয়া যেতে পারে?
২. এই কাজে আপনার প্রয়োজন মেটানোর জন্য কীভাবে অন্যদের ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়?
৩. আপনার পণ্য বা কাজের মধ্যে আপনি নতুন কি যুক্ত করতে পারছেন?
৪. আপনি কী কী বাদ দিতে পারেন, দূর করতে পারেন?
৫. নতুন কিছু তৈরি করার জন্য, কাজের প্রক্রিয়া বা ধরনটাকে আপনি কীভাবে পাল্টাতে পারেন?
এই প্রশ্নগুলোর তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে কিংবা এর বদলে আরও ভিন্ন ভিন্ন কিছু প্রশ্ন হাজির হতে পারে। কিন্তু আপনাকে কোনো কিছুর উত্তর খুঁজে পেতে হলে তো প্রশ্ন দিয়েই শুরু করতে হবে। তা-ই করুন। যে কাজের মুখোমুখি হয়েছেন তা নিয়ে যতভাবে পারেন নিজেকে প্রশ্ন করুন। এর পরে কাজ কেবল বানের জলের মতো আসতে থাকা উত্তরের স্রোতটাকে নিয়ন্ত্রণ করা, সেটাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া। সত্য কথাটা হলো, শিখতে চাইলে আর শেখার চর্চাটা করলে যে কেউই সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারেন। আর এই শেখার কাজটাও অনেকে অনেকভাবেই করতে পারেন। আসলে সৃজনশীল হতে হলে সৃজনশীল হওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই করতে হয় না!