banner

শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 304 বার পঠিত

 

কল্পনা রানী গ্রামের নারীদের ভরসা

কেউ ডাকেন ডাক্তার আপা, কেউ বৌদি, কেউ দিদি, আবার কেউবা মাসি। একটি এলাকার নারীদের জীবনে চলার সঙ্গী এই মানুষ। তাঁকে ছাড়া যেন স্বস্তি পান না গৃহিণীরা। মা ও শিশু স্বাস্থ্যের পরিচর্যা এবং পরিবার পরিকল্পনার সেবা দিতেন তিনি। হয়ে উঠেছেন সবার আপনজন।
এই সেবাদাতা নারীর নাম কল্পনা রানী সরকার। সরকারের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের ‘পরিবার কল্যাণ সহকারী’ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার লাহুড়িয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড ছিল তাঁর কর্মস্থল। ৩৯ বছর ধরে এখানেই চাকরি করেছেন। শ্বশুরবাড়ি একই এলাকায়। গত ২৬ জানুয়ারি তিনি অবসরে গেছেন। তারপরও এলাকার মানুষের ডাকে সাড়া দেন আগের মতো।
এ কাজপাগল মানুষকে ছাড়া যেমন এলাকার মানুষের চলে না। তেমনই পরিবার পরিকল্পনা বিভাগও দিয়েছে তাঁকে ভালো কাজের স্বীকৃতি। ১১ বার হয়েছেন উপজেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ কর্মী। জেলায় শ্রেষ্ঠ হয়েছেন দুই বার। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মহাপরিচালক বেশ কয়েকবার তাঁকে সনদ দিয়েছেন। সনদের লেখাগুলো এ রকম: ‘আপনি পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের একজন অগ্রসৈনিক। আপনার এলাকায় মা ও শিশুস্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বাস্তবায়নে আপনি পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং অনুকরণযোগ্য।’
২০০২ সালের অক্টোবরের এক শুক্রবারের বিকেল। বাচ্চাদের পোলিও টিকা খাওয়াতে হবে। তাই বাড়ি বাড়ি খবর দিচ্ছিলেন টিকা কেন্দ্রে আসার জন্য। হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। পা পিছলে পড়ে গিয়ে ডান হাতের কবজি ভেঙে যায়। কিন্তু হাতটি আর ভালো হয়নি। এখন ডান হাতটি অকেজো কল্পনার। লিখেন দুই হাতের সাহায্যে। সমস্যা হয় খাবার খেতে এবং নিজের অন্যান্য কাজে। কিন্তু দমে যাননি। এ অবস্থায় ঘরে বসে থাকেননি। এরপরও তাঁর উপস্থিতি এলাকার ঘরে ঘরে। এ অবস্থায়ও জেলার এবং উপজেলার শ্রেষ্ঠ কর্মী হয়েছেন।
লাহুড়িয়া ইউনিয়নের কচুবাড়িয়া, ছাইমনারচর, পশ্চিমপাড়া, হিন্দুপাড়া ও মোল্লাপাড়া—এই পাঁচটি এলাকায় ছিল তাঁর কাজ। এখানে বর্তমান লোকসংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এলাকার নারীরা জানালেন, মেয়েলি রোগের সব কথা নিজের আপনজনকেও বলা যায় না। লজ্জা লাগে। ‘ডাক্তার আপা’-ই তাঁদের ভরসা। তাই দুই-এক দিন তাঁকে না দেখলেই অস্বস্তিতে ভোগেন তাঁরা। ওই এলাকার গৃহিণী দিপালী বেগম, কনক বেগম ও লাভলী জানালেন, গর্ভাবস্থায় এবং শিশুর যত্ন নিতে এলাকার নারীরা তাঁর ওপরই ভরসা করেন। তাঁর পরামর্শে সবাই লাভবান হয়েছেন। তিনি নিজের মায়ের মতো পাশে থাকেন। অনেক পরিবারের স্বামী ও অন্য সদস্যদের অবহেলা সহ্য না করে নিজেই গর্ভবতীকে নিয়ে ছোটেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। উপজেলা বা জেলা শহরের হাসপাতালে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে সেখানে পরিবারের সদস্যরা সঙ্গে নেই। বাচ্চা প্রসব করিয়েছেন নিজ দায়িত্বে।
কল্পনা রানী বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় গর্ভবতীর পেটে বাচ্চার অবস্থান ভালো নেই। অশিক্ষিত পরিবার। কবিরাজি বা ঝাড়-ফুঁকে নজর তাঁদের। আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো ও অন্যান্য চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপচার না করালে মা ও শিশু মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ অবস্থায় নিজে দায়িত্ব নিই। পরে সবাই খুশি হয়।’
লাহুড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জি এম নজরুল ইসলাম বললেন, কল্পনা রানী এলাকায় ‘গরিবের ডাক্তার আপা’ বলে পরিচিত। চাকরি নয় সেবাই তাঁর ধর্ম।
কল্পনা বলছিলেন, ‘চাকরিজীবনের প্রথম দিকে ৭০-৮০-এর দশকে পরিবার পরিকল্পনার কর্মী শুনে অনেক বাড়িতেই ঢুকতে দেয়নি। “না জায়েজ কাজ” বলে তাড়িয়েছে। দমে যাইনি। এলাকার শিক্ষক ও সচেতন মানুষের সাহায্য নিয়ে সেসব পরিবারে সফল হয়েছি। এখনের পরিবেশ এমন মনে হয়, সবার যেন অভিভাবক হয়ে গেছি।’
এসএসসি পাস কল্পনা রানী ১৯৭৪ সালে বিয়ে করেন। স্বামী ছিলেন বেকার। অর্থাভাবে বাধ্য হয়ে দুই বছর পর তাঁকে এই চাকরি নিতে হয়েছিল। তিন ছেলে তাঁর। সবাই বিয়ে করেছেন। সবাই ব্যবসায়ী। স্বামী ও সংসারের অন্যদের নিয়ে এখন সচ্ছল পরিবার। এখন তাঁর ভাঙা হাতটিতে ব্যথা, উচ্চরক্তচাপ ও হাঁটুতে ব্যথা। কিন্তু বোঝা যায় না। সেবায় রত সর্বক্ষণ। তিনি বললেন, ‘এলাকার পরিবারগুলোর খোঁজ রাখতে না পারলে সুখ পাই না। মনে হয়, অজ্ঞতার কারণে যদি কোনো মা ও শিশু মৃত্যুমুখে পতিত হয়!’
লোহাগড়া উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তানভীর আহমেদের মতে, উপজেলা সদরের শেষ প্রান্ত (২০ কিলোমিটার দূরে) প্রত্যন্ত গ্রামে সাধারণ মানুষের সুচিকিৎসার পরামর্শে অন্যতম ভরসাস্থল কল্পনা রানী।

Facebook Comments