banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 288 বার পঠিত

 

কলসিন্দুরে আলো জ্বলার পর

আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ছোট্ট রায়হান মিয়া। সাবিনাদের বাড়ি খুঁজছি এমনটা বুঝেই এগিয়ে এল সে। খালি গা, পরনে হাফপ্যান্ট। ‘আপনারা এইহান দিয়া আইছুন ক্যা! রাস্তা তো পিছনে!’ পথ চেনার সুবিধার্থে রায়হানকে মোটরসাইকেলে তুলে নেওয়া হলো। সরু, কাদাময় রাস্তা ধরে কিছুদূর গিয়ে থামাতে হলো মোটরসাইকেল। এবার হাঁটাপথ। রায়হান বলল, ‘ওই যে, ওই মুহে।’ ওর কথায় ভরসা না পেয়ে অবশেষে পথচারীর দ্বারস্থ হলাম। তিনি উল্টো প্রশ্ন করলেন, ‘কোন সাবিনা? ফুটবল খেলে যে…?’ আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ, ফুটবলার সাবিনার বাড়ি খুঁজছি।’

আলোকিত হয়েছে তহুরাদের ঘরও। ছবি: জগলুল পাশাঢাকা থেকে ময়মনসিংহ। সেখান থেকে ধোবাউড়ার কলসিন্দুর। তারপর রানীপুর গ্রাম। সেই ভোরে শুরু হওয়া ভ্রমণ বিকেলে এসে শেষ হলো বুঝি। মাথা নাড়তেই সেই পথচারী দেখিয়ে দিলেন সেদিকেই, যেদিকে রায়হান এগিয়েছে খানিকটা। পুকুর পাড়, খেতের আইল পেরিয়ে টিনের চালা ও বেড়ায় ঘেরা সাবিনাদের বাড়িতে পৌঁছার আগেই থামতে হলো। মাটির বাড়ির দেয়ালে একটা বৈদ্যুতিক মিটার। অন্য কোথাও হলে এই বস্তুতে বিশেষত্ব খুঁজে পাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু কলসিন্দুরে বৈদ্যুতিক মিটার মানে অন্য রকম ব্যাপার। তাই সেটা দেখার জন্য না থেমে উপায় কি? ততক্ষণে আমাদের দেখে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন বাড়ির বয়সী মানুষ হেলেনা খাতুন। বললেন, ‘কারেন পাইছি ওই সাবিনার জন্যই। অহন আর রাত্রে বেলা ঘুটঘুইটা অন্ধকার থাহে না। ঠিকঠাক চোহে দেহি। আর ওই যে পুকুরটা দেখেন, ওইটার মাঝখানে একটা লাইট জ্বালায়া দেই। পোকামাকড় আইসা পানিতে বসে। মাছ সেই পোকামাকড় খায়। এইবার শিং মাছের চাষ খুব ভালা হইছে।’

মাটির ঘরে জানালা দিয়ে ততক্ষণে মুখ বের করে দিয়েছে হেলেনা খাতুনের ছোট্ট নাতি। তাকে দেখিয়ে বললেন, ‘আগে আমার নাতি পড়ত কুপি জ্বালাইয়া, আর এহন পড়ে কারেনের আলোতে।’ হেলেনা খাতুন কখনো ভাবেননি তাঁর বাড়িতে বিদ্যুৎ আসবে। এ কারণেই তাঁর কাছে এই বৈদ্যুতিক আলোর গল্প বেশ দীর্ঘ। সে গল্প শোনা শেষ হলে আমরা পা বাড়াই সাবিনাদের বাড়ির দিকে। তাদের বাড়ির সামনে বিদ্যুতের নতুন খুঁটি। ঠিকঠাক করে বললে, খুঁটির বয়স হয়েছে ছয় মাসের বেশি।

কলসিন্দুরের মেয়ে ফুটবল দলের একজন সাবিনা আক্তার। ২৫ জুন ওদের বাড়িতে পা রেখেই কানে এল ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক পাখার শব্দ। সাবিনার কাছে জানতে চাই, ‘খেলোয়াড় জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী?’

 ফুটবল মাঠে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে কলসিন্দুরের এই মেয়েরা। ছবি: প্রথম আলো‘এহন গাঁয়ের লোকজন আমাগো পছন্দ করে। আদর করে। আর রাস্তায় বের হলে যেখানেই যাই কোনো গাড়িওয়ালা ভাড়া নিতে চায় না। শুধু ফুটবল খেলি বইলাই তো এত কিছু।’ বাড়ির বারান্দায় বসে লাজুক মুখে উত্তর দেয় সাবিনা। কলসিন্দুর ফুটবল দলের মধ্য মাঠের খেলোয়াড় সে। পুরো মাঠ আগলে রাখার মতো করে পুরো গ্রামটাই আগলে রাখে যেন!
গন্তব্য এবার ‘মেসি’র বাড়ি!
শুধু দলে নয়, গ্রামের মানুষও তাকে মেসি নামেই ডাকে। আসল নাম শরাবন তহুরা। আর্জেন্টিনার মেসি দেশকে কোনো শিরোপা দিতে পারেননি সত্যি, কিন্তু এই ‘মেসি’ ঠিকই মুক্তাগাছা গ্রামে আলো জ্বালিয়েছে। সুপারিগাছের সারি, মাছের ঘের, আর বেশ কয়েকটা খেতের আইল পেরিয়ে যখন ওদের বাড়িতে পৌঁছালাম, তখন বিকেল। ওর বাড়িতে পৌঁছার আগেই তহুরা-বন্দনা করলেন ওদের পাশের বাড়ির নুর আলী। বললেন, ‘এর আগে দুজনকে টাকা দিছিলাম কারেনের জন্য। কেউ আইনা দিতে পারে নাই। আর এই মেসি আমাগো ঠিকই কারেন আইনা দিল। অয় যে আরও কত কী করব কে জানে! বাইত্তে আপাতত দুইটা লাইট লাগাইছি। কয়েক দিনের মধ্যে ফ্যানও লাগামু।’ বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল তহুরা। শারীরিক অসুস্থতার কারণে কদিন আগে ঢাকা থেকে ফিরেছে। তহুরাসহ কলসিন্দুর ফুটবল দলের ১০ জন খেলোয়াড় এখন প্রশিক্ষণ নিচ্ছে ঢাকায়। সেখান থেকে হঠাৎ ছন্দপতন তার। তবে এরই মধ্যে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে সে। খুব তাড়াতাড়ি ঢাকা যেতে চায় তহুরা।

সাবিনাদের বাড়ির পাশেই বসেছে বৈদ্যুতিক খুঁটি‘এত মানুষ প্রশংসা করছে, কেমন লাগে?’ প্রশ্ন শুনে তহুরা হাসে। ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া মেয়েটি যাবতীয় উত্তর যেন এক হাসিতে দিয়ে দেয়। হাসতে হাসতেই বলল, ‘ভালো। আমি আরও ভালো খেলতে চাই।’ বিদ্যুৎ, প্রশংসা কিংবা পড়াশোনা—এত কিছুর পেছনে শক্তি এই খেলাই। আমরা ওর পড়ার টেবিলের সামনে গিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। পড়ন্ত বিকেলের রোদে ঝকঝক করছে বিস্তীর্ণ মাঠ, দূরের কয়েকটা গাছ। এত সুবিশাল মাঠের সামনে বসে যে মেয়েটি পড়ে, তার স্বপ্ন তো এমনই হবে।
‘এখন টিভিতে ওগো খেলা দেহি’
ময়নাকে খুঁজছি জেনে আশপাশের কয়েক বাড়ি থেকে লোকজন চলে এল। ময়না এল খানিক পরে। দেরির কারণটাও বোঝা গেল হাতে ফুটবল দেখে। পাশেই অনুশীলন করছিল সে। ঢাকায় যে ১০ জন প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, তাদের মধ্যে নেই বালশ্রী মানখিন ময়না। পরের বার যেন এই সুযোগ মিস না হয়, এ কারণেই বাড়তি পরিশ্রম। এখন টিভিতে কোনো ফুটবল খেলা দেখালেই বসে পড়ে সে। তার সঙ্গে এ পাড়ার অনেকেই। দল বেঁধে টিভি দেখার ব্যাপারটি শুরু হয়েছে মাস ছয়েক হলো। কারণ গামারিতলার ২০ ঘরে বিদ্যুৎ এসেছে ময়নার কল্যাণে। তাদের কাছে ময়না এখন রীতিমতো ‘নায়ক’। ময়না বলল, ‘আগে মানুষজন চিনত না অতটা। এখন চেনে। বিদ্যুৎ আসাতে যে এত পরিবর্তন হবে, আগে বুঝি নাই।’

ময়নার খালা লুতিমা মানখিন ঘরের দেয়ালে বৈদ্যুতিক মিটার দেখিয়ে বললেন, ‘কারেন আসা-যাওয়ার মধ্যে আছে। সন্ধ্যা হলেই চইলা যায়।’ বলতে বলতে বিদ্যুৎ একবার বিদায় নিল। অবশ্য ফিরে আসার একটু আগেই দেখা হলো ময়নার এনে দেওয়া বিদ্যুতের সঙ্গে। খালা বললেন, ‘এখন টিভিতেই ওগো খেলা দেহি। কী যে ভালো লাগে!’

বাড়ির সবাইকে নিয়ে টিভি দেখছে ময়না (ডানে চেয়ারে বসা‍)আরও কিছুর আশায়
কলসিন্দুর ফুটবল দলের ১৯ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে দুজনের বাড়িতে আগে থেকেই বিদ্যুৎ ছিল। বাকি ১৭ জনের বদৌলতে বিদ্যুৎ পেয়েছে নয় গ্রামের ৮০৩টি পরিবার। এ তালিকায় স্কুলের সভাপতি এমনকি সেই শিক্ষার্থীদের প্রিয় ‘মফিজ উদ্দিন স্যার’ও রয়েছেন। স্কুলের মাঠে বসে কথা হলো মফিজ স্যারের সঙ্গে। বললেন, ‘প্রথম আলোর কারণেই আমার শিক্ষার্থীদের চিনেছে সবাই। আর আনিসুল হকের কারণে এত তাড়াতাড়ি বিদ্যুৎ এসেছে। আর সরকারের আন্তরিকতা তো ছিলই। আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া এটা।’
বলে রাখা ভালো, ২০১১ সালে কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মফিজ উদ্দিন স্যার মেয়েদের নিয়ে গড়ে তোলেন ফুটবল টিম। এই দলটি ধীরে ধীরে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয় দুবার। এখন অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় দলের ১৮ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ১০ জনই কলসিন্দুর উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়ে। গত বছরের ২২ আগস্ট প্রথম আলোর ময়মনসিংহ প্রতিনিধি কামরান পারভেজ শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদনে লেখেন ‘ফুটবল রাঙাচ্ছে কলসিন্দুরের মেয়েরা’। ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রথম আলো এই মেয়েদের নিয়ে তৈরি করে প্রামাণ্যচিত্র ‘অদম্য মেয়েরা’। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সুধী সমাবেশে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয় ওই গ্রামের ২০ ফুটবলার, কোচ মফিজ উদ্দিন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জালাল উদ্দিনকে।

এই শিক্ষার্থীদের চাওয়াতেই গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর বিদ্যুৎসংযোগ দেওয়া হয় কলসিন্দুরসহ আশপাশের গামারিতলা, পশ্চিম গামারিতলা, পঞ্চদন্দপুর, দক্ষিণ রানীপুর, মুক্তাগাছা, রামসিংহপুর, গৌরীপুর ও সোহাগীপাড়া গ্রামে।

আমরা যখন ফিরছি তখন দিনের আলো নিভে গেছে। আস্তে-ধীরে জ্বলে উঠছে বৈদ্যুতিক বাতি। মাঠ পেরিয়ে আমরা চলে যাচ্ছি দূরে। পেছনে আলোকিত হয়ে আছে ‘মেসি’দের গ্রাম!

ঈদ কেটেছে আনন্দে…

কলসিন্দুরের ফুটবলার মেয়েদের ঈদ কেটেছে আনন্দে। তবে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় অনুশীলন করতে যাওয়া ১০ জনকে ঈদ পালন করতে হয়েছে ঢাকায়। মফিজ উদ্দিন বললেন, ‘ঈদ উপলক্ষে ওদের ফেডারেশন থেকে নতুন পোশাক দেওয়া হয়েছে। আর ঈদের দিন ভালোমানের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ছিল। ঈদের পরদিন থেকে যথারীতি আবার অনুশীলন শুরু হয়েছে ওদের। এ কারণে আর বাড়ি ফেরা হয়নি কারোরই।’ ১০ জনের মধ্যে তহুরা অসুস্থতার কারণে বাড়িতে গেলেও ঈদের আগেই এসে যোগ দিয়েছে ওই দলে। সবার সঙ্গে তার ঈদটাও দারুণ কেটেছে। ১০ জন ঢাকায় ঈদ করলেও বাকি ৯ জন ঈদ করেছে গ্রামে। ঈদের পরে কথা হলো সাবিনা আক্তারের সঙ্গে। বলল, ‘ঈদ উপলক্ষে নতুন জামা ও জুতা কিনেছি। ঈদের দিন পাশের বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। আর ঈদের পরে গিয়েছিলাম আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে। সবাই অনেক আদর করেছে।’

Save

Save

Save

Save

Save

Facebook Comments