banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 416 বার পঠিত

করোনাভাইরাস: লকডাউনের মধ্যে একাকী তিন নারীর ঘরবন্দী জীবন

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে আরোপ করা লকডাউন অনেকের জীবনকেই আকস্মিকভাবে যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে।

বিশেষ করে যারা একা থাকেন, তাদের জন্য সেল্ফ-আইসোলেশনের জীবন হতে পারে ভীষণই দুর্বিষহ এক অভিজ্ঞতা।

কিভাবে লকডাউনের মধ্যে নিজের মনকে চাঙ্গা রাখবেন? নিজেকে ব্যস্ত রেখে একাকীত্বকে দূরে সরিয়ে রাখবেন?

পৃথিবীর তিন প্রান্তের তিন নারীর সাথে কথা বলেছেন বিবিসির কেলি লেই-কুপার। এই তিন নারীর একজন ভারতের দিল্লিতে, একজন ইতালির মিলানে, আর শেষজন যুক্তরাষ্ট্রের মেইনে।

তারা তিনজনই একা, তিন জনই লকডাউনে আটকা পড়েছেন নিজ নিজ এ্যাপার্টমেন্টে।

গত কিছু দিনে তার বাড়ির নিরাপত্তা রক্ষীরা ছাড়া আর কোন মানুষের চেহারা দেখেননি অপর্ণা।

ভারতের রাজধানী দিল্লির কাছে গুরগাঁওয়ে তার মায়ের পুরোনো এ্যাপার্টমেন্টে একা থাকেন তিনি।

পুরো এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সটির গেট এখন তালা দেয়া, সাথে আছে নিরাপত্তা রক্ষীর সার্বক্ষণিক পাহারা।

অপর্ণার বয়স ২৬। লকডাউন শুরু হবার পর তিনি সেই গেট পার হয়েছেন মাত্র এক বার।

দিনে দু‌ই বার তিনি ঘর থেকে বের হন – তার দুটি কুকুর জুলস আর ইয়োগীকে হাঁটানোর জন্য।

বেশ কিছুকাল নিউইয়র্কে ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করার পর মিলানে ফিরে আসতে পেরে বেশ খুশি ছিলেন লুসিয়া।

সারা দিন ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে ঘুরে কাজ করা , আর দিনের শেষে বন্ধুদের নিয়ে খেতে যাওয়া – ভালোই কাটছিল মিলানে লুসিয়ার দিনগুলো।

কিন্তু কয় ‌‌‍মাস পার না হতেই ইতালিতে ছড়িয়ে পড়লো করোনাভাইরাস, আর মিলান শহর পরিণত হলো ইতালিতে করোনাভাইরাসের এপিসেন্টারে।

লুসিয়া সহ লক্ষ লক্ষ ইতালিয়ান আটকা পড়লেন লকডাউনে, শুরু হলো দিনের পর দিনের জন্য তার ঘরবন্দী জীবন।

স্বাভাবিকভাবেই সারা দিন এ্যাপার্টমেন্টে বসে থাকাটা ছিল খুবই কষ্টকর। অন্তত: প্রথম দু‌এক সপ্তাহ।

তবে এখন – বাধ্য হয়েই – লুসিয়াকে মানিয়ে নিতে হচ্ছে এই একাকী ঘরবন্দী জীবনের সাথে।

তিনি এখনো মিস করেন তার স্বাধীনতা আর অন্যদের সাহচর্য।

কিন্তু সারা দেশে যখন এত মানুষ মারা যাচ্ছে তখন তার প্রিয়জনেরা যে সবাই সুস্থ আছে – এই বা কম কী? এমনটাই ভাবেন তিনি।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে যখন করোনাভাইরাস স‍ংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লো – তখন তার এই একাকী জীবনের সমস্যাগুলো যেন আচমকাই এসে তাকে আঘাত করলো।

সপ্তাহ দুয়েক আগে এ্যাঞ্জির চাকরিটা চলে যায়। ‍স্বাভাবিক সময়ে এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের কাছ থেকে একটা সান্ত্বনা মেলে, বা একজন বন্ধু হয়তো দাওয়াত করে আমাকে উৎফুল্ল করে তুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু এখন এসব কিছুই নেই। এ্যাঞ্জি এখন একেবারেই একা।

সামাজিক সম্পর্ক এবং শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য

অনেক গবেষণাতেই দেখা গেছে যে মানুষের সামাজিক সম্পর্কগুলো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের মতো শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ।

বিভিন্ন গবেষণায় তীব্র একাকীত্বের সাথে উচ্চ মৃত্যুহার এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার সম্পর্ক দেখা গেছে।

সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং যোগাযোগহীনতা কীভাবে মস্তিষ্কের আচরণকে প্রভাবিত করে – তার গবেষণার জন্য সুপরিচিত মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক নাওমি আইজেনবার্গার।

তিনি বলছেন, বর্তমানে এই যে শত শত কোটি লোক তাদের স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে – তা নজিরবিহীন এবং একাকী বসবাসকারী লোকদের জন্য প্রিয়জনদের সাথে যুক্ত থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পোষা প্রাণী অনেকটা ভুলিয়ে দিতে পারে একাকীত্ব

এ সময় মানুষ যেভাবে অনলাইনে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে – তা কি আসলে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা মানুষদের মানসিক প্রয়োজন মেটাতে পারছে? অধ্যাপক আইজেনবার্গারের গবেষণা দল এখন সেটারই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে ।

তিনি বলছেন, আপনার যদি কোন পোষা প্রাণী থাকে যাকে আপনি স্পর্শ করতে পারেন, জড়িয়ে ধরতে পারেন – তাহলে তা মানসিক চাপ অনেকটা কমাতে পারে।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টেফানি কাচিওপ্পো ‌বলছেন, নিজের ভাবনা-চিন্তা ও প্রত্যাশাগুলোকে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়া একাকীত্ব দূর করার জন্য খুবই জরুরি। তিনি বলছেন, এ সময়টাকে নানাভাবে কাজে লাগানো সম্ভব।

অনেকে ছবি আঁকছেন, ছবি তুলছেন, লিখছেন জার্নাল

এ্যাঞ্জি যেমন আবার ছবি আঁকা শুরু করেছেন। তার আঁকা ইলাস্ট্রেশন অনলাইনে পোস্ট করছেন, তাতে প্রকাশ করছেন তার আবেগ-অনুভূতি, মহামারির মধ্যে একাকী বাস করার অভিজ্ঞতা। তিনি বলছেন, এটা তাকে মানসিকভাবে স্থির রাখতে সহায়ক হচ্ছে।

ড. কাচিওপ্পো বলছেন, বিচ্ছিন্নতার এই সময় অনেকে জার্নাল লিখতে পারেন। এক একটি দিনে কী কী করবেন তার ছোট ছোট লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে পারেন। এতে আপনার মনে একটা শান্তির বোধ আসবে যে আগামীকালের জন্য আপনার করার কিছু আছে।

তিনি একটা কাজ করেছিলেন – গত ৩০শে মার্চ তিনি তারই একটা ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছিলেন। শিরোনাম ছিল, ‍‌”কোয়ারেন্টিনে থাকা একজন নারীর আত্মপ্রতিকৃতি।“

তার পর কয়েকদিনের মধ্যে আরো শত শত নারী পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে তাদের ছবি পোস্ট করেছেন।

গ্যাটউড এখন এসব ছবি দিয়ে একটা ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

দিল্লি থেকে অপর্ণাও তার একটা আত্মপ্রতিকৃতি পাঠিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি এই লকডাউনের মধ্যে এক বছরেরও বেশি সময় পর এই প্রথমবার হাতে তুলে নিয়েছেন তার ক্যামেরাটি, এবং তার ঘরবন্দী জীবনের ছবি তুলতে শুরু করেছেন।

তিনি বলছেন, সবাইকে তিনি এটাই বলতে চান যে কোন অপরাধবোধে না ভুগে যা খুশি করার জন্য এ সময়টাকে কাজে লাগানো যায়।

ড. কাচিওপ্পো বলছেন, এরকম এক ট্রাজেডির একটা ইতিবাচক পরিণাম হলো – এর মধ্যে দিয়ে অনেক জাতির লোকেরা পরস্পরের সাথে যুক্ত অনুভব করতে পারে।

দিল্লির অপর্ণা বলছেন, এ অবস্থায় বোঝা যাচ্ছে যে আমরা সবাই কতটা ঝুঁকির মুখে আছি। পৃথিবীর অন্য যে কোন প্রান্তের মানুষদের বুঝতে পারাটা এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। আমার মনে হয় এমন একটা কঠিন সময়েও এ উপলব্ধি একটা প্রয়োজনীয় এবং সুন্দর একটা ব্যাপার। বিবিসি

Facebook Comments