পটুয়াখালী জেলার জৈনকাঠি গ্রামের সাফিয়ার বেগমের মেয়ে আদুরী। কিন্তু ওর ভাগ্যটা ঠিক উল্টো। গরিবের মেয়ে কখনো আদরের আদুরী হতে পারেনি। অভাব অটনের সংসার, বাবা বেঁচে নেই। সন্তানের মুখে দু’মুঠো ভাত দিতে হিমশিম খান সাফিয়া। মেয়ে ভালো খাবে ভালো থাকবে সেই আশায় রাজধানী পল্লবীর বাসিন্দা নওরীন আক্তার নদীর বাসায় কাজে দেন। আদুরীর বয়স আর কত হবে, নয় কি সাড়ে নয় বছর। যে বয়সে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়ানোর কথা, সে বয়সে পেটের দায়ে অন্যের বাসায় কাজ করে। ঘর মোছা, ধোয়া-মোছা সবই তাকে করতে হয়। তার পরও পেট পুরে খেতে দেয় না। টুকটাক মারধর তো আছেই। যেন পান থেকে চুন খসলেই ওর পিঠে ঝড়ের গতিতে চলে মারধর।
আদুরী যেহেতু মেয়ে, সেহেতু ওর মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় একটু সাজতে। সেদিন ও নওরীনের কানের দুল পরেছিল। নওরীন তা দেখে ফেলে শুরু হয় অত্যাচার। ওকে মেরে আগুনে পুড়ে ময়লার স্তূপে ফেলে রাখে। পুলিশ ওকে উদ্ধার করে। নওরীন তো মা-নারী। ওরই বয়সী নিজের সন্তান আছে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক সবার জন্য। তবে কেন আদুরী ঝরে পড়ল? এর দায়ভার আমাদের সবার- শিক্ষক, অভিভাবক এসএমসি’র সদস্যের, মেম্বর, চেয়ারম্যান, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সর্বোপরি সরকারের।
রিতা, এক সময় পরিবারে অবস্থা ভালো ছিল। তিন বোনের মধ্যে ও মেজ। ওর বাবার কাপড় ইস্ত্রি করার দোকান ছিল। হঠাৎ ওর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিন মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে ওর মা হিমশিম খান। পাশের বাড়ির একজন পরামর্শ দেয়, তার পরিচিত ঢাকায় এক জজ আছেন। তাদের মেয়েকে দেখাশোনার একজন লোক দরকার। যদি তোমার মেয়েকে দাও তা হলে সে পড়াশোনা করবে আর তার মেয়েকে দেখবে। রিতার মা রাজি হন। রিতা তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। ওর মা ভাবে, মেয়ের লেখাপড়াও চলবে, তার পর ভালো খাবে। কিন্তু দেখা গেল লেখাপড়া তো দূরের কথা। ঠিকমতো তিন বেলা খেতে দেয় না। ঘর মোছা, থালা-বাটি ধোয়া- এসব করতে হয়। জজের স্ত্রী বলেন, গরিবের আবার লেখাপড়া কিসের। জজ শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করে সভা সমিতিতে বক্তৃতা দেন। অথচ তার ঘরে শিশু নির্যাতন চলে।
ছনিয়া ধোপাকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ত। এক দিন ওর মা-বাবা পরের বাড়িতে কাজে যায়। ও বাড়িতে একা। এ সুযোগে ওসমান মোল্লা ওর ইজ্জত লোটে। এ নিয়ে গ্রামে সালিসি ব্যবস্থা হয়; কিন্তু রায় মোল্লার পক্ষে। ছনিয়ার স্কুলে যাওয়া বন্ধ।
মনি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ত নানীর কাছে থেকে। ও এক দিন একটা ছেলের সাথে কথা বলে। চোখে পড়ে গ্রামের মাতব্বরের। ওর বিচার হবে। সালিস ডাকা হলো। বিচারে সাব্যস্ত হলো ও নষ্টা মেয়ে, ওকে গ্রামে রাখা যাবে না। অবশেষে মনি ও ওর নানী গ্রামের ছোট ঘরবাড়ি রেখে শহরের অনিশ্চিতের পথে পা বাড়ায়। যে মেয়েটির বয়স ১০-১১ বছর, যার ভেতর এখনো শৈশব। কৈশোরে পা দেয়নি। তাকে অপবাদ মাথায় নিয়ে গ্রাম ছাড়তে হয়েছে।
রহিমার বয়স ১০ হতে পারে। মা-বাবা নেই। নানীর কাছে মানুষ। নানীর অবস্থাও বেহাল। তাই ঢাকায় এক বাসায় কাজে দেন। মেমসাহেব ওকে খুব আদর করে মেয়ের মতো দেখেন। ওকে ভিন্ন বিছানায় ঘুমাতে দেন। মাঝ রাতে ওকে কে যেন চেপে ধরে বলে ভূত। তারপর শরীরে ওঠে। ও ব্যাপারটা মেম সাহেবের কাছে জানায়। মেম সাহেব বুদ্ধি করে বলেন, তুই আমার বিছানায় ঘুমা। আমি তোর বিছানায় ঘুমাই। মাঝ রাতে তিনি দেখলেন এ ভূত আর কেউ নয়। এ যে তার স্বামী। কত না নির্যাতন চলে অবুঝ শিশুদের ওপর। শুধু পেটের দায়ে অন্যের বাসায় কাজ করতে এসেছে।
সৎ বাবার পাশবিকতায় মৃত্যুবরণ করতে হলো চার বছরের শিশু সুনিয়াকে। মা রুমা শিশু সুনিয়াকে নিয়ে আবার বিয়ে করেন বাদলকে। ওরা কাজিমুদ্দিনের বাড়িতে ভাড়া থাকে। রুমা গার্মেন্টে কাজ করেন। মঙ্গলবার সুনিয়াকে রেখে রুমা কাজে যান। বাদল ধর্ষণ করে পালিয়ে যায়। রুমা বাসায় ফিরে মেয়ের অবস্থা খারাপ দেখে স্থানীয় হাসপাতালে নেন। অবশেষে বৃহস্পতিবার সুনিয়া পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পরপারে চলে যায়। বাদল কী মানুষ? পিতা না হোক পিতার মতো ছিল। মেয়ে শিশুর জন্য কোনো পুরুষ নিরাপদ নয়। মামা-চাচা, নানা-দাদা, ফুপা, খালু, চাচাত ভাই, মামাত ভাই ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাত্রাবাড়ীর কাজলায় ভাতিজিকে ধর্ষণ করতে গিয়ে মাহবুব ধরা পড়ে এলাকার লোকজনের কাছে। শুক্রবার দুপুরে মেয়েকে রেখে বাজারে যায় মা। মেয়ের বয়স ১৩ হবে। মাদরাসায় পড়ে। এ সময় স্বামীর মামাত ভাই সিএনজিচালক মাহাবুব ঘরে এসে ধর্ষণের চেষ্টা করে। মেয়ের চিৎকারে এলাকাবাসী মাহবুবকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়।
মেয়ে শিশু পুরুষ আত্মীয়ের কাছে নিরাপদ নয়। মেয়ে শিশু নির্যাতিত হয় বেশি। বাসা বাড়িতে কাজে দিলে গৃহকর্তা অথবা তাদের ছেলে দ্বারা ভাইয়ের বন্ধুদের দ্বারা, চাচাতো ভাই, মামাত ভাই তো দূরের কথা এমনকি শিক্ষক দ্বারাও ধর্ষিতা হয়। তাই মেয়ে অন্যের বাসায় কাজে দেবেন না। অন্যের কাছে রেখে কোথাও যাবেন না। ওকে চোখে চোখে রাখুন। পুরুষ হায়নার দল সুযোগ পেলেই ছোবল দিতে পারে।
একটা শিশু একটা ফুল। সেই ফুলকে বিকশিত করার দায়িত্ব সমাজের সর্বস্তরের মানুষের। ওকে পড়াশোনা করার সুযোগ দিন। ও যেন মানুষ হতে পারে। শিশু নির্যাতন শুধু আইন করে বন্ধ করা যাবে না। সচেতন হতে হবে সবাইকে। আর একটা শিশুও যেন ধর্ষিত অথবা নির্যাতিত না হয়।
লিখেছেন: আন্জুমান আরা রিমা