হার্ভার্ড থেকে এসে তুমি পরিবহনশিল্পে কাজ করবে? পারবে তো?’
নিজের মেয়েকে কথাগুলো বলেছিলেন মো. আবদুল মালেক। কিন্তু মেয়ে মালিহা মালেক কাদির কঠিন কাজটাই করতে চান। নিতে চান চ্যালেঞ্জ। একেবারে ‘ব্র্যান্ড নিউ চ্যালেঞ্জ’। কাজ যতই কঠিন হোক, মালিহা তা করতে চান সহজ করেই। অন্যদের জন্য কাজগুলোকে সহজ করে দিতে চান। তাই তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ‘সহজ ডটকম’। নাগরিক জীবনে সহজ ডটকম বেশ পরিচিতও বটে। সহজ ডটকম বাস ও লঞ্চের টিকিট বিক্রি করে। তথ্যপ্রযুক্তির ভাষায় এটি ই-কমার্স উদ্যোগ।
‘শাড়ি, গয়না ইত্যাদি পণ্য বিক্রি করেও ই-কমার্স শুরু করতে পারতাম। কিন্তু চেয়েছি নতুন ও চ্যালেঞ্জিং কিছু করতে।’ মালিহার সঙ্গে কথা হচ্ছিল গতকাল সোমবার রাজধানীর গুলশানে সহজ ডটকমের অফিসে বসে। মালিহা মালেক কাদির সহজের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সহজ ডটকম প্রতিষ্ঠার আগে আন্তর্জাতিক বেশ কটি প্রযুক্তি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে মালিহার।
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ঘোষিত ১০০ জন ইয়াং গ্লোবাল লিডারের (ওয়াইজিএল) তালিকায় স্থান পেয়েছে মালিহার নাম। প্রতিবছরই নানা ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ৪০ বছরের কম বয়সী ১০০ জন তরুণকে নিয়ে ওয়াইজিএল তালিকা বানায় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। দক্ষিণ এশিয়া থেকে ২০১৭ সালের তালিকায় নাম আছে নয়জনের। বাংলাদেশ থেকে শুধুই আছেন মালিহা। গত বছর এ তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ওয়েবসাইটে মালিহা সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখা হয়েছে এমনটা—তিনি একজন ব্যবসায়ী এবং একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা। যাঁর স্টার্টআপ (নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ) বাংলাদেশের পরিবহনশিল্পকে ডিজিটাইজ করে এর মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
সহজ ডটকমের জন্যই ইয়াং গ্লোবাল লিডারস তালিকায় স্থান পেলেন? মালিহার জবাব, ‘আমার মনে হয় শুধু এটা নয়। আমার সব কাজ মিলেই হয়তো ওঁরা নির্বাচন করেছেন।’ দুই মাস আগে ফোনে মালিহাকে এই খবর জানানো হয়েছিল। ডব্লিউইএফের এই তরুণ বিশ্বনেতাদের কী করতে হয়? ‘বছরজুড়ে বিশ্বব্যাপী নানা আয়োজন থাকে এই ফোরামের। প্রতিবছর যে ১০০ জন তরুণ নির্বাচিত হন, তাঁরা এই আয়োজনগুলোতে আমন্ত্রণ পান। নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময়, নিজের দেশের কথা তুলে ধরার সুযোগ তৈরি হয়।’
ঢাকার সাউথ ব্রিজ ও স্কলাস্টিকায় পড়াশোনা করে মালিহা যান যুক্তরাষ্ট্রে। ২০০০ সালে স্মিড্থ কলেজ থেকে অর্থনীতি ও কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক হন। এরপর মরগ্যান স্ট্যানলিতে বিনিয়োগ ব্যাংকিং নিয়ে কাজ শুরু করেন। বাংলাদেশের ব্র্যাকনেটেও কাজ করেন কিছুদিন। আবার ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে, পড়াশোনা করেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) ডিগ্রি অর্জন করেন ২০০৮ সালে। এরপর যোগ দেন মুঠোফোন প্রতিষ্ঠান নকিয়া সিঙ্গাপুরে। সে সময় ব্যবসায় উন্নয়ন ব্যবস্থাপক হিসেবে ভারত, চীন, নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশে নকিয়ার ডিজিটাল কনটেন্ট সেবা নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা হয় তাঁর। নকিয়ার পর সিঙ্গাপুরে ডিজিটাল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভিস্তাপ্রিন্টে কাজ করেন।
নকিয়া আর ভিস্তাপ্রিন্টের অভিজ্ঞতার পরই সহজ ডটকমের ধারণা মাথায় আসে মালিহার। তিনি বললেন, ‘সব সময়ই দেশে ফিরে আসতে চাইছিলাম। আমার পড়াশোনা আর কাজে যেহেতু তথ্যপ্রযুক্তি, অর্থনীতি আর বাণিজ্যের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাই নিজের ব্যবসায় উদ্যোগ শুরু করতে চাইলাম। আর তা অবশ্যই তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক।’
অনেক দেশেই পরিবহনের টিকিট এখন অনলাইনে ঘরে বসে কাটা যায়। ‘বাংলাদেশেও এটা করা যায়-এমনটাই আমার মনে হয়েছে। তাই পুরো পরিকল্পনা করে, বিনিয়োগ ঠিক করে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামি।’ ২০১৩ সালে দেশে ফিরে সহজ ডটকম চালু করেন মালিহা মালেক কাদির। প্রথমে বাসমালিকদের বোঝাতে হয়েছে, ক্রেতাদের বোঝাতে হয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে মানুষ এখন অভ্যস্ত হচ্ছে, আস্থা পাচ্ছে অনলাইনে টিকিট কাটার ব্যাপারে। ‘পরিবহন খাতে সব দেশেই কিছু অনিশ্চয়তা থাকে। বাংলাদেশেও একই চিত্র। তাই আমরা বাস ও লঞ্চের টিকিট বিক্রির প্রচলিত ধারা ধরে সফটওয়্যার বানিয়েছি।’
সহজ ডটকমে এখন কাজ করছেন ৮০ জন কর্মী। ‘ভবিষ্যতে আরও বড় হবে এই প্রতিষ্ঠান। আরও অনেক কিছু নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে। তবে ই-কমার্স উদ্যোগকে লাভজনক করা অত্যন্ত দীর্ঘ এক প্রক্রিয়া। স্ট্রাগলটা করতে হয় অনেক দিন ধরে।’ বললেন মালিহা।
মালিহার বাবা মো. আবদুল মালেক আবাসনশিল্পে জড়িত। মা নার্গিস মালেক চাকরি করতেন জীবন বীমা করপোরেশনে। ২০০০ সালে মালিহা বিয়ে করেন খালিদ কাদিরকে। খালিদ কাদির এখন বাংলাদেশে ব্রামার অ্যান্ড ক্যাপিটাল পার্টনারস নামে একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের অংশীদার। তাঁদের দুই মেয়ে আনুশকা ও সোফিয়া।
এমন এক ব্যবসায় উদ্যোগ নিয়ে কাজ করেন মালিহা, যেখানে সব সময়ই সচেতন থাকতে হয়। যাত্রী মানে টিকিট ক্রেতা এবং পরিবহন কোম্পানির মধ্যে সমন্বয় চলতে থাকে সব সময়ই। অবসরে রান্নাবান্না করতে পছন্দ করেন। কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বিভাজন করেন না। ‘যার মাথায় বুদ্ধি আছে, সেই ভালো করবে কর্মক্ষেত্রে। তবে মেয়েদের একটু বেশি পরিশ্রম আর নিজেকে একটু বেশি করে প্রমাণ করতে হয়।’
লক্ষ্য স্থির রাখার কথা বলেন মালিহা। ‘ছোটবেলাতেই ঠিক করেছিলাম হার্ভার্ডে পড়ব। কম্পিউটার বিজ্ঞান কঠিন মনে হতো, কিন্তু গণিতে ভালো ছিলাম। তাই ওই বিষয়েও পড়লাম।’ আর এখন তো মালিহা কঠিন একটা খাত বেছে নিয়েছেন নিজের ব্যবসায়ের জন্য। এই খাতের ভোক্তাদের দিতে চাইছেন সহজ সমাধান। নিজের উদ্যোগকে আরও বড় করে তোলাই মালিহার এখনকার লক্ষ্য।