বইগুলো বক্স থেকে বের করে ধুলো ঝেড়ে বুক শেলফে তুলে রাখছিল সেমন্তি। নতুন বাসায় উঠে এসে এখন অবধি আর ফুরসত মেলেনি বইগুলো গোছাবার। এই হলের হাউস টিউটর কোয়ার্টার এ নতুন উঠেছে ওরা , ওরা বলতে ও আর সাদমান। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে তবে এই কোয়ার্টারটি মিলেছে। হলটি অনেক পুরনো, প্রচুর গাছ গাছালি আর তার চেয়েও প্রচুর আছে পাখি। খুব ভোরে পাখির কিচির মিচির শব্দে ঘুম ভাঙ্গে সেমন্তির, তখন এত ভালো লাগে ওর!
বইগুলো গুছিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায় ও। পুরনো একটা সাহিত্য ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে বেডরুমে ঢুকতে গিয়েও না ঢুকে বেরিয়ে পড়ল। সাদমান টক শো দেখছে বেডরুমের টিভিতে, এই সময় ওর হাতে ম্যাগাজিন দেখলেই খেপে যাবে, দরকার কি ঝামেলা বাড়িয়ে! কিন্তু এত সাবধানতা অবলম্বন করেও শেষ রক্ষা হলনা, দেখেই ফেলল সাদমান:
আবার ও ওসব ছাইপাশ নিয়ে বসেছ তুমি? শুধু শুধু এগুলো পড়ে কেন যে সময় নষ্ট কর, বুঝিনা! পড়াশুনার পাশাপাশি মুসলিম সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা কর, লেখালেখি কর! ইসলামী সাহিত্য, মুসলিম ঐতিহ্য , সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা, জ্ঞানার্জন তো করতেই হবে , কারণ এগুলোই ত আমার আত্মার তৃপ্তির রসদ জোগায়। কিন্তু সমকালীন সাহিত্য না পড়েও যে থাকতে পারিনা আমি! বাস্তবের যাপিত জীবনের অনুসঙ্গগুলো এত নিবিড় আর সুক্ষ্মভাবে এই সাহিত্যের প্রতিটি লাইনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে, যা আমাকে বর্তমান সমাজ ও জীবনবোধ নিয়ে ভাবনার খোরাক জোগায়। আর সাহিত্যের একজন ছাত্রী হিসেবে এটি নিশ্চয়ই আমার চিন্তাধারার কোনো গুরুতর ভুল হিসেবে নেবেনা তুমি!
( একটুখানি হেসে ) না, এটি কোনো ভুল বা অপরাধ কিছুই নয়। কোনো উপন্যাসে তুমি একবার ডুবে গেলে তোমার আর নাগাল পাওয়া যায়না, এজন্যই বলছিলাম!
বলতে বলতে সাদমান উঠে দাঁড়ালো, এগোলো দরজার দিকে।
একি, তুমি এখন আবার বেরোচ্ছ নাকি?
(জুতা পড়তে পড়তে) হ্যা, একটু ডিপার্টমেন্টে যাব, বেশ কিছু
এসাইনমেন্ট জমেছে, দেখে দিতে হবে খুব তাড়াতাড়ি … কেন, কিছু বলবে?
একটু দ্বিধা করলো সেমন্তি, এবারের পত্রিকার ঈদ সংখ্যাগুলো ভিন্ন স্বাদে, ভিন্ন বৈচিত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তারই একটা যে দারুন পছন্দ হয়েছে, তা কেমন করে এই ক্ষণে মুখ ফুটে বলবে ও!
কি হলো, বলবে কিছু? মনে হচ্ছে কিছু চাচ্ছ মনে মনে?
কিছু একটা চাচ্ছি, সেটা ঠিক। কিন্তু তোমার কাছে অনুমতি চাচ্ছি বলে ভেবোনা যে ওটি নিজে অর্জন করার যোগ্যতা আমার নেই। আমি এজন্যই চাচ্ছি যে, আমার প্রতিটি কাজে তোমার উতসাহ ও সমর্থন থাকলে প্রতিটি কাজ ও প্রতিটি প্রাপ্তিই আমার কাছে অন্যরকম আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে।
তো, কি এমন চাও যাতে আমার সমর্থন দরকার হয়ে পড়ল?
(একটু দ্বিধা করে) একটা ঈদসংখ্যা কিনব কিনা ভাবছি , না….না…কোনো জ্ঞান বিতরনমূলক কোনো কথা বোলোনা কিন্তু আবার! ….. কি হলো, অমন করে দুষ্টু হাসি হাসলে যে…!
সাদমান একটুখানি এগিয়ে এসে সেমন্তির নাকটা একটু নেড়ে দিল। দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার আগ মুহুর্তে মুখ ঘুরিয়ে একটু হেসে ছোট্ট করে বলল:
নো!
রাগে গা জ্বলে গেল সেমন্তির। এমন বদ স্বামী পৃথিবীতে আর কোনো মেয়ে পেয়েছে কিনা সন্দেহ! দরজাটা বন্ধ করে ফ্যান চালিয়ে সোফায় বসতে যাবে, এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠলো। তাড়াতাড়ি মুখে নেকাব জড়িয়ে দরজা খুলে দেখল হলের দারোয়ান রশিদ মিয়া দাড়িয়ে আছে। সালাম দিয়ে একটা ব্রাউন পেপার প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল:
আপা, স্যার যাওয়ার সময় এই প্যাকেটটা আপনাকে দিতে বলে গেছেন।
আচ্ছা, ঠিক আছে, অনেক শুকরিয়া।
অবাক হয়ে প্যাকেটখানি খুলতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একখানি নয়….দুখানি নয় ….তিনখানা ঈদ সংখ্যা! তাও আবার মোটা, ঢাউস সাইজের একেকটি ভলিউম! আলাদা করে একটি হাতে নিতেই গড়িয়ে পড়ল একটি চিরকুট, তাতে লেখা:
“পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি মেয়েটির জন্য তার ‘বদ জামাইয়ের’ পক্ষ থেকে ঈদের বিশেষ উপহার! কি, রাগ কি কমাতে পেরেছি একটুও?”
বিস্ময়ে, আনন্দে, অদ্ভুত এক ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল সেমন্তি। মনে মনেই এক ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাদমানের বুকে। মনে হলো কোথাও যেন সেতারে সংগীতের সব কটি রাগ রাগিনী এক সুরে বেজে উঠলো, পাখিরা গেয়ে উঠলো মিলনের গান। আর অজস্র ভালবাসা আর সুখের অনুভূতিরা নানা রঙের ফুল হয়ে ঝরে ঝরে পড়তে লাগলো মিষ্টি এই স্বপ্নালু দম্পতির উপর!
…