banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 965 বার পঠিত

 

একদিন তো চলে যাব, পরের ঘরনী হব -১


রেহনুমা বিনত আনিস


ছোটবেলায় টিভিতে একটা গান প্রায়ই শুনতে পেতামঃ
একদিন তো চলে যাব, পরের ঘরনী হব,
আঁচলে বাঁধতে পারবিনা।
ও মা তোর পায়ে পড়ি, দুষ্টুমী যদি করি,
কখনো মা তুই রাগ করিসনা, মা তুই রাগ করিসনা!
তখন গানটার মর্ম বুঝতাম না। মনে হত একটি মেয়ে মায়ের আঁচলের ছায়াতলে থেকেও মায়ের রাগের ভয়ে এত কাতর হবে কেন? মেয়েরা কেন এতটা আবেগপ্রবণ? ওরা কেন বোঝেনা এই আবেগ তাদের কতখানি দুর্বল করে ফেলে, ভীত করে রাখে?
এখন বয়স বেড়েছে, আজকাল প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অভিজ্ঞতার ঝুলিটার ভারও কিছুটা অনুভব করি। ইদানিং একটি সমস্যা প্রায়ই আমার কাছে আসছে যেটি নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে চায়না, লোকলজ্জার ভয়ে। অথচ লজ্জা যাদের পাওয়া উচিত তারা সমাজে ভদ্রলোক হিসাবে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান। এই সমস্যা দেশী বিদেশী, মুসলিম অমুসলিম, নামাজী বেনামাজী অনিয়মিত, বিবাহিত প্রাক্তন-বিবাহিত অবিবাহিত সকল শ্রেনীর মাঝেই দেখা যায়। সমস্যাটা মূলত মানবিকতার বিপর্যয়ের ফল। কিন্তু সমস্যাটা জাবাবদিহিতার অভাবের ফসলও বটে।
সময়ের পরিক্রমায় বাবামায়ের আদরে আহ্লাদে লালিত পালিত কন্যাটি এক সময় তাদের ছেড়ে ‘পরের’ ঘরনী হয়। হৃত স্বজনদের স্থলে ‘পর’কে আপন করে নেয়ার সংকল্প নিয়ে অগ্রসর হয়। অনেক সময়ই এই ‘পর’রা আপন হতে নারাজ থাকেন। কিন্তু যে মানুষটাকে কেন্দ্র করে এই প্রচেষ্টা, সে যখন মেয়েটিকে মূল্যায়ন করেনা, তাকে বোঝার চেষ্টা করেনা, এমনকি তাকে কষ্ট দিতেও কুণ্ঠিত হয়না তখন মেয়েটির আসলেই মনে হয়, ‘হে ধরণী, তুমি দ্বিধা হও, আমি তোমাতে প্রবেশ করি’।
যে সমস্যাগুলো কানে আসছে বা চোখে দেখেছি সেগুলো খুব মোটা দাগে নিম্নরূপ, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য আমি এখানে মূলত শিক্ষিত শ্রেণীর কথা বলছিঃ

১/ গালি

যে মেয়েটি স্ত্রী হয়ে আসে সে তো আর ফেরেস্তা নয়! মানুষ হিসেবে তার দোষত্রুটি রয়েছে, স্বামীর মেজাজ খারাপ হতেই পারে, সে অবস্থায় ধৈর্য্য হারিয়ে বকা দেয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু গালি দেয়া, যে গালি শুরুই হয় ‘বেশ্যা’ অর্থসূচক শব্দাবলী দিয়ে! যে মেয়েটি বাবামায়ের কাছে রাজকন্যার মর্যাদা পেয়ে বড় হয়েছে, পেয়েছে সর্বোচ্চ শিক্ষা এবং আদবকায়দার প্রশিক্ষণ, তার কাছে এই শব্দগুলো শোনা মৃত্যুর চাইতেও কঠিন যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন এই ধরণের শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে স্বামীরা কি ধরণের রুচিবোধের পরিচয় দিচ্ছেন? তারা মর্যাদা চান, কিন্তু মর্যাদা দিতে নারাজ। স্ত্রীকে হেয় প্রতিপন্ন করতে গিয়ে তারা নিজেরা যে স্ত্রীর দৃষ্টিতে নিজেদের কোথায় নামিয়ে নিচ্ছেন তা কি তারা ভেবে দেখেন না?

২/ অশালীন মন্তব্য

স্ত্রীর ওপর অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাকে এবং তার পরিবারকে নিয়ে নানারকম অশালীন মন্তব্যের মাধ্যমে। এর মধ্যে স্ত্রীর চেহারা সুরত, স্বভাব, আচরণ, চরিত্র, কর্মপদ্ধতি কোনকিছুরই সমালোচনা বাদ পড়েনা। সময় সময় এই সমালোচনা তার পরিবার পর্যন্ত গড়ায়। অধিকাংশ মেয়েরা এর প্রতিবাদ পর্যন্ত করার সাহস পায়না। কারণ তখন এর সাথে যোগ হবে প্রথম কিংবা তৃতীয় সমস্যাটি। একজন স্বামী যদি স্ত্রীর দোষত্রুটি উদ্ঘাটন করতে শুরু করেন, মানুষ হিসেবে তার পরিপূর্ণতার অভাবকে মেনে নিতে নারাজ হোন, এই কারণে মেয়েটির পরিবারকে দায়ী করেন তখন স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে – তিনি নিজে কি ত্রুটিমুক্ত, নিখুঁত? যে স্ত্রীকে তিনি ‘লিবাস’ হয়ে রক্ষা করার ওয়াদা দিয়ে বিয়ে করে এনেছেন, যে মেয়েটি তাকে বিশ্বাস করে নিজের ঘর ছেড়ে এসেছে, তাকে যখন স্বামী খোলা বাজারের পণ্যের মত সমালোচনা করেন তখন প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, তার ত্রুটিবিচ্যূতি বিশ্লেষণ করতে বসলে তার অবস্থান কোথায় পাওয়া যাবে?

৩/ গায় হাত উঠানো

যাকে মেয়েটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশ্বস্ত মনে করে বাবামা তাদের মমতার ছায়ায় বেড়ে ওঠা কন্যাকে অর্পন করেন, তাকে যখন রক্ষক নিজেই আক্রমন করে বসে তখন মেয়েটি কোথায় যাবে, কি করবে বলতে পারেন? বিশেষ করে শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরা এতটা মায়াময় পরিবেশে বড় হয় যেখানে বাবামা তাদের গায় ফুলের টোকাটিও লাগতে দেন না। সেখান থেকে এসে, যার জন্য আসা, তার কাছে এমন আচরণ পেয়ে মেয়েটির কাছে জীবন যে কি পরিমাণ বিষাক্ত মনে হয় বলাই বাহুল্য।

৪/  স্ত্রীর সুবিধা অসুবিধা না বোঝা

উপরোক্ত স্বামীরা সমাজে আশ্চর্যরকম শিক্ষিত, ভদ্র, শালীন, সামাজিক, সংবেদশীল, সাহায্যপরায়ন এবং অসংখ্য গুনের আধার হিসেবে পরিচিত। এদের মাঝে নারীজাতির প্রতি সম্মানবোধ এবং সহানুভূতি প্রবল। এমনকি সিনেমার নায়িকার কল্পিত দুঃখ দেখে তাদের দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে আসে। কিন্তু নিজের ঘরের রানী করে আনা মেয়েটির প্রতি তাদের সহানুভূতির অদ্ভুতরকম অভাব। যে মেয়েটি তার পরিবার পরিজন ফেলে এসে স্বামীর পরিবার পরিজনের পরিচর্যা করে, তার সংসার সাজায়, তার সন্তান ধারণ করে, তার সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করে, তার সন্তানদের প্রতিপালন করে, তার ক্লান্তি, অসুস্থতা, দুঃখ বেদনা কিছুই স্বামীটিকে স্পর্শ করেনা! তিনি যা পান তা নিজের অধিকার মনে করেন, তাতে কোন একদিন কিছু একটা ঘাটতি হলে অভিযোগ করেন, মেজাজ খারাপ হলে প্রথম তিনটির যেকোন একটি বা কয়েকটির অবতারণা ঘটে – অথচ তিনি কখনোই ভেবে দেখেন না তার কি পরিমাণ ত্রুটি বিচ্যুতি অভাব অভিযোগকে সঙ্গী করে মেয়েটি তার সাথে সংসার করে যাচ্ছে। প্রায়ই স্বামীরা অন্যের স্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকেন, সাথে নিজের স্ত্রীর সমালোচনা। অথচ সেই ভদ্রমহিলার স্বামীর কি অবস্থা তা তিনিই জানেন!

চলবে….

Facebook Comments