আফরোজা হাসান
মার সাথে রাস্তায় সিগন্যাল পার হচ্ছিলো ছয় বছর বয়সি বাচ্চাটা। হাতে ধরা ছিল দুটা বই। ছোট মানুষ তাই কৌতূহলী চোখে বিভিন্ন দিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটছিল। হঠাৎ হাত থেকে বইগুলো পরে গেলো। ঘাবড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির দিকে, আর অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকালো বাচ্চাটি। মা বাচ্চাটিকে উঠিয়ে হিড়হিড় করে টেনে রাস্তা পার করেই ধমকে বললেন, কত বার বলেছি তোমাকে রাস্তা পার হবার সময় সাবধানে চলতে। যদি গাড়ি চলা শুরু করতো? আর যদি কখনো এমন করো দেখো তোমাকে কি করি। বাচ্চাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মা’টি কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললেন, তাকিয়ে থাকতে হবে না, যাও হাঁটো।
কয়েকটি বাচ্চা মিলে ছুটোছুটি খেলছিল আর মায়েরা পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। খুব জোরে ছুটতে দেখে একজন মা বার বার তার ছেলেকে সাবধান করছিলেন। কিছুক্ষণ পর সেই ছেলেটিই পড়ে গেলো। মা ছুটে গিয়ে বাচ্চাকে টেনে উঠিয়ে গালে এক চড় দিয়ে বললেন, বলেছিলাম না তোমাকে এভাবে না ছুটতে? খুব ভালো হয়েছে। একদম উচিত শিক্ষা হয়েছে তোমার। আর কখনো হবে আমার অবাধ্য? বাচ্চাটির চোখ দিয়ে ঝরঝর অশ্রু নেমে এলো তখন।
উপরের ঘটনা দুটি আমার চোখে দেখা। ঘরে বাইরে সব জায়গাতেই শিশুরা এমন অনিচ্ছাকৃত ভুল বা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। কিছু কিছু বাবা-মার আচরণ তখন উপরের ঘটনার মতো হয়ে থাকে। যে সময় বুকে জড়িয়ে ধরে আশ্বস্ত করার দরকার, সেই সময় এমন নিষ্ঠুর আচরণ করা হয় বাচ্চাদের সাথে। আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করেছি পিঠাপিঠি ভাই-বোনরা কোনকিছু নিয়ে ঝগড়া বা মারামারি করলে বাবা-মা বেশির ভাগ সময় ছোটজনকে সাপোর্ট করেন। ভুল ছোটজনের থাকলেও বকা বড়জনকেই খেতে হয় বা মাফ বড়জনকেই চাইতে হয়।
এই সমস্ত ঘটনা বা আচরণ একটা শিশুর মনোজগতে কি ধরণের প্রভাব ফেলে তা আমরা চিন্তাও করে দেখি না। বাবা-মা যে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় এই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে বাচ্চাটা ধীরে ধীরে। যে কোন বিপদ, কষ্ট কিংবা ব্যর্থতায় বাবা-মার কাছে ছুটে আসতে পারে না কিংবা বলা যায় আসার সাহস পায় না। কারণ তার মনের আকাশে গুড়গুড় করে নিরাশার মেঘ। অনিচ্ছাকৃত অন্যায় বা ভুলের জন্য বাচ্চাদের সাথে কখনোই এমন আচরণ করা ঠিক না। এরফলে বাবা-মা আর বাচ্চাদের মধ্যে যে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়, পরবর্তিতে এই দেয়ালের কারণেই বাচ্চারা নিজেদের দোষ-ভুল ইত্যাদি গোপন করতে শেখে আর কমে যায় তাদেরকে সংশোধনের সুযোগ।
আমার ছেলেটা যখন এই ধরণের অনিচ্ছাকৃত ভুল বা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে, তখন ওর ভীত চোখের দিকে তাকালে আমি অনুভব করি ভয়-অপরাধবোধ সবকিছু মিলিয়ে সে বলতে পারছে না যে, আমাকে একটু বুকে টেনে নাও না মা…..!!! কিন্তু আমি তো মা তাই বুঝি, সব মায়েরাই বুঝতে পারেন। কারণ সৃষ্টিকর্তা এই ক্ষমতা দিয়ে দেন একটি মেয়েকে যখন সে মা হয়। নেতিবাচক পরিস্থিতি গুলোতে আমরা যেন আমাদের বাচ্চাদের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হতে পারি, কারণ তখনই একটি শিশুর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় মায়ের মমতার আশ্রয়ের।