banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1126 বার পঠিত

 

একটি শিশুর আর্তনাদ-১


আফরোজা হাসান


টেবিলে কিছু একটা রাখার শব্দ শুনে তন্দ্রা ছুটে গেলো অধরার। কফির মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে এসে লাগতেই চোখ খুলে তাকালো। ধূমায়িত কফি দেখেই শরীর ও মনকে জাপটে ধরে থাকা তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কিছুটা যেন শিথিল হয়ে এলো। মাথা তুলে তাকালো সহকর্মীর দিকে। কফি রেখে ততক্ষণে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে তার দিকেই হাসিমুখে তাকিয়ে আছে শাহরিন।

কফির জন্য এক লক্ষ শুকরিয়া। সেমিনার টক রেডি করতে গিয়ে সারারাত ঘুমাতে পারিনি। এখন ঘুমে মাথা সোজা করে রাখতে পারছিলাম না। হাসি মুখে বলল অধরা।

শাহরিন হেসে বলল, ‘একটি শিশুর আর্তনাদ’! তোমার বিষয় নির্বাচনটা ঠিক বুঝে আসছে না আমার।

এই আর্তনাদটা আসলে ছোট্ট কোন শিশুর আর্তনাদ নয়।

তাহলে?

আমাদের সবার মনের মাঝেই ছোট্ট একটা শিশু বাস করে সেটা তো জানোই। এই আর্তনাদ আসলে সেই শিশুর। অর্থাৎ, পরিণত মানুষের মনের মাঝে বসে থাকা সেই শিশু যে কোন না কোন ভাবে বঞ্চিত হয়েছে তার শৈশব থেকে। শৈশবের হাসি, আনন্দ, উল্লাস থেকে। যা কিনা প্রতিটি শিশুর অধিকার থাকে। একটু ভেবে দেখো একটা শিশুর চাহিদা কতটুকু থাকে? বাবা-মার সাথে আনন্দঘন সময় কাটানো, মাঝে মাঝে বেড়াতে যাওয়া, পছন্দের খেলনা, চকলেট, আইসক্রিম, কারণে অকারণে ছোট ছোট উপহার। এই তো তাই না? সবসময় বাবা-মার পক্ষে হয়তো এই চাহিদাগুলো পূরণ করা সম্ভব হয় না। সেই কারনটা যদি বাবা-মা বুঝিয়ে বলেন সন্তানদেরকে তাহলে ছোটবেলায় কষ্ট বা মনখারাপ করলেও, বড় হবার পর সেটা উপলব্ধি করতে পেরে স্বস্থি খুঁজে পায় মনে। কিন্তু বুঝিয়ে না বলার কারণে মনে তৈরি হয় গোপন কষ্ট ও অভিমান। যখনই বাবা-মার আদর ভালোবাসায় সিক্ত কাউকে দেখে তাদের মনে বেজে ওঠে হাহাকার ঘেরা আর্তনাদ।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে শাহরিন বলল, এমন আর্তনাদ তো আমার মনেও কিছুটা আছে। বাবার আদর কাকে বলে? বাবারা কি সন্তানকে আদর করে? কিভাবে করে? বুকে জড়িয়ে ধরে কখনো? কপালে কি আদর এঁকে দেয়? বাবা মাথায় হাত বুলালে কেমন লাগে? নাহ কিছুই জানি না আমি। এই ব্যাপারে কোন অভিজ্ঞতাই যে নেই আমার। নিজের শৈশব আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও এমন একটি মুহুর্ত আমি খুঁজে পাই না যেখানে বাবা আমাকে আদর করেছেন। আমাকে কোন উপহার দিয়েছেন, কোথাও বেড়াতে নিয়ে গিয়েছেন। কারণ বাবার ছেলের শখ ছিল। কিন্তু আমি মেয়ে। তাও আবার পাঁচ নাম্বার মেয়ে।

সদা হাসিখুশি, প্রাণবন্ত সহকর্মীর মুখ থেকে কথাগুলো শোনার পর কিছুটা থমকে গেলো অধরা। বলার মত কোন শব্দই খুঁজে পেলো না। শুধু মনেহলো ‘জীবন কারো তরেই নয় সাজানো ফুল বাগান! নিজ নিজ পরীক্ষায় সবাইকে হতে হয় পেরেশান! ছোট ছোট দুঃখ-সুখে ঘেরা প্রতিটি মনের ভুবন! আনন্দ-হাসি উল্লাসের ভিড়ে লুকানো থাকে অদেখা কন্দন!’ তাই হয়তো মনের কোণে জমানো কষ্ট নিয়েও অন্যের মনের ক্ষতগুলোতে সহমর্মীতার পরশ বুলিয়ে যেতে চেষ্টা করে শাহরিন।

অনেকটা ক্ষণ নীরবতার পর শাহরিন বলল, সত্যি অনেক দরকারি একটা বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছো তুমি। আমারো মনেহয় যে বাবা-মাকে মানসিকভাবে কাছে পেলে জীবনের অপ্রাপ্তি গুলোও অনেক সহজে মেনে নেয়া সম্ভব হয়। কিন্তু বাবা-মার সাথে মানসিক দুরুত্ব জীবনের প্রাপ্তিগুলোকেও ফিকে করে দেয়।

একদম ঠিক বলেছো। আমার যেমন সবসময় আপ্রাণ চেষ্টা থাকে আমার সন্তানদের মানসিক ও আত্মিক বিকাশের ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখার। শারিরীক যে কোন সমস্যা চোখে দেখা যায় কিন্তু মানসিক অবস্থা দেখা যায় না বলেই বেশি সতর্ক থাকার প্রয়োজন হয় বেশি। যেমনটা বলা হয় যে, শিশুদের মন কাদা মাটির মত, পানির মত, মোমের মত ইত্যাদি। অর্থাৎ, যে পাত্রে রাখা হবে শিশুরা সেটারই আকার ধারণ করবে। কিংবা এভাবেও বলা যায় যেমন খুশি তেমন আকারে গড়া সম্ভব শিশুদেরকে। তাই সতর্ক থাকি কোন ভাবেই যাতে আমার কোন ভুলের কারণে ব্যহত না হয় সন্তানদের সঠিক আকার গঠন। কিন্তু নানান ধরণের ব্যস্ততার কারণে মাঝে মাঝে খেয়াল করতে পারি না ছোট ছোট অনেক বিষয়। তাই বাচ্চাদের সাথে যাতে কোন রকমের দুরুত্ব তৈরি হয়ে না যায় সেজন্য আমি ডায়েরি বেছে নিয়েছি। মানে হচ্ছে ওদেরকে একটা ডায়েরি কিনে দিয়েছি শুধু সেইসব কথা লেখার জন্য যা বলতে চেয়েও নানা কারণে আমাকে বলতে পারে না সময়, সুযোগ বা পরিস্থিতির কারণে।

শাহরিন হেসে বলল, বাহ বেশ মজার তো!

অধরাও হেসে বলল, হুম! এই পদ্ধতিটার উদ্ভাবক আমার ছোট পুত্র। ওর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন একদিন একটা কারণে একটু বিরক্ত হয়েছিলাম ওর উপরে। দুষ্টুমির জন্য একটু বকে দিয়ে আমি রান্নাঘরে চলে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি সে তার হোয়াইট বোর্ডটা ঠেলতে ঠেলতে রান্নাঘরে নিয়ে আসছে। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বোর্ডটা ঢুকিয়ে দিয়েই চলে গেলো। আমি কাছে গিয়ে দেখলাম বোর্ডে যে তার মনের অভিমানী শব্দমালা লিখেছে ছবি আর শব্দের সংমিশ্রণে। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়েছিল আমার তখন। মনে হয়েছিল বকে দেবার আগে উচিত ছিল দুষ্টুমি করাটা কেন ঠিক হয়নি সেটা বুঝিয়ে বলা। এবং ওকেও নিজের পক্ষে কথা বলতে দেয়া। বেশ কয়েকদিন আগে যেমন একটা ডকুমেন্টরি দেখছিলাম আমি জমজ বাচ্চাদের উপরে। একে অন্যের সাথে জোড়া লাগানো জমজ বাচ্চাদের ছবি দেখে আমার মেয়ে বলল, মামণি কতই না ভালো হতো যদি তুমি আর আমি এমন হতাম। তাহলে তুমি সারাক্ষণ আমার সাথে সাথে থাকতে। ব্যস্ততার সময়ও আমাকে তোমার সাথে রাখতেই হতো। ঐ মুহুর্তে হাসলেও পরে আমি এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছি মেয়ের সাথে। ওকে বুঝিয়ে বলেছি আমার ব্যস্ততার কারণ এবং এরপর থেকে চেষ্টা করি আরো কিছুটা সময় বেশি কাটাতে বাচ্চাদের সাথে।

কেন পৃথিবীর সব বাবা-মায়েরা এমন হয় না বলো তো অধরা? কেন সন্তান জন্ম দেয়া আর ভরণ পোষণেই সীমাবদ্ধ থাকে বাবা-মার চিন্তা ভাবনা। খুব খুব কষ্ট হয় যখন পেশেন্টরা বাবা-মা আর পরিবারের সদস্যদেরকে ঘিরে তার মনের মধ্যে জমে থাকা অভিমানী কথাগুলো বলে অশ্রু ভেজা চোখে। মনে পড়ে যায় নিজের অপ্রাপ্তি আর নিরানন্দে ঘেরা এলোমেলো শৈশবের কথা। তুমি ঠিক বলেছো যখনই বাবা-মার আদর ভালোবাসায় সিক্ত কাউকে দেখি আমার মনে বসে থাকা শিশুটা আর্তনাদ করে উঠে। যখন আমার হাজবেন্ডকে দেখি আমাদের মেয়েকে আদর করতে, ভালোবাসতে। অনুভব করি নিজের জীবনে বাবার আদর-ভালোবাসার অভাব।

আমার দেখা অনেক মানুষের ভেতর থেকেই এই আর্তনাদটা শুনতে পেয়েছি আমি। সেজন্যই এই বিষয়টাকেই বেছে নিয়েছি আমি।

আর কিছু না বলে চুপচাপ নিজের কাজে মনযোগ দিলো শাহরিন। অধরা বুঝতে পারছে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ও কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে বলেই শাহরিন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। নিজের ভেতরটাও ভারী হয়ে এলো অধরার।এমন নিরাশার আঁধার কালো পর্দা টেনে নিশ্চুপ বসে থাকা মনগুলোকে যখন দেখে ইচ্ছে করে বিজলীর মতো প্রচন্ড গর্জন করে চারিদিক আলোকিত করে ঝলসে উঠতে। হতাশার ঘোর অমানিশা ছিন্ন ভিন্ন করে ভঙ্গ করে দিতে নিস্তব্ধতা। ধূ ধূ মরুভূমির মত ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া ধূলো ধূসরিত পিপাসাক্ত হৃদয়গুলোতে ঝরঝর শ্রাবণও ধারা হয়ে ঝরে যেতে ইচ্ছে করে যে পর্যন্ত না মিটে যায় শুষ্কতার ছাপ। ঘুণপোকার কুড়ে কুড়ে খাওয়া ক্ষতে বুলিয়ে যেতে ইচ্ছে করে আশা জাগানিয়া পরশ।

Facebook Comments