৪দিন আগেও যে মানুষটির সরব পদচারণায় মুখর ছিলো হাসপাতাল,বাড়ির আঙ্গিনা,আজ সে মানুষটির হাসিমুখ কেবলই ছবি হয়ে থাকে দেয়ালে টাকানো ফ্রেমে! নিষ্ঠুর বাস্তবতার কাছে হার মেনে হারিয়ে গিয়েছে আগামীর স্বনামধন্য ডাক্তার,মা হারানো বাবার আদরের একমাত্র মেয়ে,ভাইয়ের কাছের বন্ধু প্রিয় বোন,হাসপাতালের আঙ্গিনার হাস্যজ্জ্বল মুখ ডা.শামারুখ মাহজাবিন সুমি।
গত ১৩ই নভেম্বর দুপুরে শ্বশুড়বাড়ির বাথরুমের গ্রিলে ঝুলানো সুমীর দেহ উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে,কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষনা করেন। কিন্তু এটা কি কোন আত্নহত্যা ছিলো?আদৌ কি সুমী নিজ গলায় ফাঁসি নিয়ে নিজের জীবন শেষ করেছিলেন? নাকি কোন এক ভয়ানক সত্য জেনে ফেলার নিষ্ঠুর শাস্তি দেয়া হয়েছিলো তাকে? নাকি সত্য প্রকাশ করে দেবার ভয়েই নির্মম ভাবে খুন করা হয়েছিলো সুমীকে? প্রশ্ন গুলো কোন ভাবেই অযৌক্তিক না,বরং এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়াই এখন সময়ের দাবী।
কেন এভাবে চলে যতে হলো একজন প্রতিভাবান ডাক্তার কে?কেন বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই লাশ হতে হলো একজন গৃহবধু কে? আর কেন ই বা তার মৃত্যুর কারণ গুলো অনুসন্ধান করতে যেয়ে কর্তৃপক্ষ কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোবার ভয় করছে?
ডা শামারুখ মাহজাবীন যশোরের পুরাতন কসবা এলাকার প্রকৌশলী নূরুল ইসলামের মেয়ে। রাজধানীর হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন,মৃত্যুর আগে সদ্য ইন্টার্নী শেষ করে,এফসিপিএস ডিগ্রী নেয়ার জন্য পড়াশুনা শুরু করেছিলেন। সুমী তার মেডিকেল কলেজের ডিবেট ক্লাবের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। ন্যাশনাল ডিবেট ফাউন্ডেশনের কো-অর্ডিনেটর হিসেবেও কাজ করেছেন। শালীন ও ভদ্র ব্যবহারের জন্য পুরো কলেজে সুনাম ছিল তার। সুমীর মেধা আর ব্যবহার দৃষ্টি আকর্ষন করেছিলো তারই কলেজের শিক্ষিকা ডা জেসমিন আরা ম্যাডামের। ডা জেসমিন আরা যশোরের-৫ আসনের সাবেক এমপি টিপু সুলতান সাহেবের স্ত্রী। ডা জেসমিন আরা সুমী কে তার ছেলে হুমায়ন সুলতান সাদাব এর জন্য বউ করে আনেন। উচ্চ শিক্ষিত,প্রভাবশালী পরিবারের ব্যারিষ্টার ছেলের কাছে একমাত্র মেয়েকে অনেক আশা আর নির্ভরতার সাথেই বিয়ে দিয়েছেল নুরুল ইসলাম সাহেব। কিন্তু কে জানতো,এতো সব ভালো পরিচয়ের আড়ালে রয়েছে এদের কি নিষ্ঠুর আর ভয়ানক পরিচয়!!
বিয়ের পর সুমীর পরিবার জানতে পারে,হুমায়ন সুলতান কোন ব্যারিষ্টার নন,তিনি ঢাকার একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে ল’পাশ করেছেন মাত্র!এবং তিনি পুরোদস্তর একজন মাদকাসক্ত! সব কিছু জানার পরেও সুমী আপ্রান চেষ্টা করছিলো স্বামীকে মাদকের পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য,একটা সুন্দর সংসার সাজানোর জন্য কিন্তু গাছের গোড়াতেই যখন গলদ তখন আগাছা ছেঁটে কি আর ফল পাওয়া যায়?
আর তাই নির্মম ভাবে হারিয়ে গেলেন সুমী!বিয়ের পর থেকেই শুরু হয়েছিলো সুমীর নরক বাস! দুর্নীতিবাজ শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি আর মাদকাসক্ত স্বামীর অত্যাচারে জীবন অতিষ্ট হয়েছিলো শামারুখের!পড়াশুনা করতে বাঁধা দেয়া থেকে শুরু করে কাজের মেয়ের মতো খাঁটুনী করিয়েও স্বস্তি পেতেন না তারা,আর তাই চলতো মানুষিকের পাশাপাশি শারিরিক অত্যাচারও! বাবার কাছে ফোন করে প্রায়ই কান্নাকাটি করত মা-হারা ডা. শামারুখ মাহজাবীন সুমী। মৃত্যুর আগের দিনও ফোনে বাবা নুরুল ইসলামকে বলেছিলেন, আব্বু, এটা আমার শ্বশুর বাড়ি নয় টর্চার সেল, তোমরা ঢাকায় চলে আসো। আমাকে টর্চার সেল থেকে নিয়ে যাও। আমি তোমাদের কাছে থেকে এফসিপিএস করব।
ডা. শামারুখ তার বাবাকে বলতেন, তারা (শ্বশুরবাড়ির লোকজন) আমাকে বাসায় চাকরানীর মতো সব কাজ করায়। সকালে নাস্তা বানানো, দুপুর ও রাতের খাবার সব রান্না করায়। পান থেকে চুন খসলেই গালিগালাজ আর চড়-থাপ্পড় দেয়।
শামারুখের বাবা প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম বলেন, এসব শোনার পরও মানসম্মান আর লোকলজ্জার ভয়ে সব মুখ বুঝে সহ্য করে যাওয়ার পরামর্শ দিতাম। কিন্তু সেই মুখ বুঝে থাকার পরিণতি এত ভয়াবহ হবে সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি। শ্বশুরবাড়িতে প্রায়ই নির্যাতন করত শামারুখের স্বামী হুমায়ুন সুলতান সাদাব, শ্বশুর খান টিপু সুলতান ও শাশুড়ি ডা. জেসমিন আরা। সব নির্যাতন মুখ বুঝে সহ্য করত শামারুখ। সম্প্রতি নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় তা আর নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারছিল না। তখন আমাকে জানায়, তার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে। শ্বশুরবাড়ি তার জন্য টর্চার সেল-এ পরিণত হয়েছে।
বাবা নুরুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, আমি যদি আমার মেয়েকে নিয়ে আসতাম, তাহলে তাকে আজ এই নির্মম ঘটনার শিকার হতে হতো না।
এমন অনেক আফসোস ই আজ চারপাশে সবার মুখে মুখে! এখনো পর্যন্ত শামারুখের শ্বশুড়-শ্বাশুরি কে গ্রেফতার করা হয়নি,কারন তারা অনেক শক্তিশালী!লোক দেখানোর জন্য স্বামীকে গ্রেফতার করা হলেও মামলায় নেই কোন অগ্রগতি
শামারুখের মৃত্যুর কারণ উদঘাটন করতে যেয়ে জানা যায়,ক্ষমতাশীল শ্বশুড় টিপু সুলতানের গোপন দুর্নীতির তথ্য জেনে ফেলাটাই কাল হয়েছিলো,শামারুখ যাতে সে সব তথ্য বাইরে ফাঁস করে দিতে না পারে,সে কারণেই মেরে ফেলা হয় তাকে! সুমীর বাবা নুরুল ইসলাম জানান, যে দিন সুমিকে হত্যা করা হয় সে দিন তার সাথে ফোনে ৩৫ মিনিট তার কথা হয়। ওই সময় মেয়ে তাকে জানায়, বাসার কাগজপত্রের মাঝে খান টিপু সুলতানের দুর্নীতিসংক্রান্ত কিছু তথ্য-উপাত্ত সুমি দেখে ফেলে। এর পর থেকে তার ওপর অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে। সুমি ফোনে কাঁদতে কাঁদতে বারবার বাবাকে অনুরোধ করেন তাকে দ্রুত সেখান থেকে না সরালে ওরা তাকে মেরে ফেলবে। সুমির আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্য হয়েছে।
নুরুল ইসলাম আরো জানান, একজন সাবেক সংসদ সদস্য ও আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও খান টিপু সুলতান যে কত নিচু প্রকৃতির মানুষ তা সুমির বিয়ের পর তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তিনি বিয়ের পর মেয়েকে ১২ ভরি সোনার অলঙ্কার দিয়েছেন। এই সোনাকে টিপু সুলতান পিতল বলে আখ্যায়িত করতে দ্বিধা করেননি।সম্প্রতি সুমির স্বামী হুমায়ুন সুলতান সাদাব নুরুল ইসলামকে জানান, তারা নতুন ফ্যাটে উঠবেন, এ জন্য ফার্নিচার দিতে হবে। নুরুল ইসলাম বিয়ের পর মেয়ে-জামাইয়ের জন্য ফার্নিচার তৈরি করেছিলেন। সেই ফার্নিচার নিয়ে যাওয়ার কথা বললে টিপু সুলতান ক্ষেপে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন। তিনি ফোনে নুরুল ইসলামকে বলেন, নতুন ফ্যাটের জন্য নতুন ফার্নিচার দিতে হবে। আর নিজের দোষ ঢাকতে সুমিকে শাসিয়ে বলে দেন তার বাবার কাছে বলতে হবে সেই (সুমি) নতুন ফার্নিচার দাবি করেছে। মেয়ের সুখের কথা ভেবে নিরুপায় হয়ে তিনি নতুন ফার্নিচার তৈরি করে দেন। যার চার হাজার টাকা এখনো দোকানে বাকি রয়েছে। অল্প কিছু দিন হলো এক লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে ফ্রিজও কিনে দিয়েছেন বলে নুরুল ইসলাম জানান।
ডা শামারুখের মৃত্যু অনেক গুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেছে,চোখে আঙ্গুল দিয়ে আরেকবার দেখিয়ে দিয়ে গেলো,আমাদের সমাজে নারীর অসহায় অবস্থানের কথা! শিক্ষিত-অশিক্ষিত ভেদে আজো নারীর অবস্থান কতোটা অমানুষিক পর্যায়ে রয়েছে তা আরেকটা বার আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে!
হয়তো ক্ষমতা-টাকার দাপটে শামারুখের স্বামী-শ্বশুড়বাড়ির লোকেরা পার পেয়ে যাবে,যুগের পর যুগ কেঁদে যাবে শামারুখের আত্না,কিন্তু আমাদের সমাজ কি বন্ধ করতে পারবে জীবিত শামারুখদের কান্না? পারবে কি সমাজের অসহায় সেই বাবা-মায়েদের বুকের জ্বালা কমাতে? আজো অনেক আশা নিয়ে বাব-মায়েরা মেয়েকে শ্বশুড়বাড়ি পাঠান,মেয়ের ঝুলন্ত লাশ দেখার জন্যে নয়,কিন্তু যে সমাজে টিপু সুলতান-জেসমিন আরাদের মতো শ্বশুড়-শ্বাশুড়িদের নামে নরপশুদের বাস সেখানে কি করে থামবে সুমীদের বাবাদের আর্তনাদ?
আমরা বিচার চাই ডা সুমীর হত্যাকারীদের,এবং আমরা পরিবর্তন চাই এই সমাজের।