banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1453 বার পঠিত

 

‘একটি আদর্শ প্রি-স্কুল, নারীই মূল চালিকাশক্তি’

তাহেরা সুলতানা


কোন স্কুল যদি বাচ্চার মানসিক এবং শারীরিক দুই সেক্টর বিকাশে সহায়ক হয়, আর শিক্ষক যদি হন মায়ের মতো, তাহলে কি কোন বাবা-মায়ের চিন্তা থাকে? নিশ্চয় নয়। মালয়েশিয়াতে বাচ্চাদের স্কুলগুলোতে পুরুষ শিক্ষক নেই বললেই চলে। আমি মূলত প্রি-স্কুলের কথা বলছি। আমার ছেলে এখানকার খুব নরমাল একটা স্কুলে পড়ে। অনেকটা সরকারি স্কুলের মতই, কিন্তু ইসলামিক স্কুল। তবে এ রকম অমুসলিম স্কুলগুলোতেও ব্যাসিক নিয়ম এক। আমি উল্লেখযোগ্য কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি, যা আমাদের দেশের নামি-দামি স্কুলগুলোতেও অনুপস্থিত।

১। এখানে বাচ্চাদের স্কুলে ঢুকানোর পরপরই ১৫-২০ মিনিটের জন্য খেলতে দেয়া হয়, এরপর এসেম্বলি হয়, নাস্তা দেয়া হয়। বাসা থেকে স্কুলে খাবার আনা একদম নিষেধ। আর যদি কেউ আনতে চায়, পুরো ক্লাসের জন্য আনতে হবে। স্কুলের খাবার অত্যন্ত ভালো আর এক সপ্তাহের মধ্যে একই খাবার রিপিট করা হয় না। যারা সারাদিন থাকে, তাদের লাঞ্চও দেয়া হয়। এর জন্য এডমিশন এর সময় খুব সামান্য পরিমাণ টাকা নিয়ে নেয়। নাস্তার পর ক্লাস শুরু হয়। আর ক্লাস বলতে অইভাবে পড়াশুনা না, ছবি আঁকা, কিছু বানানো, এর মাঝে টুকটাক পড়াশুনা। হাতে কলমে শিক্ষার দিকেই এরা বেশি জোড় দেয়। ৪-৭ বছর বয়সী সব বাচ্চার জন্য একই নিয়ম। আর এখানে বাসায় বই আনা অথবা বাসা থেকে বই বা অন্য কিছু নেয়াও নিষেধ।
২। মেডিকেল ইন্সুরেন্স কার্ড স্কুল থেকেই বিনা খরচে করে দেয়।
৩। প্রতিদিন নাস্তার করানোর পর ৫ বছর থেকে সব বাচ্চাদের নিয়ে শিক্ষিকারা ‘সালাতুল দুহা’ পড়েন।
৪। বাচ্চাদের সব কাজ শিক্ষিকারা নিজ হাতে করেন। কোন আয়া এখানে নিয়োগপ্রাপ্ত নেই। তবে প্রায় সব বাচ্চাই নিজের কাজ নিজে করতে শিখে যায়। কারন এভাবেই তাদের গাইড করা হয়।
৫। মালয়েশিয়ান স্কুল হলেও ৭০% কনভারসেশন এবং পড়াশুনা ইংরেজিতে হয়, আর ৩০% বাহাসা মালয় ভাষায় হয়। আর ফরেন বাচ্চাদের ক্লাসেই ভালোভাবে মালয় ভাষা শেখানো হয়।
৬। টিচার-স্টুডেন্ট র‍্যাশিও ১:২০ এর বেশি নয়। আমি এখানে যে ক্যাটাগরির স্কুলের উদাহরণ দিলাম, এটা সবচেয়ে কম খরচের স্কুল। কিন্তু এদের সার্ভিস আমাদের দেশের খুব নামকরা স্কুলের চেয়ে বেশি। দেশে অনেকদিন শিক্ষকতা পেশায় থাকার কারনে বাস্তবচিত্র নিজের চোখেই দেখার সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য দুটোই হয়েছে।
৭। এখানকার সরকারি, বেসরকারি এবং প্রাইভেট সব স্কুলগুলোতেই কোন বাচ্চার বাবা-মা কত ধনী, সেইটা কখনওই বিচার করা হয় না। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ স্কুলে বাচ্চাদের জন্মদিন উৎযাপনের পদ্ধতি। একটি মাসে যতগুলো বাচ্চার জন্মদিন পড়ে, সবার একসাথে একটি দিনে উৎযাপন করা হয়। অভিভাবকদের আগের থেকেই জানিয়ে দেয়া হয়, তারা চাইলে কেকসহ অন্যান্য খাবার বাচ্চার জন্য সরবরাহ করতে পারেন এবং বাচ্চার সাথে থেকে আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। এই প্রোগ্রামের আর একটি উদেশ্য হলো, সবার সাথে আলাদা করে পরিচিতি, যাতে সব বাচ্চাই নিজেদের চিনে এবং জানে। এক বছরে ১২ টি মাসে যদি এভাবে জন্মদিন পালন করা হয়, তাহলে কেউ আর কারো কাছেই অচেনা থাকবে না, বন্ধুত্ব আর ভালোবাসায় স্কুল প্রাজ্ঞন ভরে উঠবে, সবার মধ্যে খুব ভালোভাবে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরী হবে। আর বাচ্চাদের যদি জড়তা থাকে, সেটাও আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়।
৮। কোন দেশের কোন সাধারণ প্রি-স্কুলের পক্ষ থেকে যদি বাচ্চার সাথে সাথে বাবা-মাকেও গাইড করা হয়, সে দেশের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন জায়গাই কিন্তু থাকেনা। কিভাবে বাচ্চাকে ভাষা চর্চা করাতে হবে, কিভাবে পড়ার দক্ষতা বাড়াতে হবে, নতুন ভাষার সাথে বাচ্চাকে কি করে অতি সহজে পরিচিত করানো যাবে, কিভাবে একটি বাচ্চা একই সাথে ২/৩ টি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারবে, এই সবকিছু এই ট্রেইনিং গুলোর বৈশিষ্ঠ্য। বাচ্চা যাতে শিক্ষক আর বাবা-মায়ের শিখানোর মধ্যে সমতা খুঁজে পায়, এটাই এই ট্রেইনিং এর প্রধান উদ্দেশ্য।
৯। প্রতি মাসেই প্রতিটা বাচ্চাকে ক্লাসে ইংরেজিতে কোন না কোন বিষয়ের উপর উপস্থিত বক্তৃতা দিতে হয়। এটি হতে পারে কোন একটা খেলনা গাড়ী নিয়ে, কিংবা কোন ছবি নিয়ে অথবা কোন প্রিয় খাবার নিয়ে। এতে করে একটা বাচ্চা কেবল একজন ভালো স্পিকারই হয়ে উঠে না, তেমনি কথা বলার জড়তাও কাটিয়ে উঠতে পারে।
১০। স্কুলে বাচ্চাদের আলাদা করে কোন পরীক্ষা নেয়ার কোন সিস্টেম নেই। সারাবছর ধরেই এ্যাসেসমেন্ট চলতে থাকে। প্রতি সেমিস্টারে রেজাল্ট কার্ডে তার প্রতিফলন দেখা যায় এবং বাচ্চার সর্বনিম্ন এ্যাসেসমেন্ট হচ্ছে ‘সন্তোষজনক’।
১১। যেকোন ধরনের প্রতিযোগিতা বা খেলাধুলায় শিক্ষকরা সব বাচ্চাদের ১০০% অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন এবং সবার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকে। এখানে হার জিতের থেকে অংশ গ্রহণটাকেই বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়, যাতে একটা বাচ্চার মনের উপর কোন নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।

আমরা চাইলেই কিন্তু আমাদের দেশের স্কুলগুলোতেও বাচ্চাদের জন্য এরকম ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে পারি। আর যারা নিজেরাই স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছেন, তারাও কিন্তু এরকম একটা স্কুলের খসড়া এঁকে ফেলতে পারেন। আমাদের সবার ইচ্ছা, উদ্যোগ আর সাহসই কিন্তু আমাদের দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট! এর জন্য সত্যিই অনেক টাকার প্রয়োজন নেই!

Facebook Comments