banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 856 বার পঠিত

 

একটি ‘অচল’ আইনে তনুর ময়নাতদন্ত চাই!

সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে যা ঘটেছে, তা আমাদের দেশে বহুক্ষেত্রেই ঘটে থাকে, এমনকি এর চেয়েও অভাবনীয় অনিয়ম ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু গণমাধ্যমে হইচই হওয়া কিছু ঘটনা ছাড়া অটোপসি বা ময়নাতদন্ত এবং হত্যা মামলার বিচারে তার কার্যকারিতা নিয়ে সমাজে তর্ক-বিতর্ক খুবই কম বা নেই বললেই চলে। তনু হত্যাকাণ্ডের দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের সঙ্গে কোনো একজন ‘জুনিয়র’ চিকিৎসকের করা প্রথম ময়নাতদন্তের বড় অসংগতি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর পড়ে জানতে ইচ্ছে হলো এ-সংক্রান্ত আইনকানুন কী বলে। কখনো তো এটা শুনি না যে অমুক হত্যা বা ধর্ষণের ঘটনার ময়নাতদন্তে অমুক আইন বা কোনো বিধিবিধান বা নীতিমালার কোনো লঙ্ঘন ঘটেছে। অনুসন্ধানে পাওয়া ফলাফলে স্তব্ধ হওয়ার দশা। আমাদের কোনো আইন নেই। অপরাধ, ফরেনসিক মেডিসিন ও বিচারজগতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা কখনো ময়নাতদন্ত আইন থাকা না-থাকা নিয়ে কখনো প্রশ্ন তুলেছেন বলে মনে পড়ে না।
আইন খুঁজতে গিয়ে পেয়ে যাই অবাক করা ২০০৭ সালের দিল্লি হাইকোর্টের একটি রায়। আর জানতে পারি বাংলাদেশে কখনোই প্রয়োগ না করা ১৮৭১ সালের করোনার্স অ্যাক্টের কথা। করোনার অর্থ হলো অপঘাতজনিত বা সন্দেহজনক মৃত্যুর কারণ তদন্তকারী বিচারক। ওই আইনটি এখনই প্রয়োগ করলে আমরা দেশে করোনার নিয়োগ করতে পারি। তখন আর কোনো হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধানের মর্জিনির্ভর কোনো ‘জুনিয়র’ চিকিৎসক দিয়ে যেনতেন প্রকারে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট করানোর সুযোগ থাকবে না। ওই আইনের ১২ ধারা যদি কার্যকর হতো, তাহলে তনুর লাশ উদ্ধারের পর করোনারকে ডাকা হতো। করোনার তখন অনধিক ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিককে ডাকতেন। তাঁরা হতেন জুরি। তনু কোন প্রেক্ষাপটে কখন নিহত হলেন, সে বিষয়ে যেকোনো এক রোববার শুনানি হতো। প্রথম শুনানির দিনেই করোনার জুরিদের উপস্থিতিতে তনুর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করতেন। এরপর করোনার সাক্ষ্যদের নাম ঘোষণা করতেন। তাঁদের শপথ নিতে হতো। ১৮ ধারা অনুযায়ী ময়নাতদন্তকালে রাসায়নিক বিশেষজ্ঞেরও ডাক পড়ত। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী করোনার একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে গণ্য হতেন। এই আইন মানা হলে ‘জুনিয়র’ চিকিৎসককে তনুর মাথার জখম ও আঁচড়ের দাগ উল্লেখ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকত না। আইনের সব শর্ত পূরণ ছাড়া তনুর লাশ দাফনের ওয়ারেন্ট জারি করাই সম্ভব হতো না।
এই আইনের গুরুত্ব অপরিসীম, বিশেষ করে যদি আমরা নিহতদের প্রতি কোনো দায় স্বীকার করি। এই সরকারের প্রথম ভাগে বছরে খুনের ঘটনা ঘটত তিন হাজার, এখন আমরা বছরে চার হাজার হত্যাকাণ্ডের দেশে পরিণত হয়েছি। এর দ্রুত বিচার দূরে থাক, যেসব পরিবার স্বজন হারায়, তাদের কত শতাংশ নিহত হওয়ার প্রকৃত কারণটা জানতে পারে, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন। তনুর মৃত্যু সারা দেশে আলোড়ন তুলেছে, সর্বস্তরের মানুষের মানবিক অনুভূতিকে আঘাত দিয়েছে। তনুর ময়নাতদন্ত নিয়ে যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটল, তার যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। সেই লক্ষ্যে কোনো উপযুক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ১৮৭১ সালের আইন বা তার আদলে করা নতুন কোনো আইন দ্রুত বাস্তবায়নের আবেদন জানাব।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত পাঁচ মাসের একটি শিশু ইংল্যান্ডে মারা গিয়েছিল। সেখানে দুবার ময়নাতদন্ত হয়। প্রথমটি করেছেন করোনার। দ্বিতীয়টি করেছে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক মেডিসিন অ্যান্ড সায়েন্স বিভাগ। কিন্তু মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুদ্ঘাটিত থাকে। বাবা-মা সন্তুষ্ট হন না, তাঁরা ‘মেডিকেল নেগলিজেন্স’ সন্দেহ করেন, কিন্তু প্রমাণ করতে বিফল থাকেন। এরপর নিরুপায় হয়ে তাঁরা মৃত্যুর সাত বছর পরে ২০০৭ সালে শিশুটির লাশ ভারতে আনেন। আর তখন তাঁরা শিশুটির ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নিলে আইন কী বলে, সেই প্রশ্ন ওঠে। সোশ্যাল জুরিস্ট নামে একটি সংগঠন দিল্লি হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিট করে। আদালত তাঁর রায়ে মন্তব্য করেন যে ইংল্যান্ডের ১৯৮৮ সালের করোনার্স অ্যাক্ট, যা দ্বারা ময়নাতদন্ত নিয়ন্ত্রিত হয়, তার সঙ্গে তুলনা করা চলে এমন কোনো আইন ভারতের নেই। অতঃপর তাঁরা ১৯৮৮ সালের ইংল্যান্ডের (ইতিমধ্যে সেখানে ২০০৯ সালের নতুন আইন এসেছে) ময়নাতদন্ত আইনের অনুরূপ একটি আইন করার সুপারিশ রেখে বিষয়টি আইন কমিশনে পাঠান।
এখানে উল্লেখ্য, ভারতীয় ময়নাতদন্ত করোনার আইন দিয়ে না চললেও তাদের সুপ্রিম কোর্ট গাইডলাইন করে দিয়েছে। একটি পোস্টমর্টেম কিট কেবল একটি লাশে ব্যবহার, অচিহ্নিত লাশের বাধ্যতামূলক ভিডিওগ্রাফি, ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ২০ মিলিলিটার রক্ত, ১০০ গ্রাম মাংস, একটি সম্পূর্ণ হাড়, চুল বা নখ রাখতে হবে। ভিসেরায় ব্যবহার করা যকৃৎ ও পাকস্থলির ৫০ মিলিলিটার সংরক্ষণ করতে হবে। আর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হবে এতটাই বিস্তারিত, যা পড়ে সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে। ময়নাতদন্ত বিষয়ে ভারতীয় বিশেষজ্ঞ ড. জয়সিং মোদির বইটিই আমাদের দেশে সবেধননিলমণি। ২০১১ সালে মাদ্রাজ হাইকোর্ট বলেছিলেন, মোদির বইয়ে বর্নিত গাইডলাইন ময়নাতদন্তে মানতে হবে। কিন্তু আমাদের চিকিৎসা শিক্ষায় সব থেকে অবহেলিত এই শাস্ত্র, খুবই কম নম্বর, তেমন করে পড়তে হয় না বললেই চলে। আসলে দেশের সবগুলো মেডিকেল, আইন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে সব থেকে অবহেলিত হলো আইনঘটিত চিকিৎসাবিদ্যা, যা ফরেনসিক মেডিসিন বা মেডিকেল জুরুসপ্রডেন্স হিসেবে পরিচিত। এ বিষয়ে সরকার ও বিচার বিভাগীয় আশু হস্তক্ষেপ দরকার।
বিচারপতি লক্ষ্মণানের নেতৃত্বাধীন ভারতের আইন কমিশন ২০০৮ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল যে দিল্লির হাইকোর্ট তাঁর রায়ে আইন না থাকার যে তথ্য উল্লেখ করেছেন, তা সঠিক নয়। যদিও ১৮৭১ আইনটি কেবল বোম্বে ও ‘কলকাতা প্রেসিডেন্সির’ জন্য প্রযোজ্য ছিল। এরপর আইন কমিশন যা বলেছে, তা আমাদের আইন কমিশনও বলতে পারে যে যদিও ময়নাতদন্তের বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৪ থেকে ১৭৬ বিধিতে উল্লেখ আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘একটি পূর্ণাঙ্গ ময়নাতদন্ত আইন (করোনার্স অ্যাক্ট) করা সময়ের দাবি’।
আমরা, এই ভূখণ্ডের মানুষ কমবেশি ওই আইনের পূর্বসূরি ছিলাম। আমি একজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ আইনজীবীকে খুদে বার্তা পাঠালাম। বললাম, আমি যুক্তি দিতে চাই, ১৮৭১ সালের আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানের আওতায় এখানে এখনই প্রয়োগ করা চলে। আমাকে গত শনিবার তিনি জানালেন, ওই আইনটি শুধু কলকাতা ও বোম্বের জন্য করা হয়েছিল। আইনটি প্রাদেশিক ছিল, সমগ্র ভারতের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। তাই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনের তালিকায় সেটি বাদ পড়েছে, আমাদের তালিকায়ও সে কারণে নেই। তদুপরি বিনয়ের সঙ্গে এই যুক্তি দেখাতে চাই যে এই আইনটা অত্যন্ত দরকারি ও জনগুরুত্বসম্পন্ন। আর তা ভূখণ্ডগত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কোনো বিষয়সংক্রান্ত নয়, এটা সর্বজনীন। তাই করোনার্স অ্যাক্টকে বাংলাদেশে বলবৎ করা যেতে পারে কি না, তা ভেবে দেখার দাবি রাখে।
কারণ, বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে ‘আইন’ ও ‘প্রচলিত আইন’কে সংজ্ঞায়িত করেছে। প্রচলিত আইন হলো ‘সংবিধান প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানায় বা উহার অংশবিশেষে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সক্রিয় থাকুক বা না থাকুক এমন যেকোনো আইন।’ আর আইনের সংজ্ঞায় ‘বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো প্রথা বা রীতি’কে আইন বলা হয়েছে। তাই ১৮৭১ সালের আইন যদি পাকিস্তান সাতচল্লিশের পরে গ্রহণ না-ও করে, তাতেও আমার যুক্তি দুর্বল হয় না। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ১৮৬১ সালে সৃষ্ট ফোর্ট উইলিয়ামের হাইকোর্টেরই উত্তরসূরি। আমার দেশ সম্পাদকের মামলায় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সংসদে করা আইনের শূন্যতা ‘কমোন ল’ দিয়ে পূরণের নীতি স্বীকার করেছিলেন। ১৮৭১ সালের আইনটি তেমনই একটি আইন বা রীতি হিসেবে গণ্য হোক, যা ‘আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন’ অথচ ‘কার্যক্ষেত্রে সক্রিয় না থাকা’। আর দরকার হলে যা যা করার তাই করতে হবে, ময়নাতদন্তে এ রকম আইনি শূন্যতা চলতে পারে না।
সরকার একান্তই শিথিল মনোভাব বজায় রাখলে জনস্বার্থে একটি মামলা সূত্রে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের মতো করে আমাদের একটি গাইডলাইন হলেও চলে। পেশাগত জীবনে সাত হাজারের বেশি লাশের ময়নাতদন্ত করেছেন এমন একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছি। তার মধ্যে কয়েক শ নিহত ব্যক্তির লাশ ছিল। বহু মামলায় আদালতে ইনকুয়েস্ট হিয়ারিং বা শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু কখনো করোনার্স আইন বা কোনো ধরনের অবশ্য পালনীয় নিয়মরীতি অনুসরণের কথা শোনেননি।
অনেকের কাছে খটকা লাগতে পারে, কিন্তু ময়নাতদন্ত এমন একটি বিষয় যে ব্যাপারে প্রাচীনকাল থেকে প্রধান বিচারপতির বিশেষ ভূমিকার (দেখুন, ফরেনসিক মেডিসিন অ্যান্ড ডেথ ইনভেস্টিগেশন ইন মেডিভিয়েল ইংল্যান্ড, সারা এম. বাটলার, রাউটলেজ, ২০১৪, পৃ. ৫৪) স্বীকৃতি দেখা যায়। কমোন ল–এর ধারণায় করোনার্স আইন অতীব প্রাচীন। ৮০০ বছর আগে ময়নাতদন্ত করার পারিশ্রমিক হিসেবে করোনার নিহতের পোশাকের উপরের অংশ নিতে পারতেন, জাঙ্গিয়া বা প্যান্ট নেওয়া বারণ ছিল। তনুর প্রথম ময়নাতদন্তে তনুর গুরুতর আঘাতগুলোর উল্লেখ বাদ পড়েছে, প্রাচীন করোনার্স আইনেই তা দণ্ডনীয় অপরাধ। ১৩২৯ সালে ইংল্যান্ডের প্রধান বিচারপতি স্যার জিওফ্রি স্ক্রুপ জরিমানা আদায়ের আগ পর্যন্ত একজন ময়নাতদন্তকারীকে কারাগারে বন্দী করে রেখেছিলেন। ওই করোনার লাশের
তদন্ত শেষে তাকে হত্যাকাণ্ডের শ্রেণিভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ১৩২১ সালে লন্ডনের করোনার আদালতের তলব পেয়েও হাজির হতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। বিচারপতি স্টানটোন লন্ডনের করোনারের স্ত্রী ও সন্তানকে জিম্মি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল, করোনার ২৪ ঘণ্টা তাঁর দায়িত্ব পালনে সজাগ থাকবেন।

Facebook Comments