ফাতেমা শাহরিন
হাবীবাহ্ নাসরীন এ প্রজন্মের অন্যতম প্রতিভাবান একজন কবি ও লেখক। তিনি পেশায় সাংবাদিক হলেও লেখালেখির ক্ষেত্রে বিরামহীন এগিয়ে চলেছেন। তার লেখার সবচেয়ে বড় জাদু হলো, ভাষার সহজ সরল ও সাবলীল উপস্থাপনা। যা তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। এ বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে অমর একুশে বইমেলায় আসছে তার কাব্যগ্রন্থ ‘তুমি আমার শুদ্ধতম পাপ’। এর আগে ও ২০১৬ ও ২০১৭ সালে একুশে বই মেলায় তার তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। অপরাজিতার পক্ষ থেকে আমরা এই গুণী লেখিকার মুখোমুখি হয়েছিলাম। তার সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হল।
অপরাজিতা: কেমন কেটেছে আপনার শৈশব? হারানো সেই দিন গুলোতে কি ফিরে যেতে ইচ্ছে করে?
হাবীবাহ্ নাসরীন: খুব ছোটবেলায় বিভাগীয় শহরে ছিলাম। সেখানে জীবন ছিল ফ্ল্যাটবন্দী। পরে আব্বুর পোস্টিংয়ের কারণে চাখারে চলে যাই। চাখার গ্রাম হলেও বেশ উন্নত ছিল। কারণ এটি শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হকের গ্রাম। না গ্রাম, না শহর- আবহের একটি পরিবেশে আমার বেড়ে ওঠা। পুকুরে সাতার কাটা, গাছ থেকে ফল পেড়ে আনা, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো, সকালে উঠে ফুল কুড়ানো, মধ্যরাতে রাতজাগা ডাহুকের ডাক শুনে ভয়ে ভয়ে জেগে থাকা- আমার মধুময় স্মৃতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। শুধু মধুময় স্মৃতিই বলবো না, আমার লেখক হয়ে ওঠার পেছনে এর অবদান অনেক। ছেলেবেলায় ওরকম পরিবেশ না পেলে আমার লেখনীয় সত্ত্বা বিকাশিত হতে পারতো কি না কে জানে! ছোটবেলায় ফিরে যেতে চাই না। কারণ তাতে যে আগামীর স্বপ্ন লালন করে আমি এতটা পথ এসেছি তা আবার পিছিয়ে যাবে।
অপরাজিতা: লেখা লেখির শুরুটা কী ভাবে হয়েছে? এ ক্ষেত্রে আপনার পথ চলা সম্পর্কে জানতে চাই!
হাবীবাহ্ নাসরীন: লেখালেখির শুরুটা হয়েছিল একাকিত্ব থেকে। আমার ছোট ভাইয়ের জন্মের সময়টাতে আম্মু খুব অসুস্থ ছিলেন। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতেন। আগের সেই আদর, আবদার, আহলাদ কিছুই পেতাম না। একা একা অসহায়ের মতো ঘুরে বেড়াতাম। তখন মনে হলো এইসব নিবিড় দুঃখের কথা লিখে রাখি। লিখে লিখে দুঃখ যদি কিছুটা কমে। লিখতে গিয়ে একটা নেশার মতো হয়ে গেল। মনে হতো, রবী ঠাকুর, কাজী নজরুলের মতো আমিও লিখতে পারি না কেন! ওদের মতো লিখতে চাইতাম। বানিয়ে বানিয়ে কিছু একটা লিখতামও। কিন্তু তখন তো ছোট মানুষ ছিলাম। ছয় বছর বয়স। প্রতিদিন লিখতাম আর ওদের মতো হচ্ছে না বলে মন খারাপ করতাম। এই লিখতে না পারার ক্ষুধাই আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। ১৯৯৭ সাল থেকে লেখার শুরু। প্রথম লেখাটি প্রকাশ হয় ছোটদের পত্রিকা নামের একটি ম্যাগাজিনে। এটি ২০০৪ সালের কথা। সে বছরই ছোটদের মেলা থেকে একটি ছড়ার সংকলন প্রকাশ হয়। ছড়াগুলো লিখেছে ছোটরা নামের বইটিতে আমারও একটি ছড়া প্রকাশ হয়েছিল। পাশাপাশি আমার ছবি আর সাক্ষাৎকারও ছেপে ছিল। এরপর ২০০৮ সালে ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসর আয়োজিত ছড়া প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ ছড়াকার নির্বাচিত হয়েছিলাম। ২০১০ সালে বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে তৃতীয় ব্যাচে বৃত্তি পেয়েছিলাম। তখন ঢাকায় নতুন। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। বাংলা একাডেমির নেয়া পরীক্ষায় এগারোতম হয়েছিলাম। এর মাঝে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে লেখা ছাপা হতো। বাংলা একাডেমির কোর্স শেষে আবার কিছুদিন আড়ালে চলে গিয়েছিলাম। ২০১৬ সালে এসে মনে হলো, এবার একটি বই হতে পারে। প্রকাশ হলো আমার প্রথম বই ‘কবিতা আমার মেয়ে’। এরপর ২০১৭ সালে উপন্যাস ‘তুমি আছো, তুমি নেই’, ছোটদের গল্পের বই ‘টুম্পা ও তার বিড়ালছানা’ প্রকাশ হলো। আর এ বছর নিয়ে এসেছি কবিতার বই ‘তুমি আমার শুদ্ধতম পাপ’। এভাবেই একটু একটু করে আগাচ্ছি। লেখালেখি নিয়ে আমার বেশকিছু স্বপ্ন আছে। পূরণ করার চেষ্টা করে যাবো।
অপরাজিতা: প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত মিলে এ পর্যন্ত আপনার কতগুলি লেখা রয়েছে?
হাবীবাহ্ নাসরীন: লেখার সংখ্যা খুব বেশি নয়। প্রথমদিকের অনেক লেখাই কোথাও প্রকাশ করিনি। সেগুলো তত মানসম্পন্নও নয়। তবে আমি সেগুলোকে অস্বীকারও করি না। ওইসব কবিতা আমার কাছে অনেকটা সিঁড়ির মতো। প্রকাশ করার মতো কবিতা সম্ভবত একশোটির মতো লিখেছি। কমও হতে পারে। আর উপন্যাস তো একটি। গল্প আছে আটটি। এইতো।
অপরাজিতা: প্রথম প্রকাশিত বই ও প্রথম বই মেলা সম্পর্কে জানতে চাই।
হাবীবাহ্ নাসরীন: প্রথম প্রকাশিত একক বই ‘কবিতা আমার মেয়ে’। মূলত এই বইটির মাধ্যমেই আমি আমার পাঠকদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। প্রথম বইমেলায় যাওয়া ২০১০ সালে। তখন নিজে প্রচুর বই কিনতাম আর বন্ধুদেরকেও কিনে দিতাম।
অপরাজিতা: এবারের মেলায় প্রকাশিত বইটি সম্পর্কে জানতে চাই?
হাবীবাহ্ নাসরীন: এবারের বই মেলায় প্রকাশ হচ্ছে কবিতার বই ‘তুমি আমার শুদ্ধতম পাপ’। এতে ষাটটির মতো কবিতা রয়েছে। যার বেশির ভাগই প্রকাশিত।
অপরাজিতা: লেখার সাথে সম্পর্কিত স্মরণীয় ঘটনা?
হাবীবাহ্ নাসরীন: আমার জীবনের বেশিরভাগ ঘটনাই লেখার সাথে সম্পর্কিত। যতটা সম্মান, ভালোবাসা পেয়েছি তার প্রায় সবটাই লেখার কারণে। অনেক অচেনা মানুষ ফুল, চকোলেট, রান্না করা খাবার, নানা উপহার নিয়ে দেখা করতে আসেন এটাই আমার কাছে আশ্চার্যজনক মনে হয়। লিখতে না জানলে এমন ভালোবাসা আর কিসে পেতাম!
অপরাজিতা: আপনার লেখা নিয়ে আগামীর পরিকল্পনা কী?
হাবীবাহ্ নাসরীন: পরিকল্পনা নেই। স্বপ্ন আছে। মৃত্যুর আগে কিছু লেখা সমাপ্ত করে যেতে চাই।
অপরাজিতা: আপনার পছন্দ অপছন্দের বিষয়গুলো কী কী?
হাবীবাহ্ নাসরীন: পছন্দের বিষয় হচ্ছে সততা, ভালোবাসা। হিংসা, কৃতঘ্নতা খুব অপছন্দ।
অপরাজিতা: তরুণদের উদ্দেশে কিছু বলুন!
হাবীবাহ্ নাসরীন: আমি নিজেই তো তরুণ! একটা কথাই বলতে চাই, চলো, এগিয়ে যাই।
ফাতেমা শাহরিন
সহ-সম্পাদিকা(অপরাজিতা)
http://oporajitabd.com