banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1339 বার পঠিত

 

ঈদ উৎসবে সৌদি আরব

ডা. ফাতিমা খান


সৌদি আরবে ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে যায় রমজান শুরু হওয়ার আগে থেকে। আমার কাছে যে আরব দেশীয়রা চিকিৎসা নিতে আসে, তাদের মাঝে আমি এ ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করেছি। এদেশের সংস্কৃতি অনেকটা মিশ্র ধরনের। যুগ যুগ ধরে ইয়েমেনি, মিশরীয়, ফিলিস্তিনি, জর্ডানি, সিরিয়ানসহ ইন্ডিয়ানরা তাদের কিছু কিছু কালচার এদেশে প্রচলিত করে দিয়েছে। যার কারণে ওদের অভ্যাস আর কালচারের মাঝেও বিভিন্নতা দেখা যায়। অনেক গুলো বছর এদেশে কাটানোর পরও সৌদিদের সাথে খুব বেশী পারিবারিক ভাবে মেলামেশা বা সামাজিকতা রক্ষা করা হয়নি। তবে ওদের উৎসব বা আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা হয়ে গিয়েছে।

রমজানের সময় দেখতাম আমভাবে রোগীরা বিদায় নেয়ার সময় বলত, “কুল্লু আ’ম ওয়া আনতুম বি খায়ের” অথবা “কুল্লু সানা আনতুম তাইয়্যেবীন”। দুইটা বাক্যই হল একটা শুভকামনার প্রকাশ যার অর্থ হল “সারাবছর তোমরা ভাল থেকো”। এই একই কথা তারা ঈদের সময়ও বলে থাকে। সাথে যুক্ত হয় আরো কিছু দোয়ামূলক বাক্য, যেমন তাকাব্বাল মিন্না ওয়া মিনকুম (আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের নেক আমলগুলোকে কবুল করুন) বা ঈদ সাঈদ ( আনন্দময় ঈদ) অথবা ঈদ মোবারাক।

রোজার মাসে এখানে সবাই রাতে জেগে ইবাদত করে , সেহরির পর ঘুমায়। দুপুরে যুহর নামাজের সময় তাদের দিন শুরু হয়। সেই অভ্যাসমত চাঁদ রাতেও নিদ্রাহীন ভাবে এখানে সবাই ঈদের দিনটার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকে। মসজিদে তাকবীর শোনার পর সবার মাঝে ঈদের আমেজ শুরু হয়। পটাকা বা বাজী ফুটিয়ে, ঘরদোর সাজিয়ে, বাখুর ( সুগন্ধী কাঠের গুড়া বা টুকরা) জ্বালিয়ে, প্রতিবেশীদের চকলেট বা মিষ্টি জাতীয় খাবার পাঠিয়ে তারা চাঁদ রাতে ঈদেকে স্বাগতম জানায়। বাড়িতে আত্নীয় স্বজনদের সমাগম হয়। অন্দরমহলে চলে মেহেদী লাগানোর ধুম। ছোট থেকে বড় সবার ফ্যাশন, মেকাপ আর ড্রেসাপ এর জল্পনা কল্পনায় ঘরবাড়ি সরব হয়ে ওঠে। ঘরের মুরব্বীরা কনিষ্ঠদের জন্য সামর্থ অনুযায়ী ঈদের সেলামী বা মিনি গিফট প্যাক তৈরী করে। সুঘ্রানের এরাবিয়ান কফি বা “কাহওয়া” পান চলে সারারাত। সাথে থাকে “হালা” বা যেকোন মিষ্টিজাতীয় খাবার।

ঈদের সময় ওদের ঘরে যে সুসাদু মিষ্টি জাতীয় খাবারগুলো তৈরী হয় তারমধ্যে বাসবুসা, বাকলাভা, কুনাফা, কাতায়েফ, ফ্রুট ক্যারামেল, ক্ষীর, পুডিং, মাহালাবিয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এগুলো বেশীরভাগই ওভেন বেকড এবং দুগ্ধজাত। এর মধ্যে কয়েকটি লেবানিজ বা মিশরীয় কুস্যিন।

দান দখিনায় এদেশের ধনী ও ধার্মিক মানুষগুলোর জুড়ি নেই। একাজে তাদের অনেকেই নবী, রাসূল ও সাহাবাদের আদর্শের অন্ধ অনুসারী। ধনীর দৌলতের অংশ থেকে গরীবদের প্রাপ্তিটুকু বুঝে নিতে ঈদের আগের দিন বা ঈদের দিন পর্যন্ত সোমালি, হাবাশী, ইথিওপিয়ানসহ কিছু গরীব দেশের মানুষদের দেখা যায়, যারা যাকাত ফিতরা বা কিছু সাদাকা প্রাপ্তির আশায় অপেক্ষা করে।

ঈদগাহে মানুষের সমাগম হয় দেখার মত। বিশাল ঈদগাহ গুলোতে সব দেশের, সব বয়সের পুরুষ, মহিলা ও বাচ্চাতে জনাকীর্ণ হয়ে যায়।

দেশ, জাতি নির্বিশেষে নাড়ীর সাথে বাড়ীর সাথে মানুষের বন্ধন চিরন্তন। আমাদের দেশের মত এদেশেও ব্যস্ত কমার্শিয়াল শহরগুলোর একটা বড় অংশ ঈদের সময় ফাকা হয়ে যায়। সবার গন্তব্য থাকে যার যার গ্রামের বাড়ির দিকে। গ্রাম বা মফস্বল জাতীয় এলাকাগুলোকে তারা বলে ‘ক্বারিয়া’ (যদিও কোরআন শরীফে বিভিন্ন জায়গায় ‘ক্বারিয়া’ বলতে জনপদকে বোঝানো হয়েছে)।ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই তাদের আনন্দমিশ্রিত অস্থিরতা শুরু হয়ে যায় “ক্বারিয়া” গমনের জন্য। ঈদের দিন এখানকার পার্ক, সি-বীচ আর রিসোর্টগুলো থাকে ভিড়ে আকীর্ণ।

বাংলাদেশী পরিবারগুলো দেশী রীতি রেওয়াজ অনুযায়ী ঈদ উদযাপন করে। উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোর প্রবাসীদের ঈদ যাপন অনেকটা আমাদের মতই। বাঙালি নারীদের ঐতিহ্যবাহী অভ্যাস হল ঈদের সারাটা দিন রসুইঘরে মুখরোচক রান্না করে কাটানো। নিজের পরিবার, মেহমান, পাড়া প্রতিবেশীদের আপ্যায়নের জন্য তাদের ঈদের দিন রীতিমত কোরবানী করার মাঝেই তাদের ঈদ আনন্দ। স্বামী সন্তানদের নতুন কাপড় পরিয়ে নিজের কাপড়খানা কোন অনুষ্ঠানে পরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেই তারা খুশি থাকেন। অবশ্য কেউ কেউ ঈদের ছুটি কাটাতে অন্য কোন শহরে ঘুরতে যান পরিবারসহ। বিশেষ করে আমাদের মত চাকুরীজীবী মায়েরা কর্মব্যস্ততার ক্লান্তি দূর করতে ও বাচ্চাদের সাথে একটু আনন্দময় সময় কাটাতে দু একদিনের জন্য দূরে কোথাও বা প্রকৃতির কাছাকাছি কোথাও বেরিয়ে আসেতে পছন্দ করেন।

এখানকার প্রবাসী পরিবারগুলোর ঈদ আনন্দের আরেকটি বড় উৎস হল ঈদ পূনর্মিলনী অনুষ্ঠানগুলো। অনুষ্ঠানগুলোতে প্রত্যেক দেশের মানুষগুলো যার যার দেশীয় খাওয়া দাওয়া ও বিনোদনের আয়োজন করে থাকে। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে স্বদেশের প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা উপভোগ করতে অন্তত বাংলাদেশীদের ভুল হয়না।

ঈদকে পুরাপুরি উপভোগ করতে পারেননা প্রবাসী শ্রমিক গোছের মানুষগুলো। যারা পরিবার পরিজন রেখে এখানে একা থাকেন তাদের ঈদের দিনটা নিতান্ত মলিন। দেশে পরিবার পরিজনদেরকে নিজের সবটুকু উপার্জন আর উপহার পাঠানোর মাঝেই তারা আনন্দ খুঁজে নেন। তারপরও অনেকেই পরিবারের মন রক্ষা করতে পারেননা । ঈদের দিনেও তাদের কেউ কেউ ওভারটাইম করেন আরো কিছু বাড়তি অর্থের যোগান দিতে। ঈদের আনন্দঘন দিনটির সুশীতল আমেজ তাদের ঘর্মাক্ত দেহ আর ক্লান্ত মনকে একটু স্বস্তি দিতে পারেনা।

ডা. ফাতিমা খান
লেখিকা কর্মরত: আল হিবা মেডিক্যাল গ্রুপ, জেদ্দা, সৌদি আরব।

Facebook Comments