banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 174 বার পঠিত

 

ইসলামে সন্তান সন্তুতির অধিকার

ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই সন্তানের মধ্যে গণ্য। সন্তান সন্ততির অধিকার অনেক। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হচ্ছে শিক্ষা লাভের অধিকার। তবে আল্লাহর দ্বীন এবং চরিত্র গঠনের জন্যই এ শিক্ষা; যাতে তারা তাতে বেশ উৎকর্ষতা লাভ করতে সমর্থ হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَأَهۡلِيكُمۡ نَارٗا وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلۡحِجَارَةُ [التحريم: ٦]

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের নিজদেরকে ও তোমাদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের অগ্নি থেকে রক্ষা কর- যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর।’ [সূরা আত-তাহরীম]

রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ»

তোমাদের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের রাখাল (তত্ত্বাবধায়ক) এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তাই আখেরাতে তার রাখালির (তত্ত্বাবধান) জন্য জিজ্ঞাসিত হবে, একজন মানুষ তার পরিবারের রাখাল, তাকে সে রাখালিপনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ [বুখারি, মুসলিম]

প্রকৃত প্রস্তাবে সন্তান বা ছেলে মেয়েগণ হচ্ছে পিতা মাতার স্কন্ধে এক বিরাট আমানতস্বরূপ। অতএব, কিয়ামতের দিন তাদের উভয়কেই তাদের সন্তানদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, এমতাবস্থায় পিতা মাতার দায়িত্ব হচ্ছে তাদেরকে ধর্মীয় এবং নৈতিক তথা উভয়বিধ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের সংশোধন পূর্বক গড়ে তোলা। এরূপ করা হলেই তারা ইহকাল এবং আখেরাতে পিতা-মাতার জন্য চোখের শীতলতা তথা শান্তি বয়ে আনবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَٱتَّبَعَتۡهُمۡ ذُرِّيَّتُهُم بِإِيمَٰنٍ أَلۡحَقۡنَا بِهِمۡ ذُرِّيَّتَهُمۡ وَمَآ أَلَتۡنَٰهُم مِّنۡ عَمَلِهِم مِّن شَيۡءٖۚ كُلُّ ٱمۡرِيِٕۢ بِمَا كَسَبَ رَهِينٞ ٢١ [الطور: ٢١]

আর সে সব লোক যারা আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে, অতঃপর তাদের সন্তানগণও ঈমানের সহিত তাদের পত অনুসরণ করেছে, তাদের সাথে তাদের সন্তানদেরকে আমি মিলিত করব। আর আমি তাদের কোন আমলই বিনষ্ট করবনা। প্রতিটি লোক যা কিছু আমল করে তা আমার নিকট দায়বদ্ধ থাকে।’ [সূরা আত-তূর: ২১]

রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثٍ: صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ»

যখন কোনো লোক মারা যায়, তখন তার তিনটি আমল’ ব্যতীত সব কাজ বন্ধ হয়ে যায়। উক্ত তিনটি কাজ বা আমল হচ্ছে সাদকায়ে জারিয়া, এমন ইলম বা জ্ঞান যা দ্বারা তার মৃত্যুর পরও লোকেরা উপকৃত হতে থাকে এবং এমন কোনো সুসন্তান, যে তার পিতার মৃত্যুর পর তার জন্য দোআ করে।’ [তিরমিযী, নাসাঈ]

ছেলে মেয়েদেরকে সুশিক্ষা ও শিষ্টাচারের সহিত গড়ে তোলার এইটাই হচেছ ফল, যে এই ধরণের ছেলে-মেয়েরাই পিতা-মাতার জন্য এমনকি তাদের মৃত্যুর পরও কল্যাণকামী হিসেবে পরিগণিত হয়। অনুতাপের বিষয় যে, আমাদের সমাজে অনেক পিতা-মাতাই এই অধিকারটাকে অত্যন্ত সহজ মনে করে নিয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে তারা তাদের ছেলে-মেয়েদের কে ধ্বংস করে দিচ্ছেন এবং তাদের কথা যেন ভুলেই গেছেন। মনে হয় যেন তাদের ব্যাপারে তাদের ওপর কোনো দায়িত্বই নেই। তাদের ছেলে-মেয়েরা কোথায় গেল এবং কখন আসবে, কাদের সাথে তারা চলা ফেরা করছে অর্থাৎ তাদের সঙ্গী-সাথী কারা এ সব ব্যাপারে তারা কোন খবরা খবরই রাখে না। এ ছাড়া তাদেরকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ এবং মন্দ কাজ থেকে বিরতও রাখে না।

আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এসব পিতা-মাতাই তাদের ধন সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার প্রবৃদ্ধির জন্য খুবই আগ্রাহান্বিত থাকেন, সদা জাগরুক থাকেন, অথচ এসব সম্পদ সাধারণত তারা অন্যের জন্যই রেখে যান। অথচ সন্তান-সন্তুতির ব্যাপারে তারা মোটেও যত্নবান নন, যার সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ হলে দুনিয়া ও আখেরাতের সবস্থানেই তারা কল্যান বয়ে আনতে পারে। অনুরূপভাবে পানীয় ও আহার্যের মাধ্যমে ছেলে মেয়েদের শরীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য খাদ্য দ্রব্যের যোগান দেওয়া, তাদের শরীরকে কাপড় দিয়ে ঢাকা যেমন পিতার উপর ওয়াজিব তেমনিভাবে পিতার জন্য অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে সন্তানের অন্তরকে ইলম ও ঈমানের মাধ্যমে তরতাজা রাখা এবং তাকওয়া ও আল্লাহ্‌ভীতির লেবাস পরিধান করিয়ে দেওয়া, কেননা তা তাদের জন্য অবশ্যই কল্যাণকর।

সন্তানের অধিকারের মধ্যে আর একটি অধিকার এই যে, পিতা মাতা তাদের জন্য সৎভাবে ব্যয় করবেন। তবে এ ব্যাপারে কার্পণ্য ও অমিতব্যয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন না। কারণ, এটা তাদের ওপরে সন্তানের অধিকার ও কর্তব্য। আর আল্লাহ তাআলা তাকে যে নেয়ামত দান করেছেন, সে ব্যাপারে অবশ্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। এটা কিছুতেই ঠিক হবে না যে, ধন সম্পদকে পিতা তার জীবদ্দশীয় ছেলে মেয়েদের ওপর ব্যয় না করে তা কুক্ষিগত করে রাখবেন অথচ তারা মৃত্যুর পর সে ছেলে-ময়েরাই তা লুফে নিয়ে যথেচ্ছ ব্যবহার করবে।

অতএব, পিতা যদি ধন সম্পদে আসক্তিবশত সন্তানদের ওপর ব্যয় করার ব্যাপারে কার্পণ্য করেন, তা হলে তাদের জন্য বৈধ হচ্ছে তাদের প্রয়োজনমাফিক সৎভাবে সে মাল থেকে গ্রহণ করা এবং ব্যয় করা। আর এরূপ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিনদা বিনতে ওতবার ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন।

সন্তানের অধিকারের মধ্যে আরেকটি অধিকার এই যে, উপহার-উপঢোকন এবং দানের ক্ষেত্রে তাদের একজনকে অন্যজনের উপরে অগ্রাধিকার দেয়া যাবে না। অতএব, সন্তানদের কাউকে কিছু দেওয়া এবং কাউকে তা থেকে বঞ্চিত করা অনুচিত। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এটা নিতান্তই জুলুম। আর আল্লাহ কখনো জালেমদের ভালবাসেন না। এইরূপ করা হলে, যারা বঞ্চিত তাদের মধ্যে একটি বিতৃষ্ণা ও ঘৃণার ভাব উদ্রেক হয় এবং পুরস্কৃত ও বঞ্চিতদের মধ্যে একটি স্থায়ী শত্রুতা সৃষ্টি হয়। এমনকি অধিকন্তু বঞ্চিত সন্তান-সন্ততি ও তাদের পিতা-মাতার মধ্যে একটি শত্রুতা ও তিক্ততা সৃষ্টি হয়।

আর কিছু সংখ্যক লোক আছে যারা তাদের উপর কৃত সদ্ব্যবহার ও অনুকম্পার প্রেক্ষিতে তাদের কোনো কোনো সন্তানকে অন্যদের ওপর বিশিষ্টতা দিয়ে থাকে। আর এ কারণেই যদি পিতা-মাতা তাকে দান-অনুদান এবং পারিতোষিক প্রদান করেন, তা হলে সেটা কখনো সঠিক হবে না। অর্থাৎ কারো সদ্ব্যবহার অথবা পূণ্যবান হওয়ার কারণে তার বিনিময়ে কিছু দেয়া জায়েয হবে না। কেননা, নেক কাজের পরিনাম ও ফলাফল আল্লাহর কাছেই রয়েছে। তাছাড়া কোনো সৎস্বভাব বিশিষ্ট সন্তানকে যদি অনুরূপ ভাবে অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে বেশী দান করা হয়, তা হলে সে মনে মনে গর্বিত ও আত্মতুষ্ট না হয়ে পারে না এবং সে সব সময়ই তার একটি (বাড়তি) পজিশন আছে বলে ধরে নেবে, যার ফলে অন্যরা পিতা-মাতাকে ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করবে এবং তাদের ওপর জুলুম চালিয়ে যেতে থাকবে। অপর দিকে ভবিষ্যত সম্পর্কে আমরা আদৌ কিছু জানি না। এমনওতো হতে পারে যে, এখন যে অবস্থাটা কারো ব্যাপারে বিদ্যমান রয়েছে, তার আমুল পরিবর্তন হতে পারে। আর এ ভাবেই একজন অনুগত ও পুণ্যাত্মা আগামী দিনগুলোতে বিদ্রো্হী ও অত্যাচারী হয়ে যেতে পারে এবং একজন বিদ্রোহীও পুণ্যাত্মায় পরিণত হতে পারে। মানুষের অন্তরের বাগডোরতো আল্লাহর হাতেই নিবদ্ধ-তিনি যেদিকে চান সে দিকেই তা ঘুরাতে সক্ষম।

বোখারী এবং মুসলিম শরীফে আছে : নোমান বিন বশীর থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, তার পিতা বশীর ইবন সাদ তাকে একটি গোলাম দান করলেন। অতঃপর এই ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানো হলো। তিনি বললেন: (হে, বশীর) তোমার প্রতিটি ছেলে কি এইরূপ পেয়েছে? তিনি বললেন: না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : তা হলে তা ফেরত নাও।’

অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে তিনি বলেন, আল্লাহকে ভয় কর এবং সন্তান-সন্তুতির মধ্যে ইনসাফ কায়েম করতে চেষ্টা কর।” তাছাড়া এভাবেও বর্ণিত রয়েছে যে তিনি বলেছেন, আমি এ ব্যতীত সব বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমি জুলুমের ব্যাপারে ব্যাপারে সাক্ষ্য হবো না।’

মোটকথা রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্তান-সন্তুতির মধ্যে কাউকে কারো ওপরে গুরুত্ব দানের বিষয়টিকে জুলুম হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। আর জুলুম তো হারাম। কিন্তু সন্তানদের মধ্যে যদি কারো কোনো প্রয়োজনীয়তা উপস্থিত হয় এবং অন্যদের তা প্রয়োজন না হয়, যেমন ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনো একটি সন্তানের লেখাপড়ার তথা বিদ্যালয়ের উপকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় অথবা রোগের চিকিৎসা অথবা বিবাহ ইত্যাদির প্রয়োজন হয়, এমতাবস্থায় সে ব্যাপারে খরচ মেটানোর ব্যবস্থা করা আদৌ দোষণীয় নয়। কারণ এটা নিতান্ত প্রয়োজনের প্রেক্ষিতেই করা হয়ে থাকে। আর এরূপ ব্যয় মূলত: সন্তান-সন্ততির খোরপোষ তথা লালন-পালনের ব্যয় ভারের মধ্যেই গণ্য হবে।

যখন পিতা তার সন্তানকে শিক্ষা-দীক্ষা দান ও তার প্রতি যা কিছু ব্যয় করা দরকার তা করার মাধ্যমে তার উপর ন্যস্ত কর্তব্য পালন করবে, তখন তার সন্তান ও পিতা-মাতার প্রতি মার্জিত আচরণ করবে এবং তার যাবতীয় অধিকারকে সংরক্ষণ করবে। আর পিতা যদি এ ব্যাপারে ত্রুটি করেন তাহলে সন্তানের অবাধ্যতার শিকার হওয়ার জন্য সে উপযুক্ত হবেই। কেননা, এই অবস্থায় সন্তান তার পিতার অধিকার অস্বীকার করবে এবং তার অবাধ্য আচরনের দ্বারা পিতাকে অনুরূপ শাস্তি প্রদান করবে। কাজেই যেমন কর্ম তেমন ফল।

মূল : শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল উসাইমিন রহ.
অনুবাদ : মো. আব্দুল মতিন

Facebook Comments